দেশে নীরব ঘাতকে রূপ নিয়েছে উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন)। এর প্রভাবে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিউরসহ ‘ধ্বংসাত্মক’ কিছু রোগে প্রাণ হারিয়ে এবং চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতি বছর ‘পথে বসছে’ হাজারো মানুষ। তবে এ রোগের ভয়াবহতা ও করণীয় প্রসঙ্গে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বাংলা একাডেমির কবি জসীম উদ্দীন ভবনে অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন রচিত ‘রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ নূরুল হুদা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান, কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীসহ আরও অনেকে।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ রক্তচাপ, যা প্রায় একটি স্থায়ী রোগ হিসেবে বিবেচিত। এর জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ খুবই জরুরি। না হলে বিভিন্ন জটিলতা, এমনকি হঠাৎ করে মৃত্যুরও ঝুঁকি থাকে।

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, রক্তচাপ এবং উচ্চ রক্তচাপ দুটি আলাদা বিষয়। রক্তচাপ সবারই আছে কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ হলো রোগ, যা মানুষকে নানা জটিল সমস্যার মুখোমুখি করে দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপকে বলা হয়ে থাকে সাইলেন্ট কিলার। দেশে কেউ কেউ মনে করেন তার উচ্চ রক্তচাপ আছে কিন্তু লক্ষ্মণ নেই। যে কারণে তিনি কখনো চিকিৎসকের পরামর্শও নেন না। আবার কিছু মানুষ আছে যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে কিন্তু কিছুদিন মেডিসিন নিয়ে ওষুধ বন্ধ করে দেন, এগুলো খুবই ভয়াবহ সমস্যার কারণ।

তিনি বলেন, আমাদের সমাজে প্রেশার হলে তেঁতুল খাওয়া নিয়ে একটা ভুল বোঝাবুঝি রয়ে গেছে। কিন্তু এটি আসলে কোনো কাজই করে না। দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নেওয়াই উত্তম।

ডা. আবদুল্লাহ বলেন, কারও একবার যদি প্রেশার হয়েই যায়, তাহলে একেবারে কখনো সেটি সেরে যায় না। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য। যদি প্রতিরোধ করা না যায়, তাহলে দেহের চারটি অর্গান (ব্রেন, হার্ট, কিডনি, চোখ) মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। তাই কোনোভাবেই উচ্চ রক্তচাপকে অবজ্ঞা করা যাবে না। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে হবে, যা চাইলেই সম্ভব।

এসময় অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক বলেন, হাইপারটেনশন হলো উচ্চ রক্তচাপ। এটি নীরব ঘাতক। এর প্রাদুর্ভাব ইদানীং খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে এই হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেলে ধ্বংসাত্মক হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিউরসহ নানা জটিল কিছু হয়ে যেতে পারে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, কিছু রোগ হাজারো পরিবারকে পথে বসিয়ে দিচ্ছে। আর সেসব রোগের মূল কারণই হলো হাইপারটেনশন।

তিনি বলেন, একজন চিকিৎসকদের মূল কাজ হলো মানুষকে শেখানো, শুধু প্রেসক্রিপশন লিখে দেওয়া নয়। একজন চিকিৎসক তখনই মানুষকে রোগের ব্যাখ্যাটা পরিপূর্ণভাবে দিতে পারেন, যিনি ওই রোগটি নিয়ে ভালো করে জানেন। এজন্য নিজেকে আগে ওই রোগের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে হবে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণাগুলোতে যুক্ত থাকতে হবে।

প্রখ্যাত এই চিকিৎসক বলেন, যদি হাইপারটেনশন নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে রোগের কুফল থেকে জনগণ রক্ষা পাবে। এক্ষেত্রে অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেনের লেখা ‘রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপ’ বইটি অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা চাই বইটি আপনাদের মাধ্যমে অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ুক, মানুষ রোগ সম্পর্কে জানুক, সচেতন হোক, এটাই আমার আবেদন।

‘রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপ’ বই প্রসঙ্গে লেখক অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন বলেন, হাইপারটেনশন প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। অনেকটা এই নীরব ঘাতক নিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই বইটি লিখেছি। একজন ব্যক্তির হাইপারটেনশন কেন হয়, কীভাবে বেঁচে থাকা যায়, চিকিৎসা প্রক্রিয়া এবং ওষুধের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ নানা বিষয় বইতে নিয়ে এসেছি। আশা করছি যে কেউ পড়লে উপকৃত হবেন।

লেখক আরও বলেন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে রোগীদের এত উপলব্ধি আর অভিজ্ঞতা জেনেছি, যা কোথাও আমি পাইনি। তাই মনে হলো এ অভিজ্ঞতাগুলো বই আকারে প্রকাশ করে অন্যদেরও জানার সুযোগ তৈরি করে দিই। হাইপারটেনশনের কনসেপ্ট নিয়মিত পাল্টাচ্ছে। নতুন নতুন টেকনিক আসছে, চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের সবসময় নতুনের সঙ্গে থাকতে হবে।

টিআই/এসএসএইচ