বিদ্যালয়ে অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার, নীরব মহামারিতে কিশোরীরা
এ বছরের সেপ্টেম্বরে ইউরিন ইনফেকশন ধরা পড়ে রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারাহ ফারহিনের। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া না লাগলেও প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, জ্বর, মাথাব্যথা ও পেটে ব্যথায় ভুগতে হয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ। সেবন করতে হয়েছে নির্ধারিত মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক।
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলল রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়ালের আরেক শিক্ষার্থী জাওয়াতা আফনান। সে জানায়, দেড় বছর আগে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার কারণে তাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। ডাক্তার বলেছিলেন প্রস্রাবে ইনফেকশন ধরা পড়েছে।
বিজ্ঞাপন
শুধু জাওয়াতা আফনান কিংবা ফারহিনের নয়, আরও অনেক কিশোরীকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে এ ধরনের সমস্যার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনা না হওয়ায় দেশের স্কুলপড়ুয়া কিশোরীদের বড় একটি অংশ ইউরিন ইনফেকশনসহ নানা জটিলতায় ভুগছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর অভিজাত স্কুলগুলোতেও নেই মেয়েদের জন্য হাইজিন কর্নার। সরকারি স্কুলে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবকিছুর উন্নতি হলেও অন্তরালে রয়ে যাচ্ছে কিশোরীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি। স্কুল স্কুলে ঘুরে দেখা গেছে রাজধানীর বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই কিশোরীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা। নেই পৃথক হাইজিন কর্নার ও পর্যাপ্ত শৌচাগার। বেশিরভাগ স্কুলে নেই টিস্যু পেপার ও হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। শৌচাগারের ভেতরে নেই পর্যাপ্ত আলো-বাতাস। বেশিরভাগ স্কুলের ওয়াশরুমে নেই ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন।
সঠিক পরিবেশ না পেয়ে একদিকে যেমন মাসিক চলাকালীন কিশোরীদের স্কুলে অনুপস্থিতি বাড়ছে তেমনি মানসিক বিষণ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ইউরিন ইনফেকশন, রিপ্রোডাক্টিভ ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, বন্ধ্যাত্ব এবং জরায়ুতে ইনফেকশন ও জরায়ু ক্যানসারের মতো রোগের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক সময় কেউ কেউ মারাও যাচ্ছে। ফলে নীরব মহামারির শিকার হচ্ছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীর অভিজাত ইংরেজি মাধ্যম ও সরকারি স্কুলগুলোর চিত্র
রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাড়ে ৯ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার এই ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবগুলো ভবন মিলে শিক্ষার্থীদের জন্য শৌচাগার আছে ১০৮টি। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য আছে ১০০টি। স্কুলটিতে প্রতিদিন গড়ে ৮৭ জন শিক্ষার্থী একটি শৌচাগার ব্যবহার করছেন। মেয়ে শিক্ষার্থীদের পিরিয়ডকালীন প্রয়োজনে হাইজিন কর্নার থাকলেও তা অকেজো অস্থায় রয়েছে।
রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত ঢাকার অন্যতম ইংরেজি মাধ্যম স্কুল কিডস টিউটোরিয়ালে প্রায় সাড়ে পাঁচশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। স্কুলটির পাঁচতলা ভবনে ১৭টি শৌচাগার আছে। তবে শিক্ষকদের শৌচাগার বাদ দিলে শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করে মাত্র ১৪টি। এ স্কুলে গড়ে ৩৯ জন শিক্ষার্থী একটি শৌচাগার ব্যবহার করেন। ইংরেজি মাধ্যম এ স্কুলটিতে প্লে থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়ে শিক্ষার্থী থাকলেও নেই মাসিক ব্যবস্থাপনা।
রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম প্রতিষ্ঠান সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ঢাকার বিভিন্নস্থানে প্রতিষ্ঠানটির ছয়টি শাখা থাকলেও মালিবাগের এ শাখাতেই শিক্ষার্থী রয়েছে সাত হাজারের বেশি। এ প্রতিষ্ঠানটির ৬টি ভবনে শৌচাগার আছে ৬৯টি। স্কুলটিতে প্রতিদিন গড়ে ১০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী একটি ওয়াশরুম ব্যবহার করছে। ২০০৯ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এ স্কুলে নেই মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক হাইজিন কর্নার। এমনকি এখানকার শৌচাগারগুলোও সংকীর্ণ ও অপরিচ্ছন্ন। ফলে স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তনের সুযোগও এখানে নেই।
রাজধানীর বাসাবোতে অবস্থিত নিবন্ধনপ্রাপ্ত ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিস্টিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। চার শতাধিক শিক্ষার্থী আর ৪০ জন শিক্ষকের জন্য এ স্কুলটিতে ওয়াশরুম রয়েছে মাত্র ৬টি। স্কুলটিতে প্রতিদিন গড়ে ৬৬ জন শিক্ষার্থী একটি ওয়াশরুম ব্যবহার করছে। মোট শিক্ষার্থীর বেশিরভাগ মেয়ে হলেও মেয়েদের পিরিয়ডকালীন সময়ের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই প্রতিষ্ঠানটিতে।
