বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে। ব্যস্ততম রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন সমস্যা এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে, যা শহরে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধিকে প্রভাবিত করছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে, ঢাকা শহরের নাগরিকরা নর্দমা, পানি নিষ্কাশন, বন্যা এবং বিভিন্ন দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়।

রাজধানী ঢাকায় দৈনিক পানির চাহিদা ২৬০-২৬৫ কোটি লিটার। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার দৈনিক পানি উৎপাদন সক্ষমতা ২৭৫-২৮০ কোটি লিটার। তবে গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমে পানির চাহিদার তারতম্য হয়ে থাকে। ঢাকা ওয়াসার বর্তমান দৈনিক পানি উৎপাদন সক্ষমতা ২৭৫-২৮০ কোটি লিটার।

দ্রুত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে ঢাকার বিদ্যমান পানির অবকাঠামো ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে। তাছাড়া ঢাকার জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। বস্তিতে পানির সংকট ঢাকা শহরের একটি গুরুতর সমস্যা। নীতি প্রণয়ন ও পরিকল্পনার সময় কর্তৃপক্ষ প্রায়ই বিষয়টি ভুলে যায়। জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রায়শই দূষিত পানির উৎসের উপর নির্ভর করে, যা পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। উন্মুক্ত পরিবেশে মলত্যাগ এবং অনুপযুক্ত বর্জ্য নিষ্কাশন পানি উৎসগুলোর দূষণের জন্য দায়ী। সঠিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার অভাব জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকার দুর্বল ও পুরানো নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং মাঝারি বৃষ্টিপাত নিম্ন উচ্চতার বস্তি এলাকায় আকস্মিক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। তাই ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তনের পরিস্থিতির সাথে স্বল্প ব্যবধানে ভারী বৃষ্টিপাত এবং বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি ঢাকা শহরের পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতার সাথে তুলনা করার জন্য একটি পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, ২১ মিলিয়ন মানুষ ১,০০০ বর্গমিটার এলাকার মধ্যে বসবাস করবে। ২০২৫ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের আয়তন অতিরিক্ত জনসংখ্যার বৃদ্ধি কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বস্তি এলাকায় কিছু পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প স্থানীয় এনজিও দ্বারা পরিচালিত হয়। সম্প্রতি, বস্তি উচ্ছেদ টেকসই উন্নয়নের আরেকটি বাধা। সামগ্রিকভাবে পরিবেশগত পরিস্থিতি, বর্ধিত দূষণ, নিম্ন আয়ের এলাকার সামগ্রিক পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা সমস্যায় আরেকটি স্তর যুক্ত করছে।

ঢাকা মেগাসিটি : অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ পানি নিরাপত্তার স্তর কতটা ভেঙে দিচ্ছে?

টেকসই সমাধান বাস্তবায়নে বিভিন্ন সংগঠন সহযোগিতা করে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রচেষ্টা চলছে। সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সচেতনতা বাড়াতে এবং স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলনের প্রচার করতে একসাথে কাজ করছে। ঢাকার পানি নিষ্কাশনের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের মাধ্যমে এ দুর্যোগের মোকাবিলা করেছে।

ঢাকা ওয়াসার বিশেষ কাজ হলো নিরাপদ ও পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা, শিল্প এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে স্যানিটেশন এবং ভাল স্বাস্থ্যকর অবস্থা নিশ্চিত করতে গার্হস্থ্য এবং অন্যান্য পয়োনিষ্কাশনের যথাযথ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা এবং ঢাকা শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দ্রুত বর্ধনশীল ঢাকা শহরের সেবায় ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহ এবং পয়োনিষ্কাশন প্রদানের সময় অসংখ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। যেমন- ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়া, পর্যাপ্ত পরিমাণে খাল ও নদী-নালার অভাব, ঢাকা শহরের ঘনবসতি ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, ভূ-উপরিস্থ পানি কলকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের মাধ্যমে ব্যবহার অনুপযোগী হওয়া, নগরবাসী কর্তৃক অবৈধ পানি ব্যবহার প্রবণতা।

২০১১ সাল থেকে এটি প্রতি বছর সপ্তাহে সাত দিন ২৪ ঘণ্টা প্রতিনিয়ত পানি সরবরাহ করে এবং আয় বৃদ্ধি করে খরচ আরও কমিয়ে আনে। এতে পানি অপচয় ২০০৩ সালে ৫৩% থেকে ২০১০ সালে ২৯% হ্রাস পায়। এ অর্জনের জন্য ঢাকা ওয়াসা বার্লিনে গ্লোবাল ওয়াটার সামিট ২০১১ সালে "বছরের সেরা পারফরমার" অর্জন করেছে। ভবিষ্যতে ঢাকা ওয়াসা নগর থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে কম দূষিত নদী থেকে শোধিত পানির সঙ্গে স্থল ভূগর্ভস্থ পানি প্রতিস্থাপনের জন্য বিশাল বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে। এছাড়া ঢাকা ওয়াসার বিগত বছরের অর্জন হচ্ছে- ১০০% অনলাইন বিলিং সিস্টেম চালু, গ্রিন ওয়াসা সিস্টেম দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করা, ১৮২টি বুথ স্থাপনের মাধ্যমে পানির সরবরাহ চলমান রাখা এবং SCADA স্থাপনের মাধ্যমে পাম্পসমূহ পরিচালনা করা।

২০১১ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউক শহরের বাড়িগুলোতে পানি ঘাটতি এবং বন্যা হ্রাসের জন্য বৃষ্টির পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা করে। আরও একটি মূল উদ্যোগ হলো পানি শোধনাগারের উন্নয়ন এবং উন্নতমানের পানি নিষ্কাশন করা, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে পরিবারগুলোতে সরবরাহ করা পানি আন্তর্জাতিক মান পূরণ করে। একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ কমাতে পয়োনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং আধুনিক বর্জ্য পরিশোধন সুবিধা নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

এ উদ্যোগের সাফল্যে জনসাধারণরে সম্পৃক্ততা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক পয়োনিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনসাধারণ তাদের পানি সম্পদের মালিকানা নেওয়ার জন্য একটি টেকসই পদ্ধতি অনুসরণ করেন।

এ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অনেক কিছু করা বাকি আছে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং পানির অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগকে ত্বরান্বিত করতে হবে, যাতে সুবিধাগুলো ঢাকা শহরের সব কোনায় পৌঁছে যায়। উপরন্তু, চলমান পর্যবেক্ষণ এবং উদীয়মান সমস্যাগুলো অবিলম্বে মোকাবিলা করার জন্য চলমান পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি স্থাপন করা উচিত।

ঢাকায় পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা একটি জটিল কিন্তু অপরিহার্য কাজ যার জন্য সকল অংশীদারের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একটি স্বাস্থ্যকর এবং আরও স্থিতিস্থাপক শহরে অবদানে প্রতিটি বাসিন্দার জন্য পরিষ্কার এবং নিরাপদ পানির উপলব্ধি রয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য একটি ব্যাপক এবং টেকসই পদ্ধতি থাকা গুরুত্বপূর্ণ। 

লেখক : ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা; দীপ্ত সাহা, হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসার, এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট