মাসে ওষুধ কেনার খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ
কোর্স শেষ না করেই ওষুধ ছাড়ছেন অনেকে
দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস আর হার্টের সমস্যায় ভুগছেন বেসরকারি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলাম। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ইউরিন ইনফেকশন। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসা নিতে এসেছেন তিনি। চিকিৎসকরা জানান, রক্তের ইনফেকশন ছড়িয়েছে কিডনিতে। ফলে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিডনিও। এর আগে প্রতি মাসে ওষুধের পেছনে তার খরচ হতো চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। সেখানে এখন খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট হাজার টাকায়। নতুন করে যুক্ত হয়েছে রক্ত, ইউরিন ও কিডনি ইনফেকশনের ওষুধ।
চিকিৎসা ও ওষুধে খরচ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম বলেন, যখন পাঁচ হাজার টাকার ওষুধ লাগত, তখন বিভিন্ন খাতের ব্যয় সংকোচন করে ওষুধগুলো নিয়মিত খেতাম। কিন্তু দিনদিন ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েছি। এখন যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন ওষুধ। মনে হচ্ছে, ওষুধ খাওয়াই বাদ দিয়ে দিই!
বিজ্ঞাপন
গত দুই মাসে অন্তত ৫০ ধরনের ওষুধের দাম পাঁচ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট, ডায়াবেটিকস রোগীদের ইনসুলিন ও ইনজেকশনের দাম। এ ছাড়া হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, ভিটামিন ও হাঁপানিসহ বিভিন্ন ওষুধের প্রতি পিসের দাম ৫০ পয়সা থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাদ যায়নি জ্বর-সর্দির ট্যাবলেট-ক্যাপসুল, বিভিন্ন অসুখের সিরাপও
বিএসএমএমইউয়ের কিডনি ওয়ার্ডে ভর্তি মনির উদ্দিন। কিডনি আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা নেওয়া শুরু করেছেন তিনি। মাঝখানে ওষুধ ও চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে সমস্যা আরও জটিল হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কিডনির সমস্যা জটিল হওয়ায় চিকিৎসকরা বলেছেন নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে। মাঝখানে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ায় এখন বড় সমস্যায় পড়েছি।
মনির উদ্দিন প্রশ্ন রেখে বলেন, কিডনি রোগের ওষুধের যে দাম, বন্ধ না করে কোনো উপায় আছে? টানা ১০-১৫ দিন বা এক মাস না হয় ম্যানেজ করে খেলাম, কিন্তু মাসের পর মাস তো সম্ভব না। এর মধ্যে কিছুদিন পরপর শুনি ওষুধের দাম বাড়ছে। ওষুধ বন্ধ না করে আমাদের আর কোনো উপায় আছে? পেট চলে না, ওষুধ কিনব কীভাবে?
লাগামহীন ওষুধের দামের কারণে শুধু সিরাজুল ইসলাম আর মনির উদ্দিনই নন, দেশব্যাপী এমন হাজারও রোগী আছেন যারা বেশি দাম দিয়ে ওষুধ কিনতে কিনতে এখন প্রায় দিশেহারা। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক জরিপ অনুযায়ী, চিকিৎসা-ব্যয়ের ৬৪ শতাংশই এখন ওষুধের পেছনে খরচ হচ্ছে।
আরও পড়ুন
দুই মাসে বেড়েছে ৫০ ধরনের ওষুধের দাম
রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে দেখা গেছে, গত দুই মাসে অন্তত ৫০ ধরনের ওষুধের দাম পাঁচ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট, ডায়াবেটিকস রোগীদের ইনসুলিন ও ইনজেকশনের দাম। এ ছাড়া হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, ভিটামিন ও হাঁপানিসহ বিভিন্ন ওষুধের প্রতি পিসের দাম ৫০ পয়সা থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাদ যায়নি জ্বর-সর্দির ট্যাবলেট-ক্যাপসুল, বিভিন্ন অসুখের সিরাপও।
জানা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ওষুধের একটি হলো অ্যারিস্টোফার্মা লিমিটেডের অ্যাংকর প্লাস ট্যাবলেট (বিসোপ্রোলল ফিউমারেট ও হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড)। বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২.২৫ মিলিগ্রাম ও ৬.২৫ মিলিগ্রাম মাত্রার প্রতিটি বড়ির (ট্যাবলেট) দাম গত ডিসেম্বরে ছিল ছয় টাকা, বর্তমানে তা হয়েছে নয় টাকা। অ্যারিস্টোফার্মার হাইপারটেনশন রোগের আরেকটি ওষুধ ডুওব্লক ৫/৪০ মিলিগ্রাম। মাসখানেক আগেও প্রতিটি বড়ির দাম ছিল ১৯ টাকা। সেটি বাড়িয়ে এখন ২১ টাকা করা হয়েছে।
