মানুষের শরীরে যখন কোনো রোগ বাসা বাঁধে তখন সঙ্গে সঙ্গে জানা খুব কঠিন। বিশেষ করে কিডনিতে কোনো সমস্যা হলে তা আরও পরে জানা যায়। কেননা শরীরে যে অঙ্গেই ক্যানসার হোক, সেটি প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যথাহীন থাকে। তাই কেউ সন্দেহ করেন না। ফলে কিডনির ক্যানসার সহজে ধরা কঠিন।

কিডনি ক্যানসারের লক্ষণ 

কিডনি ক্যানসার কোনও লক্ষণের মাধ্যমে বোঝা যায় না। নারায়ণা হেলথ কলকাতার ইউরো অঙ্কোলজি ও রোবটিক সার্জারির সিনিয়র কনসালট্যান্ট চিকিৎসক সত্যদীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিডনির মধ্যে টিউমার ধরা পড়ে জেনারেল হেলথ চেক-আপের সময়। বছরে একবার বা দুবার অনেকে জেনারেল হেলথ চেক-আপ করাতে আসেন। সেই সময় আলট্রাসোনোগ্রাফি পরীক্ষা করতে দেওয়া হয় হোল অ্যাবডোমেনের (অর্থাৎ পুরো পেটের)। তখন কিডনির মধ্যে কোনও টিউমার কোশ থাকলে তা ধরা পড়ে।

কিডনির ক্যানসারের বেশিরভাগ সময়েই অ্যাসিম্পটোম্যাটিক বলে জানান চিকিৎসক সত্যদীপ। অর্থাৎ এই ক্যানসারের কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। তবে কয়েকটি লক্ষণ দেখা গেলেও যেতে পারে, তা হলো—

» প্রস্রাব দিয়ে রক্ত পড়া
» কোমর বা পেছনের দিকে ব্যথা করা যে ব্যথা সহজে কমে না।
» পায়ের দিকে এই ব্যথা ছড়াতে পারে।
» ফুলে যাওয়া ওই অংশ।
» খিদে কমে যাওয়া।
» ওজন কমতে থাকা।
» প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগতে থাকা।
» জ্বর আসা।

কোন বয়সে ধরা পড়ে কিডনি ক্যানসার?

চিকিৎসক অর্জুন রায় জানান, সাধারণত ৬০ থেকে ৮০ বছরের রোগীদের মধ্যেই কিডনি ক্যানসার বেশি ধরা পড়ে। তবে বর্তমানের স্ট্রেসে জর্জরিত জীবন। আর সেই কারণে অনেক কম বয়স যেমন ৪০-এর শুরুতেই কিডনি ক্যানসার দেখা যাচ্ছে অনেকের। ধূমপান, মদ্যপান ও অতিরিক্ত ওজনের কারণে কিডনি ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ে বলে জানান এ চিকিৎসক।

কিডনি ক্যানসারের কারণ

পরিবারে আগে কারও ক্যানসার হয়ে থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা অনেকগুণ বেড়ে যায়। তাই কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গ নিয়মিত চেকআপের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

কিছু বিশেষ ধরনের কিডনি ক্যানসার রয়েছে, যেগুলোর অঙ্কোজিন বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হয়। অর্থাৎ আগের প্রজন্মের মধ্যেও এই জিন থাকে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসক।

কিছুক্ষেত্রে ধূমপান কিডনিকে প্রভাবিত করে। ধূমপানের জন্য বেশ ফুসফুস ক্যানসার ছাড়াও বেশ কয়েকরকম ক্যানসার হয়। 

চিকিৎসক অর্জুন রায় জানান, অনেকের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে সিস্ট থাকে। থাকতে পারে কিডনির মধ্যেও। দেখা গেছে, এই সিস্টগুলো যখন বড় হয় (অর্থাৎ গ্রেড ২বি বা তার বেশি) তখন এই সিস্টগুলো ক্যানসারের টিউমারে বদলে যেতে পারে।

কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে অনেককে নিয়মিত ডায়ালিসিস নিতে হয়। চিকিৎসক অর্জুনের কথায়, অন্যদের তুলনায় এমন রোগীদের ৩০ শতাংশ বেশি ঝুঁকি কিডনি ক্যানসারের।

অতিরিক্ত ওজন বা ওবেসিটির কারণে অনেক ধরনের ক্যানসার বর্তমানে বেড়ে গেছে। এগুলোকে চিকিৎসকরা লাইফস্টাইল রিলেটেড ক্যানসার বলে চিহ্নিত করে থাকেন। 

যা করলে কমবে ঝুঁকি  

কিডনি ক্যানসার প্রাথমিক স্টেজে ধরা পড়লে পুরোপুরি সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়। ফলে আর্লি স্টেজ ডিটেকশন অন্যান্য ক্যানসারের মতো এই ক্যানসারের ক্ষেত্রেও খুব জরুরি।

তবে কিডনি ক্যানসার স্টেজ টু বা থ্রি-তে ধরা পড়লেও এর চিকিৎসা রয়েছে বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসক সত্যদীপ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ক্যানসার সারানোর জন্য বর্তমানে বেশ কিছু ভালো মানের ওষুধ বের হয়েছে। এছাড়াও, ইমিউনোথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপির মতো উন্নতমানের চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব। 

তারও পরবর্তী স্টেজে ক্যানসার ধরা পড়লে অস্ত্রোপচার বা সার্জারির কিছু ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা থাকে। সার্জারি বা অস্ত্রোপচার টিউমারের আকারের উপর নির্ভর করে। বড় টিউমার থাকলে পুরো কিডনিই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ছোট টিউমার হলে কিডনির ওই অংশটুকু বাদ দিয়ে বাকি কিডনি বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। 

সাধারণত ৪ সেন্টিমিটারের ছোট হলে এটি করা হয়। অন্যদিকে ৪ -৬ সেন্টিমিটার সাইজ হলে টিউমার সার্জারির সময় বেশ কিছু দিক দেখা হয়। যেমন রোগীর একটা কিডনি কি না, রেনাল ফেলিওর বা তেমন কোনও সমস্যায় ভুগছেন কি না। তার ভিত্তিতে কিডনি রেখে শুধু টিউমার বাদ দেওয়া হয়।

চিকিৎসক অর্জুন রায় বলেন, কিছু জীবনযাপনের অভ্যাসে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে ফেলা যায়।

» স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার খাওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা বিশেষভাবে জরুরি। কারণ অতিরিক্ত ওজন বা ওবেসিটির কারণে লাইফস্টাইল রিলেটেড ক্যানসার হতে পারে।

» সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন ৩০ মিনিট করে হলেও হাঁটার অভ্যাস ভালো। এর ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে ওবেসিটিজনিত কারণে কিডনির ক্যানসার হয় না।

» খাবারে অতিরিক্ত লবণ কিডনির জন্য ক্ষতিকর। এর উপর নিয়ন্ত্রণ এলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যার ফলে কিডনি সুস্থ থাকে। 

» প্যাকেটজাত খাবার সংরক্ষণের জন্য একটু বেশি লবণ মেশানো হয়। যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। পাশাপাশি এগুলো প্রসেসড ফুড। তাই কিডনির জন্য আরও ক্ষতিকর।

এমএসএ