ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হৃদরোগ বিষয়ক কার্ডিওলজিস্টদের কনফারেন্সে দূর নিয়ন্ত্রিত রোবটের মাধ্যমে হার্টের ধমনীতে রিং পরানোর অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিটউ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার। এ সময় বিদেশি ফ্যাকাল্টি ও প্যানেলিস্টরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

বুধবার (১৫ মে) ফ্রান্সের প্যারিসে ইউরোপিয়ান কার্ডিওভাস্কুলার রিসার্চ সেন্টার আয়োজিত ইউরো পিসিআর কনফারেন্সে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে রিং পরানোর অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেন ডা. প্রদীপ কুমার। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ছাড়াও ফ্রান্স ও আমেরিকার প্রতিনিধিরা তাদের অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেন।

বিশ্ব মঞ্চে অভিজ্ঞতা উপস্থাপন প্রসঙ্গে ডা. প্রদীপ কুমার বলেন, বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে ইন্ডিয়া ও চীনের পর তৃতীয় দেশ যারা এই ধরনের উচ্চ প্রযুক্তিসস্পন্ন দূর নিয়ন্ত্রিত রোবটের মাধ্যমে হার্টের ধমনীতে রিং পরানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। প্যারিস কনফারেন্সে এই ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। এমনকি বিদেশি চিকিৎসকদের মধ্যে বাংলাদেশে সম্পর্কে একটি উচ্চ ধারণা জন্ম নিয়েছে।

তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে মূল অপারেটর হাসপাতালের যেকোনো স্থান থেকে, এমনকি হাসপাতালের বাইরে থেকেও এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে রোগীদের রিং পরানোর প্রক্রিয়াটি সম্পাদন করতে পারেন। রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি বা রোবট দিয়ে হার্টের রিং পরানোর তিন ধরনের সুবিধা আছে। একটি হলো রোগীর জন্য সুবিধা, আরেকটি হলো কার্ডিওলজিস্ট যিনি রিং পরান তার জন্য সুবিধা এবং তৃতীয়টি হলো দেশের জন্য সুবিধা। রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির প্রথম সুবিধা হলো হার্টের রিং পরানোর জটিল প্রক্রিয়াটি রোবটের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে করা যায়। অনেক সময় হার্টের রিং নিখুঁতভাবে পজিশন করার জন্য এক মিলিমিটার সামনে অথবা এক মিলিমিটার পেছনে নেওয়ার প্রয়োজন হয় কিন্তু হাত দিয়ে করলে নিখুঁতভাবে এই কাজটি করা কঠিন হয় কিন্তু রোবটের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে এটি সম্পন্ন করা যায়।

ডা. প্রদীপ কুমার বলেন, রোগীদের জন্য আরেকটি সুবিধা হলো হৃদরোগ চিকিৎসকরা সরাসরি এনজিওপ্লাস্টি করতে গেলে যে সময় লাগে রোবটের মাধ্যমে সেটি করতে অনেক কম সময় লাগে। যে কারণে অল্প সময়ে বেশি রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া যায়। হার্টের ভেতরে ক্যাথেটার, ওয়্যার (তার), বেলুন, রিং যত কম সময় রাখা যায় রোগীর জন্য তত নিরাপদ তাই রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রিং পরাতে সময় কম লাগে বলে জটিলতা ও কম হয়।

হৃদরোগ হাসপাতালের এই চিকিৎসক আরও বলেন, দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অত্যাধুনিক এই চিকিৎসা প্রযুক্তি চালু হলে রোগীকে আর দেশের বাইরে যেতে হবে না। রোবটিক চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর অসংখ্য লোক ভারত, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। আমরা যদি সেবাটি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পরিপূর্ণভাবে চালু করতে পারি তাহলে খুব কম খরচে রোগীদের এই সেবা দেওয়া যাবে এবং এর মাধ্যমে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং অনেক বড় অংকর একটি অর্থ দেশে থেকে যাবে।

জানা গেছে, গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁ থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিটউ ও হাসপাতালে সিদ্দিক (৭২) নামে এক রোগীর হার্টের মূল রক্তনালীতে দূরনিয়ন্ত্রিত রোবটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২টি রিং স্থাপন করেন ডা. প্রদীপ। এ সময় রোগী ছিলেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ক্যাথল্যাবে। পুরো অপারেশন প্রক্রিয়াটি উদ্বোধন ও প্রত্যক্ষ করেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দিন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দূর নিয়ন্ত্রিত রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির এই প্রক্রিয়ায় রোবটের একটি হাত থাকে ক্যাথল্যাবে। আরেকটি থাকে কন্ট্রোল সেকশন যা মূল কার্ডিওলজিস্টের কাছে, সেখানে আবার ৩টি মনিটর থাকে। এর মধ্যে ১টি দিয়ে রিং পরানো প্রক্রিয়া রিয়েল টাইমে প্রত্যক্ষ করা হয়, দ্বিতীয়টি দিয়ে রোগীর ব্লাড প্রেসার, পালস , অক্সিজেন স্যাচুরেশন ও ইসিজি দেখার মাধ্যমে রোগীর রিং পরানোকালীন সময়ের রোগীর শারীরিক অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। আর তৃতীয়টি দিয়ে ক্যাথল্যাবে অবস্থিত টিমের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হয়।

প্রসঙ্গত, ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার ভারতের হায়দ্রাবাদের এপোলো হসপিটাল এবং চীনের সাংহাই থেকে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্ট এর উপরে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাছাড়া ডাক্তার প্রদীপ কুমার কর্মকার রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টিতে ভারতের প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডাক্তার পিসি রাথের কাছ থেকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

টিআই/এসকেডি