এ ছাড়া, হৃদরোগ ও অ্যানজাইনা পেক্টোরিস বা করোনারি ধমনির জটিলতায় ব্যবহৃত নাইট্রোকার্ড (২.৬ মিলিগ্রাম) বড়ির দাম পাঁচ টাকা থেকে করা হয়েছে সাত টাকা। টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত লিনাগ্লিপ এম (২.৫/৮৫০ মিলিগ্রাম) বড়ির দাম ১২ টাকা থেকে ১৬ টাকা, গ্লুভান প্লাস (৫০০ মিলিগ্রাম) ২১ থেকে ২৪ টাকা, ইম্পাগ্লিপ (১০ মিলিগ্রাম) ২৫ থেকে ৩০ টাকা, ইম্পাগ্লিপ (২৫ মিলিগ্রাম) ৪০ থেকে ৫০ টাকা এবং লিম্পা (৫/২০ মিলিগ্রাম) ৪০ থেকে ৫০ টাকা করা হয়েছে।
কেন দাম বাড়ছে, জানেন না বিক্রেতা-কোম্পানি প্রতিনিধিরা
বিএসএমএমইউ গেট সংলগ্ন ইত্যাদি মেডিসিন সেন্টারের বিক্রয়কর্মী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, গত ২০ জানুয়ারি অ্যারিস্টোফার্মা লিমিটেড দাম বাড়ানোর জন্য ১২টি ওষুধের তালিকা দিয়েছে। ২১ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এভাবে অন্যান্য কোম্পানির ওষুধের দামও বাড়বে। কিন্তু হঠাৎ করে কেন তারা ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে, আমাদের কিছুই জানায়নি।
তিনি বলেন, দাম নিয়ে কোম্পানিগুলোকে জিজ্ঞাসা করারও কোনো সুযোগ থাকে না আমাদের। আবার জিজ্ঞাসা করলেও তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারে না। তারা বলে, উপরের স্যারেরা জানেন। অনেক সময় আমরাও জানি না কোন কোন ওষুধের দাম বেড়েছে। যে কারণে আগের দামেই আমাদের বিক্রি করতে হয়।
১৯৮২ সালের ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১১ (১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, সরকার অফিসিয়াল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। অথচ এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে ২০২২ সালে কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়া শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলোর সুপারিশে ২০টি জেনেরিকের (শ্রেণিগত বা জাতীয়) ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয় ঔষধ প্রশাসন। সে সময় প্যারাসিটামল, হৃদরোগ, ব্যথানাশক ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের দাম ৫০ থেকে ১৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সেই দাম বাড়ার রেশ না কাটতেই গত বছরের মে মাসে আবার শীর্ষ ছয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ২৩৪টি জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এরপর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় ওষুধের দাম
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার হেলথ কেয়ার নামক ফার্মেসির বিক্রেতা অমল দেবনাথ বলেন, ইদানীং ওষুধ কোম্পানিগুলো হুটহাট দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা আমরাও জানতে পারছি না। দেখা গেছে আমরা ওষুধের পুরাতন প্যাকেটগুলো বিক্রি করছি, এর সাথে নতুন প্যাকেট এসে যুক্ত হচ্ছে। যেটা খেয়ালও করা যায় না। যে কারণে নতুন প্যাকেটগুলো পুরাতন দামেই বিক্রি করে দিচ্ছি। এভাবে কয়েক প্যাকেট বিক্রির পর হঠাৎ চোখ পড়ে ওষুধের নতুন দাম। তখন নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে সমন্বয় করতে হয়।
আরও পড়ুন
‘ওমিপ্রাজল ওষুধের দাম ছিল পাঁচ টাকা (প্রতি পিস), এক পাতা ৫০ টাকা। সম্প্রতি দাম বেড়ে প্রতি পিস ছয় টাকা হয়েছে, যা ইনভয়েস (চালান) দেখার পর বুঝতে পেরেছি। অলরেডি আমি পাঁচ টাকা দরেই অনেকগুলো বিক্রি করে দিয়েছি। কিছুদিন পরপর দাম বাড়লে সেভাবে খেয়াল করা যায় না। সবসময় চালানও দেখা হয় না। তাই ভুল করে আগের দামে বিক্রি করে দিই।’
নিয়মের তোয়াক্কা করছে না খোদ ঔষধ প্রশাসন
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি এসেনশিয়াল ড্রাগের (জীবনরক্ষাকারী ওষুধ) ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় আছে ২১৯টি। এর মধ্যে ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্যান্য ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। অথচ একসময় দুইশর বেশি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার। কিন্তু সেই সংখ্যা এখন আরও কমে গেছে।
আরও পড়ুন
১৯৮২ সালের ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১১ (১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, সরকার অফিসিয়াল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। অথচ এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে ২০২২ সালে কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়া শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলোর সুপারিশে ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয় ঔষধ প্রশাসন। সে সময় প্যারাসিটামল, হৃদরোগ, ব্যথানাশক ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের দাম ৫০ থেকে ১৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
