ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের দায়িত্বে থাকা উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হকই ভয়ে-আতঙ্কে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না বলে সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, উপাচার্য সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে এসে অফিস করেন। সেদিনই দুপুর নাগাদ শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর আসে। এরপরই তিনি অফিস ত্যাগ করেন, আর ফেরেননি।

রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, প্রশাসনিক ভবনের ঠিক সামনেই যেন ধ্বংসস্তূপ। ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুড়ে যাওয়া পরিবহন বাস, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল। ভেতরে ঢুকেও দেখা যায় ভাঙচুরের নানা ক্ষতচিহ্ন।

উপাচার্যের রুমের গেটের সামনেই বসে ছিলেন কয়েকজন আনসার সদস্য। আশপাশে আন্দোলনকারী কেউ না থাকলেও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির অন্যতম এই কারখানাতে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসা কার্যক্রমসহ সব কিছুতেই তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা। হাসপাতালে সেবা নিতে আসা একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্ট প্রতিবেদকের। তারা জানান, মঙ্গলবার থেকে চিকিৎসা প্রায় নেই বললেই চলে। বাইরে সভা-সমাবেশ-চেঁচামেচি চলছে। এতে রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।

ভিসি না এলে আমরা কেন এসে ঝুঁকি নেব?

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, রেজিস্ট্রার, প্রায় ৩০টি বিভাগের চেয়ারম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে আসা সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সদস্য। তারা কেউই আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বি ব্লক, যা প্রশাসনিক ভবন নামে পরিচিত, সেখানে ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের ফটক তালাবদ্ধ রয়েছে।

এক সপ্তাহেও কেন কর্মস্থলে আসছেন না— এ প্রসঙ্গে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ভয়ে আসছেন না বলে জানান। তাদের দাবি, উপাচার্য নিজেও আসছেন না, ফলে কর্মস্থলে যাওয়া বন্ধ রেখেছি। সিনিয়র অন্যান্য কর্মকর্তারাও কয়েক দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন না। এমনকি কর্তৃপক্ষ থেকে তাদের কিছু জানানোও হচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানের প্রধানই যদি ভয়ে অফিসে না আসেন, তাহলে আমরা কীভাবে অফিসে আসব? তিনি বারবার আমাদের ফোন দিয়ে অফিসের খোঁজ নেন, তিনি আমাদের যেতে বলেন অথচ নিজে আসেন না। তাহলে আমরা কেন গিয়ে ঝুঁকি নেব?

উপাচার্য ফিরবেন নাকি পদত্যাগ করবেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যকে নিয়ে নানা কানাঘুষা চলছে। কেউ বলছেন, উপাচার্য খুব শিগগিরই পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। আবার কেউ বলছেন, নতুন দায়িত্ব নেওয়া সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিজ পদে টিকে থাকা এবং নির্ভয়ে অফিস শুরু করার জন্য নানা মাধ্যমে যোগাযোগ করছেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিসি স্যার দুটোর জন্যই প্রস্তুত। ওপর থেকে নির্দেশনা এলে তিনি কাজ শুরু করবেন। আবার যদি বিরোধী পক্ষ থেকে বেশি চাপ আসে, তাহলে তার পদত্যাগ করতেও দ্বিধা নেই।

এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে, উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হকের ব্যক্তিগত সহকারী মো. আমিনুল ইসলাম পলাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিসি স্যারের পদত্যাগের কোনো পরিকল্পনা নেই। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওনার ওপর পদত্যাগের কোনো চাপও নেই। দু-একদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে চান তিনি। আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্যার পদত্যাগ করবেন না। তবে, বিষয়টি এখন পুরোপুরি সরকারের ওপর নির্ভর করছে। স্যার তো আর বিএসএমএমইউ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি কিন্তু বিএসএমএমইউয়ে ছিলেনও না, তাকে বাইরে থেকে এনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদত্যাগের দাবি যে কেউ করতেই পারেন। তবে, বিষয়টা মন্ত্রণালয় দেখবে এবং রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেবেন।

উপপার্য দীন মো. নূরুল হকসহ অধিকাংশ কর্মকর্তা ভয়ে অফিসে না এলেও নিয়মিত অফিসে গিয়ে দৈনন্দিন কাজ করতে দেখা গেছে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমানকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি চেষ্টা করি সবসময় নিষ্ঠা ও সততার সাথে কাজ করতে। তাই আমার কোনো ভয় বা পিছুটান নেই। আমি নিয়মিত আসার চেষ্টা করছি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি যদি ভয়ে ঘরে বসে থাকি, তাহলে আমার চিকিৎসক-শিক্ষকরাও আসতে চাইবেন না। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার পাশাপাশি সেবাও ব্যাহত হবে।