২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করা পার্ক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের খিলগাঁও শাখায় বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন শতাধিক। ইংরেজি মাধ্যম প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধনপ্রাপ্ত এ স্কুলটিতে ওয়াশরুম রয়েছে মাত্র ১২টি। এ স্কুলটিতে প্রতিদিন গড়ে ২৫ জন শিক্ষার্থী একটি ওয়াশরুম ব্যবহার করছে। স্কুলটিতে শতকরা ৬৫ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী থাকলেও নেই পৃথক কোনো ব্যবস্থা।
রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত বিশ্বমানের শিক্ষা কারিকুলামে চলছে কানাডিয়ান ট্রিলিনিয়াম স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এ স্কুলটিতে ১৮০ জন শিক্ষার্থী ও ২৫ জন শিক্ষকের জন্য ১৬টি ওয়াশরুম থাকলেও নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক হাইজিন কর্নার নেই।
রাজধানীর অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ হাজারের বেশি। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য ওয়াশরুম রয়েছে মাত্র ১৩৯টি। একটি ওয়াশরুম গড়ে ৮০ জন শিক্ষার্থী ব্যবহার করে। স্কুলটিতে পৃথক হাইজিন কর্নার আছে বলে দাবি করেছেন স্কুলটির সিনিয়রর শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান। তবে ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান বলছে, এ স্কুলটিতেও পৃথক হাইজিন কর্নার নেই।
১৯৮৮ সাল থেকে এ স্কুলের ওয়াশরুম পরিষ্কারের কাজ করছেন শুচি কুমার দাশ। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, স্কুলে মেয়েদের মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক হাইজিন কর্নার নেই। স্কুলের ওয়াশরুমেই মেয়েরা তাদের পিরিয়ডকালীন কাজ শেষ করেন। প্রতিদিন এত বেশি ছেলেমেয়ে ওয়াশরুম ব্যবহার করলে তো আর পরিবেশ ঠিক রাখা সম্ভব হয় নয়। নোংরা তো হবেই। কিছু করার নেই।
এদিকে স্কুলটির নার্স খাতেমুন নাহার ইতি জানান, আমি হাইজিন কর্নার বা পৃথক মাসিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি জানি না। মেয়েরা আমার এখানে আসে এবং প্যাড নিয়ে যায়। তারা স্কুলের বাথরুমেই তাদের প্রয়োজন শেষ করে। স্কুলের একাধিক মেয়ে শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলা হলেও হাইজিন কর্নার সম্পর্কে কেউই জানে না বলে নিশ্চিত করেছে।
এদিকে রাজধানীর মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২ হাজার ৭২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ স্কুলটিতে ওয়াশরুম রয়েছে মাত্র ১৫টি; নেই মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য হাইজিন কর্নার। স্কুলটিতে গড়ে ১৩৮ জন শিক্ষার্থী একটি ওয়াশরুম ব্যবহার করে।
স্কুলটির এক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি জানান, মেয়েদের মাসিক ব্যবস্থাপনার আলাদা কিছু আমাদের এখানে নেই। কয়েকটি বাথরুম আছে যেখানে কয়েকটিতে লাইট নেই, দুই-একটিতে পানির কল ভাঙা। এগুলোই মেয়েদের ব্যবহার করতে হয়। এসময়টাতে অনেক মেয়েই স্কুলে আসতে চায় না। আমি দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করছি। এই সমস্যাটা আগে আরও বেশি ছিল। কিন্তু এখন ওয়াশরুমগুলো তুলনামূলক পরিষ্কার থাকায় সমস্যাটা কিছুটা কমেছে। তবে এ পরিবেশে মেয়েদের জন্য প্যাড চেঞ্জ করা ঝামেলার কাজ।
যা বলছেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা
স্কুলপড়ুয়া কিশোরীদের মাসিক ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ও সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে কথা হয় পেডিয়াট্টিক অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট গাইনকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের মহাসচিব, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন অধ্যাপক ডা. গুলশান আরার সঙ্গে। তিনি বলেন, মেয়েদের মাসিকের সময়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে কিশোরীদের বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৮ লাখ নারী মাসিকের সময় অপ্রতুল সেবার কারণে মৃত্যুবরণ করে। মাসিক চলাকালীন এই অপ্রতুল সেবার কারণে যে সমস্যাগুলো হয় তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রজনন গ্রন্থিগুলোর ইনফেকশন। প্রজনন গ্রন্থি, টিউব এবং জরায়ুতে যে ইনফেকশনগুলো হয় পরে কিশোরীরা বিভিন্ন সমস্যায় ভোগে। এ সমস্যা যে শুধু কৈশরকালীন হয় তা কিন্তু নয়। যেহেতু সঠিকভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনা করা না গেলে কিশোরীদের প্রজনন গ্রন্থিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেহেতু তাদের বাচ্চা নেওয়ার সময় এ সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে। অনেকেরই এ ধরনের ইনফেকশন থেকে ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব হতে পারে।
