বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষার্থী আহসানুল হক দীপ্তর অবহেলাজনিত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের মারধরের অভিযোগে উঠেছে। এতে তিন চিকিৎসক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দোষীদের শনাক্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিলেও তার আগেই আজ (রোববার) সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন চিকিৎসকরা।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢামেকের এই হামলাকে কেন্দ্র করে নীরবে ‘অন্য খেলায়’ নেমেছেন স্বাচিপপন্থি চিকিৎসকরা। বিভিন্ন সোসাইটিকে কাজে লাগিয়ে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা বন্ধ করে চিকিৎকদের পথে নামানোই তাদের লক্ষ্য।

গতকাল শনিবার বিকেলের দিকে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) ঢুকে চিকিৎসকদের মারধরের অভিযোগ ওঠে একদল শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। এতে আহত হন হাসপাতালটির নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ইমরান, মাশরাফি ও জুবায়ের।

হামলার ঘটনায় রোববার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেই জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে কর্মবিরতিতে যান চিকিৎসকরা। যদিও এর আগে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দোষীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন তারা।

চিকিৎসকদের একটি পক্ষ বলছেন, চিকিৎসকদের ওপর হামলা সবসময়ই নিন্দনীয়। ঢামেকে যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা চাই। কিন্তু আমরা দেখছি একটি পক্ষ ঢামেকের ঘটনাকে ইস্যু করে হাসপাতাল ও দেশের পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে। গতকাল রাতেই যেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তাৎক্ষণিক বিবৃতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি জড়িতদের শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন, তারপরও কেন হঠাৎ করে দেশকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে, আমরা বুঝতে পারছি না। 

তারা বলছেন, যেখানে একদল চিকিৎসক-কর্মচারী ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দিয়েছেন, সেখান সকাল থেকেই শুনি আরেকদল কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এখন তারা সারা দেশের হাসপাতালগুলোকে ‘কমপ্লিট শাটডাউনে’র আহ্বান জানিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে চাইছে। আমি মনে করি এগুলো একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, এমনকি যারাই চিকিৎসক সমাজকে উসকানি দিচ্ছে, তাদের প্রত্যেকেই স্বাচিপপন্থি চিকিৎসক।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানি, কমপ্লিট শাটডাউনের আহ্বান

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাবনা মেডিকেল কলেজের নাক কান গলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও অধ্যাপক ডা. আহম্মদ তাউস (আহমেদ লিংকন) ঢাকা মেডিকেলের এই ঘটনায় ব্যাপক সরব ভূমিকা পালন করছেন। তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম অঙ্গসংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ স্বাচিপের সক্রিয় সদস্য হিসেবে পরিচিত। 

জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আহমেদ লিংকন নামধারী এই চিকিৎসকই সর্বপ্রথম ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকদের কমপ্লিট শাটডাউনের আহ্বান জানান এবং চিকিৎসকদের উদ্দেশে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দিতে থাকেন, যার একাধিক স্ক্রিনশট ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে।

এই চিকিৎসকই শুরুতে চিকিৎসকদের একটি প্রাইভেট গ্রুপে উসকানি দেওয়া শুরু করেন। এক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘ঘটনা যদি সত্য হয় (অজ্ঞতার কারণে বললাম), রেসিডেন্টকে মারতে মারতে পরিচালকের রুমে নিয়ে গেছে গুন্ডারা, প্লিজ শাটডাউন ডিএমসি। এর চেয়ে ভয়ংকর আর পেশার প্রতি অপমান কিছু হতে পারে না।’ 

ডা. আহম্মদ তাউসের এই স্ট্যাটাসের পরই একের পর এক প্রতিবাদ ও কর্মবিরতির ডাক আসতে শুরু করে।

শুধু পাবনা মেডিকেল কলেজের আহম্মদ তাউসই নয়, ঢামেকে বসেই নীরবে চিকিৎসা বন্ধের ডাক দিচ্ছেন ডা. এসএমএ এনফান নামে আরেক চিকিৎসক। তার ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘেটে দেখা যায় সেও একজন আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসক।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের আরেক চিকিৎসক ডা. রাশিদুল হক রানা। তিনি হাসপাতালটির সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। জানা গেছে, ঢামেকের ঘটনায় তিনিও পেছন থেকে চিকিৎসকদের চিকিৎসাসেবা ছেড়ে আন্দোলনে নামাতে বেশ ভূমিকা রাখছেন। চিকিৎসকদের বিভিন্ন গ্রুপগুলোতে বিভিন্ন স্ট্যাটাসের মাধ্যমে চিকিৎসক প্রটেকশন আইন প্রণয়নের দাবির পাশাপাশি চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছেন।

চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না : চিকিৎসকদের একপক্ষ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যারাই নানা ধরনের উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দিয়ে চিকিৎসকদের আন্দোলনে নামাতে চাইছে, তাদের প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের দালাল। যেখানে হাসনাত আবদুল্লাহ গতকাল রাতেই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছে এমনকি হামলাকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করারও আশ্বাস দিয়েছে, তারপরও এভাবে হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।

ডা. সারওয়ার জাহান নামে আরেক চিকিৎসক বলেন, আমরা মানসিক রোগ বহির্বিভাগে রোগী দেখছি। সকাল থেকেই আমাদের রোগী দেখা চলমান। আমরা হামলার ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, কিন্তু দেশের এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বন্ধ করার পক্ষে নই।

তবে ঢামেক কার্ডিওলজি বিভাগের এক চিকিৎসক জানান, ইতোমধ্যে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ শুরু হয়েছে। কার্ডিওলজির সিনিয়ররা সব কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। বাধ্য হয়ে আমাদেরও বন্ধ করতে হয়েছে। আমরা হাসপাতালে ডিউটি করতে এসেছি। কিন্তু চিকিৎসকদের ওপর এই ধরনের হামলা বা রোগীদের জিম্মি করে এমন আন্দোলনও সমর্থন করি না।

রোগীদের ভিড় বাড়ছে ঢামেকে, হতাশ হয়ে যাচ্ছেন অন্য হাসপাতালে

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আজ সকালে চিকিৎসকরা হাসপাতালে এসে কাজ শুরু করলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা হাসপাতাল ত্যাগ করেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জরুরি বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের কক্ষ বন্ধ করে দেন এবং জরুরি টিকিট কাউন্টারটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এতে সময় যত গড়াচ্ছে ঢামেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভিড় তত বাড়ছে। অনেকে হতাশ হয়ে অন্য হাসপাতালে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

মো. কবির হোসেন নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, ছোটভাইকে নিয়ে নরসিংদী হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে এসেছি। এখানে এসে দেখি টিকিট কাউন্টার বন্ধ। ডাক্তারদের রুমও সব বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তারা কর্মবিরতি পালন করছেন শুনে ভাইকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানেও ডাক্তাররা আছেন কি না জানি না।

চিকিৎসকদের কাছে আমরা লজ্জিত, যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে : হাসনাত

এসব প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ঢামেক হাসপাতালে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। রোগী মারা যাওয়ায় সংক্ষুব্ধ একটি পক্ষ এই হামলা চালিয়েছে। এ বিষয়ে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি। যেকোনো হাসপাতালে চিকিৎসকদের তাদের মতো করে কাজ করতে দেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, একটি বিষয়ে আমি আপনাদের স্পষ্ট করতে চাই, আমাদের গণঅভ্যুত্থানের যে মূল স্পিরিট ছিল, আমাদের গণঅভ্যুত্থানের যে জায়গাটি ছিল, সেই জায়গাটি ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে। একটি সিস্টেম ডেভেলপ করবে এবং এই সিস্টেমের মধ্য থেকে আমাদের সমাজ, আমাদের রাষ্ট্র, তথা আমাদের দেশ পরিচালিত হবে। এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে যে এই ধরনের কাজগুলো করা হচ্ছে, আজকে ডাক্তারদের ওপর অতর্কিত হামলা করা হলো।

হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আপনি যদি ফোর্স করেন যে আমার রোগীকে বাঁচিয়ে দিতে হবে, এখনই বাঁচিয়ে দিতে হবে, বাঁচিয়ে দিতেই হবে—এটা তো প্রফেশনালিজমের মধ্যে পড়ে না।

এই সমন্বয়ক আরও বলেন, আমি ঢাকা মেডিকেল ও ঢাকা মেডিকেলের বাইরের সব ডাক্তারদের কাছে এই বিষয়টি নিয়ে লজ্জিত। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলব, তারা যেন এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেন। আমি নিশ্চিত করতে চাই, ডাক্তাররা তাদের পেশাদারিত্বের জায়গায় তাদের নিজেদের মতো করে তাদের যে প্রফেশনালিজম, সেটি প্র্যাকটিস করতে পারবে।

এদিকে এ ঘটনায় স্বাচিপের একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদেরকে পাওয়া যায়নি। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের চিকিৎসকদের হাসপাতালে দেখা যায়নি।

টিআই/এমএ