রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। অসহনীয় গরমে নাকাল মানুষ, স্বস্তি মিলছে না কোথাও। তীব্র গরমে সবচেয়ে বেশি অসহায় হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। একদিকে রোগের কারণে শারীরে যন্ত্রণা, অন্যদিকে চিকিৎসা নিতে এসে গরমের মধ্যে আউটডোর-প্যাথলজিতে লম্বা লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন রোগীরা।

রোববার (২১ এপ্রিল) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটডোর-প্যাথলজি ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনের প্রবেশপথ থেকে শুরু করে হাসপাতালের বিভিন্ন ফ্লোরে রোগী ও তাদের সঙ্গে আসা স্বজনদের ভিড়। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে রোগী ও স্বজনদের কেউ মুছছেন কপালের ঘাম, আবার কেউ হাতে থাকা চিকিৎসাপত্র দিয়ে গায়ে লাগাচ্ছেন বাতাস।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটডোরের নিয়মিত চিত্র হলো, একজন রোগীকে হাসপাতালে আসার পর শুরুতে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট কাটতে হয়। এরপর ডাক্তার দেখানো, ডাক্তারের পরামর্শে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে নমুনা দেওয়ার জন্য আবারও সিরিয়ালে দাঁড়াতে হয়। পুরো প্রক্রিয়া রীতিমতো যুদ্ধের মতো। এখানেই শেষ নয়, পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর পরীক্ষার রিপোর্ট সংগ্রহের জন্যও নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয় তাদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটডোরের ১ নম্বর ভবনে লাইনে দাঁড়ানো আরিফুর রহমান বাবাকে নিয়ে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে এসেছেন। তিনি জানান, গত কয়েক দিন ধরে তার বাবার জ্বর। পরীক্ষায় ইউরিন ইনফেকশন ধরা পড়েছে। তাই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছেন তিনি। বাবাকে হাসপাতালের বারান্দায় চেয়ারে বসিয়ে ৩০ মিনিটের বেশি সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

আরিফুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যেকটা জায়গায়ই লম্বা সিরিয়াল। আমি না হয় সুস্থ মানুষ, গরমে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিন্তু আমার রোগীর অবস্থা তো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সামনে দাঁড়ানো এতগুলো মানুষ পার হয়ে চাইলেও দ্রুত ডাক্তার দেখাতে পারছি না। ভেতরে কয়েকটা জায়গায় এসি থাকলেও এসির বাতাসও গরম হয়ে গেছে। সবদিক থেকেই দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। অথচ এ রকম একটা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা আর রিপোর্ট নেওয়াটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে আসা মনোয়ার হোসেন বলেন, এখানে চিকিৎসা ভালো। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মানও ভালো। তবে রোগীর ভিড় বেশি হওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গরমের কষ্ট। সবদিক থেকে আবদ্ধ রুম, কোনো দিক দিয়ে বাতাস ঢুকতে পারে না, ভেতরের গরমও বের হতে পারে না। সবমিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা। কিন্তু কিছুই তো করার নেই।

তিনি বলেন, আমি নিজে পেট ব্যথার রোগী, তারপরও অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কেউ কেউ বেশি টাকা খরচ করে স্টাফ সিরিয়ালে আনসার ও হাসপাতালের কর্মচারীদের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। সুযোগ বুঝে কারও কাছ থেকে ১০০ টাকা, কারও কাছ থেকে ২০০ টাকাও নিচ্ছে তারা। মানুষ কী করবে? গরমে কতক্ষণ রোগী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? এখানে তো রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত বসারও জায়গা নেই।

লম্বা লাইন ধরে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে টিকিট কেটে ডাক্তার দেখাতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে রাজধানীর মিরপুর থেকে আসা ফরিদা ইয়াসমিনের। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, স্থানীয় ডাক্তার বলেছে, পিজির (বিএসএমএমইউ) আউটডোরে ভালো ডাক্তার আছে। তার পরামর্শেই এখানে এসেছি। সকাল ৯টায় এসে ডাক্তার দেখাতে ১১টার বেশি বেজেছে। যাদের মামা-চাচা আছে, তারা ঠিকই স্টাফদের জন্য নির্ধারিত সিরিয়ালে গিয়ে টিকিট নিয়ে যাচ্ছে।

ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল কিন্তু গরমের কারণে সাহস করতে পারছিলাম না। অবশেষে বাধ্য হয়েই আজ আসতে হলো। শেষ পর্যন্ত তীব্র গরমের মধ্যে দুই ঘণ্টায় ডাক্তার দেখাতে পারলাম।

রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অন্যতম ভরসাস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএসএমএমইউ আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার রোগীকে সেবা দেওয়া হয়। কাজেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ডাক্তার-নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা খুবই ব্যস্ত সময় কাটান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটডোরের নিয়মিত চিত্র হলো, একজন রোগীকে হাসপাতালে আসার পর শুরুতে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট কাটতে হয়। এরপর ডাক্তার দেখানো, ডাক্তারের পরামর্শে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে নমুনা দেওয়ার জন্য আবারও সিরিয়ালে দাঁড়াতে হয়। পুরো প্রক্রিয়া রীতিমতো যুদ্ধের মতো। এখানেই শেষ নয়, পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর পরীক্ষার রিপোর্ট সংগ্রহের জন্যও নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয় তাদের।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে একাধিক রোগী জানান, বিএসএমএমইউ আউটডোরে রোগীদের জন্য সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা বিএসএমএমইউ কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য রাখা পৃথক কাউন্টার। এক শ্রেণির কর্মচারী টাকার বিনিময়ে সাধারণ রোগীদের আত্মীয় বানিয়ে সেই কাউন্টারে গিয়ে আগে কাজ করিয়ে নেন। যার ফলে ওই কাউন্টারে ভিড় লেগেই থাকে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই সাধারণ রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বজনদের তর্ক-বিতর্ক এমনকি হাতাহাতিরও ঘটনা ঘটে।

আউটডোরে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার রোগীকে আমাদের সেবা দিতে হয়। যে কারণে আমাদের মাথা সবসময় গরম থাকে। এদিকে তীব্র গরমের কারণে রোগী ও তাদের স্বজনরাও এক রকম উত্তেজিত থাকেন। সব মিলিয়ে প্রতিনিয়তই কিছু বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।

তিনি বলেন, গরমটা যেহেতু বেশি, একটু দুর্ভোগ তো হবেই। আউটডোর এবং প্যাথলজি বিভাগ সব জায়গাতেই এসি এবং ফ্যান লাগানো আছে। মাঝেমধ্যে সমস্যা রেখে দিলে বন্ধ থাকে, তখনই একটু বেশি সমস্যা হয়। এছাড়া খুব বেশি সমস্যা আমাদের হয় না।

এদিকে আউটডোর-প্যাথলজিতে রোগীদের দুর্ভোগ প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত কিছুদিন ধরে সারা দেশে গরম একটু বেশি। যে কারণে চিকিৎসা নিতে এবং দিতে একটু সমস্যা হচ্ছে। আমাদের প্রতিটি ডিপার্টমেন্টেই পর্যাপ্ত ফ্যান এবং এসি লাগানো আছে। তবে আউটডোরে যেহেতু একসঙ্গে হাজার হাজার রোগী এবং স্বজন অবস্থান করেন, সেখানে গরম একটু বেশি লাগাটাও স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় একটা নামকরা প্রতিষ্ঠান। এখানে সারা দেশ থেকেই অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আউটডোর, ইমারজেন্সিসহ পুরো হাসপাতালেই রোগীদের প্রচণ্ড ভিড় থাকে। আমাদের এখানে প্রচুর রেফার্ড পেশেন্ট থাকে। প্রায় প্রতিদিনই আমার কাছে কেবিন, আইসিইউর জন্য ফোন আসে। আমরা হয়ত সবার চাহিদা পূরণ করতে পারি না। বর্তমানে আমাদের যে আইসিইউ-সিসিইউ আছে, সেটাকে ডাবল করে ফেললেও হয়ত মানুষের চাহিদা শেষ হবে না।

উপাচার্য বলেন, রোগীদের কষ্ট লাগাবে আমরা আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। একজন রোগী কোন ডিপার্টমেন্টে যাবে সেটা যদি আমরা আগেই নির্ধারণ করে দিতে পারি, তাহলে রোগীদের দুর্ভোগ অনেকটা কমে যাবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা প্রশাসনিক মিটিংয়ে আলোচনা করেছি। আশা করছি, শিগগিরই রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারব।

গরমে রোগীদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, গরমের সময় শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি বের হয়ে যায়। তাই প্রত্যেকের উচিত পানিশূন্যতা পূরণে বেশি পরিমাণ পানি পান করা। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মানুষ যেন ঘর থেকে বের না হয়। গরমে ডিহাইড্রেশন যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা। শরীর থেকে বেশি পরিমাণ পানি ও লবণ বের হয়ে গেলেই ডিহাইড্রেশন বেশি হয়। এজন্য তীব্র গরমে আমরা লেবুর শরবত, ডাবের পানি খেতে পারি।

টিআই/এসকেডি