ডা. গুলশান আরা বলেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এ বিষয়টি এ বছর গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। মাসিক চলাকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তারা সম্মিলিত ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দিয়েছে। ডব্লিউএইচও কিশোরীদের মাঝে সচেতনতা তৈরিতেও জোর দিতে বলেছে। স্কুল থেকে শুরু করে পরিবার এবং সমাজেও এ বিষয়ে সচেতনতা জোরদার করা উচিত বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মাসিককালীন ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাসিক চলাকালীন কিশোরীদের স্যানিটারি প্যাড প্রয়োজন হয় এবং সেটা ডিসপোজের প্রয়োজন হয়। এখানে ওয়াশিং ফ্যাসিলিটিসের প্রয়োজনও হয়। মেয়েদের মাসিক চলাকালীন এই ওয়াটার স্যানিটেশন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়কে গুরুত্ব না দিলে নানা ধরনের জটিলতা দেখা যায়।
দেশের খ্যাতনামা এই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, স্কুলে কিশোরীদের মাসিক চলাকালীন প্যাড ডিসপোজ করার ব্যবস্থা না থাকলে ওয়াশরুম নোংরা হয়ে থাকে। এ নোংরা পরিবেশ থেকেই ছড়াতে পারে ইনফেকশন। এ ইনফেকশন থেকেই কিশোরীরা নীরব মহামারির ঝুঁকিতে পড়ে। মাসিক চলাকালীন এ সময়টাতে আমাদের মেয়েরা স্কুলেও যেতে চায় না। সুতরাং হাতের কাছে স্যানিটারি প্যাডের জন্য সচেতনতা এবং এর সহজলভ্যতা জরুরি। এটা সহজলভ্য করা না গেলে মেয়েরা যদি কাপড় ব্যবহার করে তাহলে তারা নিজেদের সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। আমাদের দেশের স্কুলগুলো বেশিরভাগই খুব সংকীর্ণ এবং অপরিষ্কার। সুতরাং এখনি সময় পৃথক হাইজিন কর্নার স্থাপন এবং মাসিকচলাকালীন কিশোরীদের প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রেখে সেবা নিশ্চিত করা।
পিরিয়ডকালীন স্কুলে আসতে কিশোরীদের ‘না’
দেশের সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাবান্ধব ওয়াশরুম নেই। ওয়াশরুমে জরুরি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ না থাকার পাশাপাশি ব্যবহৃত ন্যাপকিন ফেলার জন্যও নেই স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা। অথচ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন- মাসিক চলাকালীন প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন করতে হবে। এটা না মানলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকিসহ নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। অথচ স্কুলগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং পৃথক হাইজিন কর্নার না থাকায় পিরিয়ড চলাকালীন প্রতিদিন প্রায় আট ঘণ্টা স্কুলে থেকেও স্যানিটারি নাপকিন পরিবর্তনের সুযোগ পাচ্ছে না বেশিরভাগ কিশোরী। ফলে বাধ্য হয়েই পিরিয়ডের সময়গুলোতে স্কুলে আসতে চায় না কিশোরীরা। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে পরীক্ষায়ও অংশ নেয় না অনেকে।
সরেজমিন রাজধানীর একাধিক স্কুলে ঘুরে এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিরিয়ড চলাকালীন মেয়েরা স্কুলে আসতে অনীহা প্রকাশ করে। এর পেছনে নোংরা ওয়াশরুম, ওয়াশরুমের স্বল্পতা, স্যানিটারি ন্যাপকিন সহজলভ্য না হওয়া, অনিরাপত্তা এবং মানসিক অবসাদ অন্যতম কারণ।
বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের ঋতুকালীন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন ফলোআপ সার্ভেতেও মাসিক চলাকালীন কিশোরীদের স্কুলে যেতে অনীহার বিষয়টি উঠে এসেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন ফলোআপ সার্ভে ২০১৮ (ডিসেম্বর ২০২০ প্রকাশিত) বলছে- দেশের ৩০ শতাংশ ছাত্রী মাসিক চলাকালীন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। দেশের বেশির ভাগ স্কুলে মেয়েদের জন্য পৃথক এবং ব্যবহারের উপযোগী টয়লেট না থাকায় এ অনুপস্থিতির হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না।
জরিপে দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের ব্যাপারে অসচেতন। ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মাসিকের সময় পুরাতন কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করে। মাত্র ৬২ শতাংশ কিশোরী প্যাড ব্যবহার করে। ৭৯ শতাংশ কিশোরী ভালো পানি ও সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে মাসিক ব্যবস্থাপনায় কাপড় ব্যবহার করেন। এদের মাঝে মাত্র ২১ শতাংশ কিশোরী এ কাপড়গুলো বাড়ির বাইরে রোদে শুকাতে পারে। ফলে এটা স্পষ্ট যে মাসিক সচেতনতায় আমাদের মেয়েরা এখনো পিছিয়ে।
নিরুপায়-উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা
রাজধানীর মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীর অভিভাবক লায়লাতুন নাহার তাসনিম। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, প্রতি মাসেই একটি নির্ধারিত সময়ে মেয়ে স্কুলে যেতে চায় না। আমি বুঝতে পারি বিষয়টা। এই স্কুলে না আসার পেছনে অন্যতম কারণ প্যাড নিয়ে আসা, সেটি পরিবর্তনের জন্য সঠিক পরিবেশ না থাকা এবং দুশ্চিন্তা। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন কিন্তু কেউই মুখ খুলতে চায় না। তাছাড়া এসব নিয়ে কথা বলতে একটি সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে।
রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজশিক্ষার্থীর আরেক অভিভাবক উম্মে কুলসুম বলেন, বাসার টয়লেট সবসময় আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি। কিন্তু স্কুলে তো আর বাচ্চা সেই পরিবেশটা পায় না। বাধ্য হয়েই স্কুলের এসব নোংরা পরিবেশে তাদের মাসিক চলাকালীন প্রয়োজন মেটাতে হয়। এখানে বাচ্চাদের তো বিকল্প কোনো কিছু নেই। স্কুল মিস করারও সুযোগ নেই। কারণ প্রচুর প্রতিযোগিতা এখানে। এক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ থাকা উচিত। অন্তত ভালো ঢাকনাযুক্ত বিন, পরিষ্কার পানি এবং পৃথক হাইজিন কর্নার থাকা প্রয়োজন।
মাসিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় বাড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিও
বিএমজি সাইকিয়াট্রিতে গত ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীদের ৭৩.৫ শতাংশের মাঝেই মানসিক চাপজনিত কোনো না কোনো লক্ষণ দেখা গেছে। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশের মাঝে মাঝারি ধরনের মানসিক চাপের উপসর্গ দেখা গেছে। অন্যদিকে ৯ শতাংশ উচ্চচাপজনিত উপসর্গে ভুগছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেয়েদের মানসিক চাপ ছেলেদের চেয়ে বেশি ছিল। ছেলেদের মধ্যে এই হার ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ অপরদিকে মেয়েদের মধ্যে তা ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
কিশোরীদের মাসিক চলাকালীন মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও দেশের প্রখ্যাত মনোচিকিৎক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল। তিনি বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে স্কুলের ওয়াশরুম যদি পরিষ্কার না থাকে এবং পর্যাপ্ত পানি ও ঢাকনাযুক্ত বিন এবং পিরিয়ডকালীন অন্যান্য যে সুবিধা থাকার উচিত সেটা না থাকলে কিশোরীদের মনে আতংক সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে স্কুলে যেতেও তারা ভীত হয়ে পড়ে। এই ভয় থেকেই মাসিকচলাকালীন কিশোরীদের স্কুলের প্রতি অনিহা আসতে পারে। অপরদিকে স্কুলের এই নোংরা পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা কিশোরীদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে ও ক্রোধ জাগাতে পারে। যে বাচ্চাটা ভালো পরিবেশ থেকে এসেছে মনোজগতে বেশি ক্ষতি হবে। তার প্রতিক্রিয়াতা বেশি নেতিবাচক হবে। অপরদিকে যে বাচ্চাটা দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে এবং অপেক্ষাকৃত কম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তাদের ক্ষেত্রে ক্ষতিটা কিছু কম হবে। তারা হয়তো এ পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু ভালো পরিবেশের কোন বাচ্চা তো এটা মানিয়ে নিতে পারেবে না। এখানে তিনটি 'এ' খুব গুরুত্বপূর্ণ- এডজাস্টমেন্ট, একসেপটেন্স ও এডাপ্টটেশন। এই তিনটি জিনিসের মধ্যে তাদের ঘাপলা হলে তারা যখন পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে পারবে না অবশ্যই তাদের মনজগের ঘাটতি হবে,মন খারাপ হবে, তাদের মধ্যে ক্রোধ ও বিরক্তি জাগতে পারে। এছাড়া আরেকটি 'এ' হচ্ছে অল্টআরেশন। বাচ্চারা এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারলে এই পথ বেছে নেয়। তারা এই সময়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। অবশ্যই আমাদের স্কুলের ওয়াশরুমগুলো উন্নত করতে হবে।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মনোজগতে সুন্দর আবহ তৈরি করতে অবশ্যই এ দিকটি গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবেশ ভালো থাকলেই বাচ্চারা যখন ক্লাসে থাকবে তখন সেখানে মনোযোগ দিতে পারবে। মনোযোগ দিতে পারলে বাচ্চার স্মৃতিশক্তি ভালো কাজ করবে এবং বাচ্চারা ভালো ফলাফল করতে পারবে। কিন্তু অসুস্থ পরিবেশে গেলে যেকোনো মানুষেরই একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সুতরাং বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে কিশোরী মেয়েদের এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পরিচর্যা করতে হবে।স্কুলের কর্ণধার যারা থাকেন এ বিষয়টি গুরুত্বই দেন না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওয়াশরুমে গেলে মনে হবে এ এ নতুন সাম্রাজ্য। দারুণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অথচ আমাদের দেশের স্কুলের বাঁচাদের জন্যই একটি ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা। বাচ্চাদের মনোজগৎ ও মনোবিকাশ সঠিকভাবে বিকশিত হতে এ অবস্থার উন্নতি ছাড়া বিকল্প নেই।
অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, পিরিয়ড চলাকালীন মেয়েদের শরীরে হরমোনের দ্রুত পরিবর্তন দেখা যায়। ইস্ট্রোজেন নামক এক প্রকার স্ত্রী হরমোন একটি মাসিক চক্র শেষ হলে অল্প করে বাড়তে থাকে। দুই সপ্তাহের মাথায় সেটি চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। নারীদের এ অবস্থাকে ওভলুশন বলে। এরপর দ্রুত কমতে থাকে এ হরমোন। অপরদিকে মাসিক শুরুর পড় থেকে অল্প অল্প করে এ হরমোন আবারও বাড়তে থাকে। ইস্ট্রোজেন নামক এই স্ত্রী হরমোনের এই প্রক্রিয়া মেয়েদের মানসিক চাপ তৈরি করে; তাদের মুড সুইং করে।
মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে যা বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা
এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, মেয়েদের মাসিক চলাকালীন অনেক ধরনের সমস্যা হয়। এসময়ে কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার পাশাপাশি নিরাপত্তাজনিত সংকট তৈরি হয়। মাসিক চলাকালীন স্কুলে এ বিষয়ের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রেও বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় মাসিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। এই মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন মেইনটেনেসের জন্য তিনটি জিনিস দরকার। প্রথমত, কিশোরীদের মাসিক সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, কীভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে বা হাইজিন মেইনটেইন করতে হবে সে সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পুরাতন কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার যে করা যাবে না সেটাও তাদের জানতে হবে। সর্বশেষ প্যাড ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সেগুলো ডিসপোজ করার জ্ঞান থাকতে হবে। এই তিনটি জিনিস ঠিকমতো না হলে কিশোরীদের স্কুলে আসতে অনীহা দেখা যায়। এছাড়া কিশোরীদের রিপ্রোডাক্টিভ ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, যোনিপথে ইনফেকশন, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই) বা প্রস্রাবে ইনফেকশন হয়। এসব ইনফেকশন থেকে জ্বর,তলপেটে ব্যাথা, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া এমনকি মানসিক বিষণ্ণতা দেখা দেয়। নোংরা পরিবেশে প্যাড পরিবর্তন করলে এলাজ্রি, চুলকানি এমনকি প্রদাহ হতে পারে। আমাদের দেশে কিশোরীদের জন্য আলাদা করে টয়লেট, প্রাইভেসি মেইনটেইন করা এবং সাবান পানির ব্যবস্থা ও প্যাড ব্যবহারের পর সেটি ডিসপোজ করার ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নেই। তবে সরকারি-বেসরকারি কিছু প্রকল্প থেকে এ সম্পর্কে সচেতনতা ক্যাম্পেইন দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সরকারি বেসরকারি স্কুল ভেদে এগুলোর ব্যবস্থাপনাও ভিন্ন ভিন্ন। সরকারি স্কুলগুলোতে অতিরিক্ত বরাদ্দ না দিলে সেখানের ওয়াশরুমগুলো ঠিক করতে পারে না। তবে মাসিক চলাকালীন প্যাড পরিবর্তন ও তাদের আনুষাঙ্গিক কার্যক্রমের জন্য পৃথক হাইজিন কর্নার থাকা উচিত। এতে বাচ্চাদের সংক্রমণ ঝুঁকি কমবে। যে ওয়াশরুমে প্রতিদিন ৫০ থেকে একশত বাচ্চা মলত্যাগ করছে সেখানেই যদি মাসিকের প্যাডও পরিবর্তন করা হয় তাহলে তো আর হাইজিন মেইনটেইন করা হয় না। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র মাসিকের জন্য পৃথক ওয়াশরুম বা হাইজিন কর্নার থাকা জরুরি।
অপর্যাপ্ত-অপরিচ্ছন্ন ওয়াশরুম: বাড়ছে কোলোন ও জরায়ু ক্যানসারঝুঁকি
মাসিক চলাকালীন কিশোরীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কথা বলেছেন ইউনিসেফের সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শদাতা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারেক এম হোসেন। তিনি বলেন, দেশের বেশিরভাগ স্কুলগুলোতে মাসিক ব্যবস্থাপনার সুযোগ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা এসব বিষয় নিয়ে ভাবেন বলেও মনে হয় না। দেশের অভিজাত স্কুলগুলোতেও একটি ওয়াশরুম গড়ে ৬০ জনের বেশি ব্যবহার করেন। যে ওয়াশরুমে একদিনে ৬০ জন শিক্ষার্থী যায় সেখানে নিশ্চয়ই টিস্যু, সাবান বা আনুষাঙ্গিক উপকরণ থাকে না। এছাড়া ঢাকনাযুক্ত বিনের ঘাটতিও স্পষ্ট। সুতরাং গণহারে যেখানে সবাই ব্যবহার করছে সেখানেই মাসিক চলাকালীন কিশোরীদের প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করা কতটা প্রাসঙ্গিক এটা সবাই বুঝবে। সুতরাং এখনই সময় মেয়েদের জন্য পৃথক বাথরুমের পাশাপাশি পৃথক হাইজিন কর্নার চালু করা। যেখানে মেয়েরা মাসিকের সময়ে ব্যবহার করবে। এটা করতে না পারলে নানা ধরনের সংক্রমণ দেখা দেবেই। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে প্রতিবছর যত কিশোরীদের ইউরিন ইনফেকশন হয় তার সিংহভাগ হয় এই নোংরা পরিবেশে মাসিক ব্যবস্থাপনার কারণে। মাসিক চলাকালীন অপরিচ্ছনায় গর্ভে সমস্যার পাশাপাশি ৯৭ শতাংশ নারীর কোনো না কোনো সময়ে সার্ভিক্যাল ইনফেকশন সমস্যায় ভোগেন।
ডা. তারেক বলেন, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মাসিকের ন্যাপকিন পরিবর্তন করতে হতে ইউরিন ইনিফেকশন বা ইউটিআই। বারবার যদি কারো ইউটিআই হলে পরে তাদের প্রজনন ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রস্রাবে ইউরিয়া এবং অ্যামিনো অ্যাসিডের মতো টক্সিন জাতীয় পদার্থ থাকে। ফলে বেশিক্ষণ চেপে রাখার ফলে বিষাক্ত পদার্থ কিডনিতে পৌঁছে কিডনিতে স্টোন বা পাথর তৈরি করতে পারে। আমাদের দেশে মাসিকের সময় দেশের অনেক কিশোরী স্কুলে যায় না। এমনকি অনেকে পরীক্ষায়ও অংশ নেয় না। এ সমস্যার প্রধান কারণ দেশের বেশির ভাগ স্কুল-কলেজের টয়লেট মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উপযোগী নয়। টয়লেটগুলোতে ন্যাপকিন পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না এবং ব্যবহৃত ন্যাপকিন ফেলারও কোনো ব্যবস্থা থাকে না। তবে প্রতি পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা অন্তর ন্যাপকিন পাল্টানো দরকার। তা না হলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে এবং নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এছাড়া স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের তুলনায় ওয়াশরুম কম থাকায় নোংরা হয় বেশি। এতে বাচ্চারা মল চেপে রেখে বাসায় আসে। যার ফলে পায়ুপথের নানা রোগসহ কানসার পর্যন্ত হতে পারে।