নতুন সরকারের প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে ডা. আতিকুর রহমান আরও বলেন, ড. ইউনূসের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা রয়েছে। আমরাও ওনার প্রতি আস্থা রেখে কাজ করতে চাই। আমরা আশা করব তিনি চিকিৎসার পাশাপাশি গবেষণাকেও সমান গুরুত্ব দেবেন। কারণ, গবেষণা ছাড়া কোনোদিনই একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবা এগিয়ে যেতে পারে না। যতটুকু ওনাকে চিনি, তিনি নিশ্চয়ই আমাদের চিকিৎসাশিক্ষা ও গবেষণায় ভালো একটা ভূমিকা রাখবেন।

‘এভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না, দ্রুত পরিবর্তন চাই’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ছিলেন বিএনপি-জামায়াতপন্থি চিকিৎসকরা। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর এবার নড়েচড়ে বসেছেন তারা। এই চিকিৎসকদের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএসএমএমইউয়ের চিকিৎসক ডা. শামীম আহমেদ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত হাসপাতালের ভেতর কোনো বিশৃঙ্খলা করিনি। আমরা চাচ্ছি বর্তমান প্রশাসনে যারা দায়িত্ব আছেন, তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের এখানে নতুন করে ভিসিসহ ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে নিয়োগ দিতে হবে। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম সরকার গঠন হয়ে গেলে এই বিষয়ে নিশ্চয়ই স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত আসবে। এখন যেহেতু নতুন করে উপদেষ্টারা দায়িত্ব নিয়েছেন, আমরা চাইব অতি দ্রুত নতুন করে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হোক।

শামীম আহমেদ বলেন, আমাদের একাডেমিক কার্যক্রম বেশ কিছুদিন ধরে স্থবির হয়ে আছে। হাসপাতালের কার্যক্রম কিছুটা চললেও প্রশাসনিক কার্যক্রম কোনো কিছুই চলছে না। গত এক সপ্তাহ ধরে ভিসিসহ কেউই হাসপাতালে আসছেন না, এভাবে কি একটা বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে?

আপনাদের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক ভবনে তালা দেওয়া হয়েছে— এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা একদমই মিথ্যা অভিযোগ। বিএসএমএমইউয়ের কোথাও আমরা তালা দেইনি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আমাদের চিকিৎসক-কর্মচারীরা কোনো ধরনের ভাঙচুরও করেননি। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী মিছিল করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমরা দেইনি।  বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কিছুতেই আমরা হাত দিতে দেইনি। কারণ, দিন শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের। এতদিন যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়েছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-মর্যাদা ডুবিয়েছে। পদে পদে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির নানা খবর আপনারা পত্রিকাতেই ছাপিয়েছেন। এখন অতীতে যা কিছুই হয়েছে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নতুন করে গড়তে চাই। এজন্য বর্তমান ভিসিসহ প্রশাসনের সকল স্বৈরাচারের সহযোগীদের পদত্যাগ চাই।

বাধ্য হয়ে ‘বঞ্চিত’ ১৭৩ চিকিৎসককে পদোন্নতি

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত দৃশ্যপটে ১৭৩ চিকিৎসককে গতকাল পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে তারা দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। 

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি-জামায়াতপন্থি চিকিৎসকরা অনেকটা বাধ্য করেই রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল হান্নানকে নিয়ে উপাচার্যের বাসায় গিয়ে তাদের পদোন্নতিতে বাধ্য করেছেন।

এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পদোন্নতির আদেশটি কেবলমাত্র বঞ্চিত প্রার্থীদের জন্য, যারা জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ২০০৩-২০০৬ সাল পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগকৃত যেসব মেডিক্যাল অফিসার/গবেষণা সহকারীরা উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে নিম্নরূপ চিকিৎসকদের তাদের নামের পার্শ্বে বর্ণিত পদ ও বিভাগে নিম্নলিখিত শর্তে সহকারী অধ্যাপক/সহকারী অধ্যাপক (স্ববেতনে)/কনসালটেন্ট/কনসালটেন্ট (স্ববেতনে) নিয়োগ/পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

টিআই/এনএফ