সেই দাম বাড়ার রেশ না কাটতেই গত বছরের মে মাসে আবার শীর্ষ ছয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ২৩৪টি জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এরপর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় ওষুধের দাম।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত বছরের মে মাসে দেশের শীর্ষস্থানীয় ছয়টি প্রতিষ্ঠানের তৈরি ২৩৪টি জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে, এর কোনো প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেনি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দাম বাড়ানো হচ্ছে : আবু জামিল ফয়সাল
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল ওষুধের দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইদানীং বেশকিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। কিছুদিন আগেও ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। মূল বিষয় হচ্ছে, ওষুধের দামটা কীভাবে বাড়ে, কী কারণে বাড়ে, সেটা কেউই জানে না। কোম্পানিগুলো সবসময় বলে, র-মেটেরিয়ালস (কাঁচামাল) আনতে আমাদের বেশি দাম দেওয়া লাগে। কিন্তু আমি যতটুকু জানি, এসব র-মেটেরিয়ালস তো কোম্পানিগুলো বছরে একবারই নিয়ে আসে। যে কারণে দুই/তিন মাস পর তো এ কারণে দাম বাড়ানোর কথা নয়। তারা তো তাদের কর্মচারীদের বেতনও তিন মাস পরপর বাড়ায় না। তাহলে কিছুদিন পরপর কেন ওষুধের দাম বাড়বে?
‘আমরা স্পষ্ট দেখছি যে, কোম্পানিগুলো কোনো রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দাম বাড়াচ্ছে। কিছুদিন পরপর এই যে ওষুধের দাম বাড়ছে, আমার কাছে এর বড় কারণ মনে হচ্ছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সুপারভিশনের (তদারকি) অভাব। বাজারে বিদ্যমান ওষুধগুলো ঠিক মতো রাখা হচ্ছে কি না, ওষুধগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর সেগুলো পাল্টে দিচ্ছে কি না— বিষয়গুলো কেউ সুপারভাইজড করে না। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার পক্ষ থেকেও কোনো সুপারভিশন নেই। যে কারণে সবকিছু এখন নির্ভর করছে কোম্পানিগুলোর মর্জির ওপর। এমনটা হলে কীভাবে হবে? এর প্রভাব তো পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারাই।’
আবু জামিল ফয়সাল আরও বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য খাতে সবকিছু এখন পরিচালিত হচ্ছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এসব সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে হলে শক্তিশালী একটি ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা) কাঠামো দরকার। সেটা শুধু শক্তিশালী হলেই হবে না, সৎ মানুষের মাধ্যমে সে কাঠামো গঠন/পরিচালন হতে হবে। অন্যথায় কোনোভাবেই এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।
ওষুধে কাটছাঁট করার কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে : সৈয়দ আব্দুল হামিদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জিনিসের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের অবস্থা খারাপ হয়, এটাই স্বাভাবিক। সেটা ওষুধ হোক বা অন্যান্য সামগ্রী হোক। ওষুধটা হচ্ছে অন্যান্য সামগ্রী থেকে আলাদা। ওষুধের দাম যদি মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তাহলে তো আরও বেশি সমস্যা হয়।
‘অন্যান্য জিনিসের ক্ষেত্রে মানুষের বিকল্প চয়েস (পছন্দ) থাকতে পারে। মানুষ চাইলে বেশি দামেরটা ব্যবহার না করে কম দামিটা ব্যবহার করতে পারে। বেশি দামি চাল না কিনে কম দামি চাল খেতে পারে বা খাওয়া কমিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ওষুধের ক্ষেত্রে চাইলে তো কম দামি ওষুধ খাওয়া যায় না। ওষুধের ক্ষেত্রে কারও বলার সুযোগ নেই যে বেশি দামের ওষুধটা নিব, না কম দামিটা নিব। যে ওষুধ চিকিৎসক লিখবেন, যেটা খেলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবেন, সেটাই তাকে খেতে হবে। কিন্তু যদি ওষুধের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তাহলে বাধ্য হয়ে মানুষ ওষুধ খাওয়া কমিয়ে দেবে। এমনকি আমরা প্রায়ই ওষুধে কাটছাঁট করার কথা শুনে আসছি, যা আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।’