জাতীয় জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুনভাবে প্রায় ৮ হাজার ২৬৮ জন নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হয় এবং ৪ হাজার ৯৭১ জন নারী মারা যায়। জরায়ুমুখ ক্যানসার বিশ্বজুড়ে নারীদের ক্যানসারের মধ্যে চতুর্থতম এবং ক্যানাসারজনিত মৃত্যুর চতুর্থতম শীর্ষ কারণ। বাংলাদেশে এই জরায়ুমুখের কানসারের বড় একটি কারণ সঠিকভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনা না থাকা। সুতরাং এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের এখন থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে হতে পারে বন্ধ্যাত্ব
জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক অলাভজনক বেসরকারি সংস্থা নূরা হেলথের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর আরেফিন অমল ইসলাম বলেন, কিশোরী মেয়েদের জন্য এটা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা অনেকাংশেই অবহেলিত। সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজে মাসিক ও তার ব্যাবস্থাপনা লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখা হয়। মাসিকের ব্যাপারে অনেক ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে এবং মাসিকের সময়ে নারীকে অনেক সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে যুক্ত করা হয় না। অথচ মাসিক একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার। এই সময়ে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তা সংক্রমণের বিস্তার ঘটায় যার ফলে পি আই ডি নামক এক রোগ এ নারী আক্রান্ত হতে পারে; ভবিষ্যতে যা বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে।
স্কুলে ওয়াশরুমের স্বল্পতা, হাইজিন কর্নার না থাকা, কিশোরীদের শুধু বিড়ম্বনায় ফেলে না, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় আর তার সঙ্গে স্কুলে অনুপস্থিত থাকার হারও বাড়িয়ে দেয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে অন্তত এই ৫টি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে— ১. স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে মাসিক ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব স্কুলছাত্রী ও তাদের পরিবারকে বোঝাতে হবে। ২. পরিষ্কার ও শুকনা টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে। ৩. হাইজিন কর্নারে বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ স্বাস্থ্য বার্তা সম্বলিত লিফলেটের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মাসিক ব্যবস্থাপনার সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতে স্থানীয় প্রভাবশালী, বিত্তবান ও সমাজসেবীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে। ৫. জাতীয়ভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম কমিয়ে সহজলভ্য করার জন্য সরকার, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং এনজিওদের এগিয়ে আসতে হবে।
মাসিক ব্যবস্থাপনায় নেই সরকারি উদ্যোগ : দায়সারা জবাব মন্ত্রী মহলের
স্কুলপর্যায়ে মাসিক ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণ ও সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্কুলগামী কিশোরীদের নিয়ে আমাদের একটি প্রকল্প ছিল কিন্তু এখন কিছুই নেই। আমরা চিন্তা করলাম এরকম প্রকল্পে ৩০০ কোটি টাকার ন্যাপকিন দেবার পর কি হবে? মাসিকের এ প্রক্রিয়াটা তো মেয়েদের প্রতি মাসেই আসবে। ফলে আমরা বিষয়টি রিঅরগানাইজ করে এই অর্থটি দিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করতে চেয়েছি। যারা সাসটেইনবল এই ন্যাপকিন তৈরি করবে এবং সরবরাহ করবে। একবার একটি ন্যাপকিন কিনে দিলাম, কোনো কোম্পানি সেটি সাপ্লাই দিলো আর তারপর একবার ব্যবহার করেই শেষ। এমন হলে তো হবে না। এ বিষয়গুলো থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কিশোরীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সরকার সেটি করার চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারিভাবে স্কুলগুলোতে পৃথক হাইজিন কর্নার নেই। তবে সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও এ বিষয়ে কাজ করছে। স্কুলগুলো আমাদের। সুতরাং এগুলো আমাদেরই পরিষ্কার রাখতে হবে। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক স্কুল ও ওয়াশব্লক তৈরিতে সরকারি বরাদ্দ বাড়ছে।
স্কুল থেকে ঝরেপড়ার অন্যতম কারণ মাসিক ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি
এ বিষয়ে কেয়ার বাংলাদেশের হেলথ ইউনিটের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ডা. ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। তিনি বলেন, স্কুলে মেয়েদের পিরিয়ড চলাকালীন বিষয়টি খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। তবে এখনো পুরোপুরিভাবে এই বিষয়টিকে সব জায়গাতে গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে না। মাসিক ব্যবস্থাপনায় স্কুলের যেমন একটা দায়িত্ব রয়েছে তেমনি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যারা যুক্ত আছে তাদেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। স্কুলপর্যায়ে মেয়েদের হাইজিন মেইনটেইন করে প্যাড পরিবর্তনের সুযোগ করে দেওয়া কিন্তু খুব বড় কোনো ইনভেস্টমেন্টের বিষয় নয়। এটি আসলে ইচ্ছার ব্যাপার। তবে এই ইচ্ছার জায়গাতেই আমাদের খুব ঘাটতি আছে। সঠিক পরিবেশ না পেয়ে মেয়েদের ঋতুকালীন এ প্রক্রিয়ায় তারা যদি স্কুলে আসতে না পারে তাহলে মাসে গড়ে পাঁচ থেকে সাত দিন তাদের অনেকের স্কুল মিস হয়ে যায়। এর ফলে সে শিক্ষার একটা অংশ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি- তারা যে ক্লাসগুলো মিস করল পরে আর সেগুলো তারা ধরতে পারে না। আস্তে আস্তে এমন দেখা গেছে যে এ প্রক্রিয়ায় স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। তার মানে ছোট্ট একটা ঘটনাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় কারণে তার স্কুল থেকে ঝরে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।
ডা. ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, মাসিক ব্যবস্থানার ঘাটতিতে যে বাঁচাদের শারিরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে শুধু তাই নয় বরং তাদের শিখন ঘাটতিও দেখা দিচ্ছে। আমার মনে হয় ছোট কিছু উদ্যোগ নিলে এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। এক্ষেত্রে স্কুল পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তাদের একটা করণীয় আছে। পাশাপাশি আমাদের মনে হচ্ছে- যারা অভিভাবক রয়েছেন তারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে স্কুল কর্তৃপক্ষকে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। তাহলে সমন্বিত উদ্যোগে এটা সমাধান করা খুবই সহজ হবে।
টয়লেটের যে ব্যাপারটা আছে সেখানে ছেলেমেয়েদের আলাদা টয়লেট এটা কিন্তু মেইনটেইন করাটা খুব কঠিন কিছু না। এটার একটা ডিসপোজাল অ্যারেঞ্জমেন্ট লাগবে। যাতে বাচ্চারা সেটি ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই জিনিসটা আমার কাছে মনে হয়েছে খুব কঠিন কিছু নয়। সিম্পল একটা উদ্যোগ নিলেই এটা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এ উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন খুব যে ব্যয়বহুল তা নয়। কিছু কিছু স্কুল কিন্তু সেটি করছে। তবে বেশিরভাগই স্কুলই এটা করছে না। তার মানে এটা চাইলেই সম্ভব। এই চাওয়ার জায়গাটা নিয়ে কাজ করার আছে। যত রকমের উপায় আছে সে উপায় গুলোকে কাজে লাগিয়ে যদি একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে কাজটি সহজ হয়ে যাবে।
প্রতিদিন একটি ওয়াশরুমে যেহেতু ৫০ থেকে ৬০ জন বাচ্চা ব্যবহার করছে সেহেতু এই নোংরা জায়গাতেই মেয়েদের পিরিয়ড চলাকালীন স্যানিটারি নাপকিন পরিবর্তন উচিত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেয়েদের জন্য টয়লেটের অনুপাতটি ও গুরুত্বপূর্ণ। অধিক শিক্ষার্থীর বিপরীতে অল্পগুলো টয়লেট থাকলে তো হবে না। টয়লেটের এই রেশিওটা ব্যালেন্স করতে হবে। প্রতিদিন যদি ৫০-৬০ বা ১০০ জন মেয়ে একটা টয়লেট ব্যবহার করে তাহলে তো এতে তারা কমফোর্ট ফিল করবে না। সুতরাং এই রেশিওটি একটা জায়গা। স্কুলে প্রধানদের এটারও একটা উদ্যোগের ব্যাপার আছে। শিক্ষার্থীদের অনুপাতকে গুরুত্ব দিয়ে টয়লেটে ব্যবস্থানাও করতে হবে। তাহলে বিষয়টি নিয়ে সহজ সমাধান বের হবে।
যা বলছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা
বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে সবকিছুর উন্নয়ন হলেও মেয়েদে পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্যসেবার এই বিষয়টি সবাই এড়িয়ে চলেন। সরকার থেকে শুরু করে বেসরকারি পর্যায়ে কোথাও এটি নিয়ে তেমন উদ্যোগ দেখিনা। বছর বছর স্কুলের ফি বাড়ছে, খাতা, কলম পেন্সিলের দাম বাড়াচ্ছে কিন্তু মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে। এ নিয়ে কারও উদ্বেগ নেই। বাচ্চারা দীর্ঘ সময় পায়খানা-প্রসাব চেপে রেখে বাসায় আসছে। একটি প্যাড পড়ে আট ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছে। বাচ্চারা বিভিন্ন রোগে ভুগছে অথচ তবুও এসবে কেউ যেন দেখার নেই। মাসিক বাবস্থাপনায় এখনই স্প্রকারি এবং বেসরকারি স্কুল পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহন করা উচিত। পাশাপাশি স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি কিশোরীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়েও সরকারি বরাদ্দ জরুরি।
মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখনো অসচেতন কিশোরীরা
