ছবি : সংগৃহীত

দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে পূর্ণবয়স্ক রোগীর সংখ্যাটা তুলনামূলক বেশি হলেও শিশু রোগীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে করে দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়াদের ১৯ শতাংশই শিশু রোগী, যাদের বয়স ১৫ বছর বা তার চেয়েও কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে অন্য বয়সীদের তুলনায় শিশুরাই বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এমনকি দ্বিতীয়বার আক্রান্তরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।  

মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, একদিনের ব্যবধানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে আরও ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একইসঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ১১০৮ জন। 

রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সর্বমোট ৪১ জন শিশু ভর্তি রয়েছেন। শিশুদের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় সতর্কতা হিসেবে শিশু হাসপাতালে বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নার চালু করা হয়। রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সেখানে ১৬টি শয্যায় চিকিৎসা হলেও সোমবার তা বাড়িয়ে করা হয় ২৪টি।

সন্তান ডেঙ্গু আক্রান্ত, চিন্তার ভাঁজ অভিভাবকদের কপালে

৫ বছরের শিশু আয়মান শিকদার, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। পরিবারের একমাত্র ছেলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে জীবনের জন্য লড়াই করছে। তাই বাবা সাইদুল ইসলামের মাথায় হাজারো চিন্তা এসে ভর করেছে। নীরবে ফেলছেন চোখের জল।

জানা গেছে, শিশু আয়মানকে গত শনিবার প্রথমে মিরপুরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে দ্রুত শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

সাইদুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় শিশু হাসপাতালে আনি। তারপর ডাক্তার দ্রুত তাকে আইসিইউতে পাঠিয়েছেন। জানি না এখন তার কী অবস্থা। ডাক্তার শুধু বলেন দোয়া করতে। আমার একটামাত্র ছেলে, যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তার মায়ের সামনে আমি মুখ দেখাতে পারব না। এমনতেই ছেলে অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তার কান্না থামছে না।

তিনি বলেন, আমি ষাট ফিট এলাকার বারেক মোল্লার মোড়ে পরিবার নিয়ে থাকি। ওই এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই বাজে। রাতে মশার উৎপাত অনেক বেশি থাকে। তারপরও প্রতিদিন আমরা মশারি টানিয়ে ঘুমাই। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকায় আমরাও সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করি। তারপরও কীভাবে কী হয়ে গেলো, বুঝতে পারছি না।

প্রায় এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি ১২ বছর বয়সী মারুফ মিয়া। তেজগাঁওয়ের একটি মাদ্রাসার আবাসিক হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে সে।

মারুফের মা নাজমা আক্তার বলেন, আজ ছেলের জ্বর নেই। চিকিৎসক জানিয়েছে তার প্লাটিলেটও বাড়ছে। তাকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করি, তখন প্লাটিলেট ছিল প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার। পরে কমতে কমতে ৪৪ হাজারে নেমে আসে। গত দুই দিন ধরে বেড়ে গতকাল ছিল ৯০ হাজার।

তিনি আরও বলেন, মারুফ যে মাদ্রাসায় থাকে, সেখানে খুব বেশি মশা নেই। তারপরও কীভাবে কী হয়ে গেলো কিছুই বুঝলাম না। প্রথমে জ্বর বেশি না থাকলেও পরে ১০৩/১০৪ তে ওঠে যায়। মাথাব্যথা, পুরো শরীর থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত ব্যথা ছিল। এখন কিছুটা ভালো।

বিপদ চিহ্ন থাকলেই হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ

চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গুর সবচেয়ে বড় লক্ষণ হচ্ছে অতিরিক্ত জ্বর থাকা। সাধারণত ১০৩ বা ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর উঠে যেতে পারে শিশুর। পাশাপাশি শিশুর শরীর ব্যথা থাকতে পারে। আরেকটি বড় লক্ষণ হচ্ছে, এই জ্বরে কোনও ধরনের ঠান্ডা লাগা কিংবা কাশি থাকবে না। জ্বরের পাশাপাশি বমি বমি ভাব, পাতলা পায়খানা থাকতে পারে শিশুর। জ্বর পরবর্তী সময়ে শরীরে লালচে র‍্যাশ ওঠাও ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, মাসখানেক ধরে দেখছি ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। সংখ্যাটি হয়ত গত বছরের মতো এখনও হয়নি, তারপরও প্রস্তুতি হিসেবে আমরা ডেঙ্গু কর্নার করে রেখেছি।

প্রচণ্ড জ্বর, পেট ব্যথা, বমিসহ বিপদ চিহ্ন থাকলেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, বাকিদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ এবং বাসায় নিয়ে কী করতে হবে, তা লিখে বাড়ি পাঠিয়ে দিই। তবে শিশুর প্রস্রাব কমে গেলে, শিশু নিস্তেজ হয়ে গেলে বা পানিশূন্যতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে আসার কথাও আমরা বলে দিই।

এ সময় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া শিশুকে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যাবে না বলেও মত দেন ডা. মাহমুদুল হক।

সারাদিনই থাকে ডেঙ্গু মশার প্রাদুর্ভাব, আক্রান্ত হয় সকল বয়সী মানুষই

ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, আগে যেমন চিন্তা করা হতো ডেঙ্গু মশা দিনের সুনির্দিষ্ট অংশে আক্রমণ করে এখন তেমনটি ঘটে না। সারাদিনই তাদের প্রাদুর্ভাব থাকে এবং সব বয়সী মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে। জ্বর হলেই প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে।

শিশুদের আক্রান্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যে সমস্যা হয়, তা হলো আবহাওয়াজনিত কারণে তাদের জ্বর ভাবটা সচরাচর লেগেই থাকে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে কি-না সেটা আসলে অনেকটাই অবহেলিত থেকে যায়। তাই জটিলতা দেখা দিলেই চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে বাচ্চার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আবার যেসব শিশু দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়, তাদের বিপদটা একটু বেশিই দেখা যায়।

তিনি বলেন, বাচ্চাদের চিকিৎসাটা তুলনামূলক ক্রিটিকাল। অন্যদের মতো বাচ্চাদের সব স্যালাইন দেওয়া যায় না, সুনির্দিষ্ট স্যালাইনের প্রয়োজন হয়। সেটি আবার বাজারে অনেক সময় পাওয়া যায় না। তাই তাদের ক্ষেত্রেই অধিকাংশ সময়ে দ্রুতই বিপত্তি ঘটে।

ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোগাবে ডেঙ্গু, অক্টোবরেই বেশি ভয়

জনস্বাস্থ্য ও কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালকে ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হয়। এই সময়ে বৃষ্টিপাত, বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা এডিস মশা প্রজননের জন্য উপযোগী হওয়া ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু বেশি হয়। 

তারা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি পুরোপুরি বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করছে। তবে পরিস্থিতি খুব বেশি ভালো হবে না এটা অনুমান করা যায়। এর তিন কারণ, এডিস মশা লার্ভার উপস্থিতি জানতে বর্ষা জরিপ হয়নি, এতে নিধন কার্যক্রম যথাযথ হয়নি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু রোগীর সঠিক তথ্য ও সংখ্যা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, আমাদের ফোরকাস্টিং মডেল (পূর্বাভাস) বলছে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ থাকবে। আক্রান্ত মৃত্যু দুটিই বাড়বে। এমনকি এ সংক্রমণটা আমাদের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোগাবে।

তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা ও বরিশালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েছে। অর্থাৎ এসব যে এলাকায় এডিস মশা ও রোগী আছে সেখানে ডেঙ্গু রোগী বাড়বে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, সিটি করপোরেশন গুলোকে মশক নিধনে কার্যকর বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কাজ হবে, রোগীর সঠিক তথ্য দেওয়া, রোগী ঠিকানা অনুযায়ী ২০০ মিটারের মধ্যে ক্রাশ কর্মসূচি করতে হবে। উড়ন্ত এডিস মশাগুলো ও লার্ভা ধ্বংস করতে হবে।

টিআই/এসকেডি