আরও পড়ুন
প্রমোশন-মার্কেটিং খরচ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ ঢাবি অধ্যাপকের
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদের মতে, ডলার-কাঁচামালের দাম যদি বাড়ে তাহলে কি ওষুধের দাম বাড়বে না? কাঁচামালের দাম যদি বাড়ে, উৎপাদন খরচ যদি বাড়ে, তাহলে ওষুধের দামও বাড়বে। আমদানি খরচ, কাঁচামালের খরচ— এগুলো তো কোম্পানির হাতে নাই। এক্ষেত্রে করণীয় কী? আমি মনে করি, করণীয় হতে পারে কোম্পানিগুলোর প্রমোশন ও মার্কেটিং খরচ কমিয়ে দেওয়া। ওষুধের দাম বেশি হওয়ার পেছনে এটি বড় একটি কারণ। সরকার বা ঔষধ শিল্প সমিতি যদি কোম্পানিগুলোকে মার্কেটিং-প্রমোশন খরচ কমানোর বিষয়ে বাধ্য করে তাহলে ওষুধের দাম এমনিতেই কমে আসবে।
‘আমরা দেখি বিভিন্ন কোম্পানি চিকিৎসকদের বিভিন্ন উপহার-উপঢৌকন প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কেউ চিকিৎসককে গাড়ি-বাড়ি করে দেয়, বাসায় লিফট লাগিয়ে দেয় বা অন্যান্য উপহার দেয়। আবার অনেক কোম্পানি সরাসরি বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। ওষুধ কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর আগে এ বিষয়গুলো নিয়ে কেন ভাবে না? তারা শুধু পারে সাধারণ মানুষের ওপর সবকিছু চাপিয়ে দিতে।’
আব্দুল হামিদ আরও বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের পেছনে এত এত এত টাকা মার্কেটিং বাবদ খরচ করে, সেটাও তারা পুরোপুরি অডিটের সময় উল্লেখ করে না। এক কথায় তারা বিষয়টি সরাসরি গোপন করে। আমি মনে করি, সরকার যদি কোম্পানিগুলোকে প্রমোশন ও মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেয় এবং সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মানতে বাধ্য করে, তাহলে ওষুধের দামের অস্থিরতা অনেকটা কমে আসবে।
যাচাই-বাছাই করে দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত : ঔষধ প্রশাসন
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও উপপরিচালক মো. নূরুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক দিন ধরে নতুন করে ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। যদিও আমাদের কাছে দাম বাড়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন কেউ করেনি। তবে, উৎপাদনকারী বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা ডলার সংকট, ওষুধের কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদন খরচ এবং প্যাকেজিংসহ বিভিন্ন ধরনের খরচ বেড়েছে— এমন দাবি জানিয়ে আসছেন।
‘যদিও আমাদের কাছে দাম বাড়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন কেউ করেনি। এখন কেউ যদি লিখিত প্রস্তাব দেয় তাহলে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, এর আগে যতবার ওষুধের দাম বেড়েছে, সেগুলো কাঁচামালের দাম ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে সমন্বয় করা হয়েছে। এটি করা না হলে অনেক কোম্পানি ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারত না। তবে, আমাদের মূল টার্গেট হচ্ছে জনগণ, তাদের ব্যাপারেও আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তা-ই যতটুকু সমন্বয় করা যায় আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
হুটহাট দাম বাড়িয়ে ফেলা কোনো নিয়ম হতে পারে না : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
হুটহাট ওষুধের দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওষুধের দাম নিয়ে অস্থিরতার কথা আমি জেনেছি। শিগগিরই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বসব। ওষুধ কোম্পানিগুলো কীভাবে দাম বাড়াচ্ছে, তারা চাইলেই তো দাম বাড়াতে পারে না। ইচ্ছামতো হুটহাট দাম বাড়িয়ে ফেলবে— এটা তো কোনো নিয়ম হতে পারে না। তাদের সঙ্গে বসব, দেখি তারা (ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর) কী বলে?
‘আর সবকিছু একসাথে একজনের পক্ষে করা মুশকিল। আমি এখন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার— এগুলো নিয়ে কাজ করছি। ওষুধের দামে অস্থিরতার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখব।’
নতুন করে দাম বাড়ানোর বিষয়ে কোম্পানিগুলো ঔষধ প্রশাসনে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে— এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি এখনই ঔষধ প্রশাসনে কথা বলব। সাধারণ মানুষ যদি ওষুধ কিনতে না পারে তাহলে বাঁচবে কী করে? আমি বিষয়টি খুবই গুরুত্বসহকারে দেখব।’
টিআই/এআর/এমএআর/