২০১৯ সাল থেকে স্কুল পর্যায়ে মেন্সট্রুয়াল হেলথ নিয়ে কাজ করছে সুকর্মা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। সুকর্মার প্রতিষ্ঠাতা শেখ সুহানা ঢাকা পোস্টকে জানান, বাংলাদেশের মাত্র ৬ শতাংশ স্কুল মেয়েদের মেন্সট্রুয়াল হেলথ এবং হাইজিন এওয়ারনেস নিয়ে কাজ করে। এবং স্কুলের ৩৬% মেয়েরা জানেই না পিরিয়ড কি বা কীভাবে পিরিয়ডকালীন নিজেদের হাইজিন ম্যানেজ করতে হয়। আমরা গ্রাম তো বটেই রাজধানীর অভিজাত স্কুলগুলোতে বাচ্চাদের প্যাড ব্যাবহারের মাত্রা বেশি থাকলেও পিরিয়ডকালীন সচেতনার অভাব প্রবল। মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন স্কুল থেকে স্কুলে গিয়ে আমরা দেখেছি গ্রামের প্রায় ৯৫% মেয়েদের পিরিয়ডের সময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে ব্যাবহার করার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই। ফলে পিরিয়ডের দারিদ্র্যতা কমছে না, সেই সঙ্গে নানা রকম ট্যাবু তো আছেই। গ্রামের স্কুলের মেয়েদের মধ্যে মেনুস্ট্রুয়াল হেলথ এবং হাইজিন নিয়ে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। কিশোরী মেয়েদের কাছে পিরিয়ড এখনো ট্যাবু করে রাখা হয়েছে। ওদের কাছে পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের জন্য সঠিক ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। এই সময় স্বাস্থ্যসুরক্ষা এবং অসুবিধাগুলো জেনে নেওয়ার কোনো মাধ্যম নেই। কারণ আমরা এই বিষয়টি নিয়ে কিশোরীদের কথা বলতে দিচ্ছি না। কোনো আলোচনা করছি না।
সুকর্মার এই প্রতিষ্ঠাতা বলেন, বয়সন্ধিকালীন অনেক কিশোরীই মাসিকের সময় স্কুলে আসতে চান না। আবার অনেকেই স্কুল চলাকালীন মাসিক শুরু হওয়ার সময় অপ্রস্তুত অবস্থার মুখে হয়। সহপাঠী কিংবা অন্যের সঙ্গে এটি নিয়ে আলোচনা করতে বিব্রতবোধ অনেকেই। স্কুলে হাইজিন কর্নার না থাকা এবং হাতের নাগালে স্যানিটারি প্যাড না থাকায় নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে না তারা। এতে একদিকে মানসিক চাপে তৈরির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
মাসিক ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন পৃথক ওয়াশরুম
সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন অ্যাডভাইজার শামীমা আক্তার শাম্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাসিক চলাকালীন যদি স্কুলে সুব্যবস্থা না থাকে তাহলে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহটা মেয়ে শিক্ষার্থীদের এই সময়টায় কম দেখা যায়। কিশোরীরা কীভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ম্যানেজ করবে, ডিসচার্জ করবে— কোথায় ফেলবে এবং নতুন প্যাড কীভাবে ব্যবহার করবে, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া পর্যন্ত এ ব্যবস্থানা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি এসব কারণেই স্কুলে উপস্থিতির সংখ্যাটা কমে যায়। সেই হিসেবে কিন্তু তখন তাদের পড়াশোনারও একটা বড় ঘাটতি তৈরি হয়। প্রতিমাসে পিরিয়ড চলাকালীন যদি তারা স্কুলে না আসেন তাহলে তারা পিছিয়ে পড়বেন পড়াশোনায়।
আবার এটাতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও থাকে। কারণ মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য যদি একজন কিশোরী সকালে একটি প্যাড পরে আসে এবং সকালে পরে এসে দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত প্যাড পরেই থাকতে হয় তাহলে তার শরীরে বিভিন্ন রকমের সংক্রমণ রোগেরও সম্ভাবনা হতে পারে। এই পুরো বিষয়টাতে দুইটি জায়গা গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একটা হচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষের সচেতন থাকা এবং সঠিক পরিবেশ, পর্যাপ্ত পানি-সাবান এবং ডিসপোজালের ব্যবস্থা রাখা। দ্বিতীয়ত, হচ্ছে বাথরুমগুলোকে খোলা রাখা, ছেলে ও মেয়েদের ওয়াশরুমগুলকে ভিন্ন করা। তবে শিক্ষার্থীদের অনুপাত অনুযায়ী টয়লেটের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বাজেটের সাথে সম্পর্কিত। এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা জরুরি। এছাড়া শিক্ষার্থী অনুপাতে প্রাইভেট স্কুলগুলোতেও টয়লেটের সংখ্যাটা কেমন সেটাও কিন্তু আমাদের দেখা দরকার। স্কুলে আমরা যদি মেয়েদের উপস্থিতি ও মনোযোগ বাড়াতে চাই তাহলে অবশ্যই তাদের এই মাসিক ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে।
বেসরকারি স্কুলগুলোতে সচেতনতার পাশাপাশি একটা বিনিয়োগ দরকার। স্কুলে শিক্ষার্থীদের অনুপাতে ওয়াশরুমটা দরকার এই সচেতনাও জরুরি। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুলেও বিভিন্ন কেইস স্টাডি, পরিস্থিতি বিশ্লেষণসহ নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে এই জায়গাটায় একমত করাতে হবে। একটা প্রচারণা চালাতে হবে। সারা দেশেই অ্যাডভোকেসি করতে হবে। আমরা যদি সারা দেশে বিভিন্ন ক্যাটাগরির স্কুলে বাৎসরিকভাবে মেয়েরা কত দিন ধরে স্কুলে আসে না। না আসার প্রধান কারণগুলো কি এবং সেটার ভেতর কত শতাংশ কিশোরী মাসিক অব্যবস্থাপনার কারণেই আসেনা এই সংখ্যাটি বের করা জরুরি। এছাড়া পর্যাপ্ত ওয়াশরুম না থাকার কারণে তাদের কি ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যাগুলো হচ্ছে সে তথ্য উপাত্তগুলো যখন আমাদের কাছে থাকবে তখনই কিন্তু আমরা অ্যাডভোকেসি করতে পারব। সচেতনতা বাড়াতে পারব।
আরও পড়ুন
উদ্বেগের একটি বিষয় হচ্ছে— আমাদের দেশে অভিভাবকরা ভালো স্কুল বলতে শুধু কোন শিক্ষক কীভাবে পড়াচ্ছেন সেই জায়গাটা খেয়াল রাখেন। কিন্তু তার মেয়ে যে স্কুলে যাচ্ছে সেই স্কুলে মাসিক ব্যবস্থাপনার এই ধরনের পর্যাপ্ত সুবিধা আছে কিনা সেটা কিন্তু কখনো সচেতনভাবে জিজ্ঞাসা করে না। জানতে চায় না। দেখতেও চায় না।
সুতরাং এই বিনিয়োগ এবং উভয় দিকেই সচেতনতা বৃদ্ধির দরকার আছে। যে স্কুলের বাথরুমে প্রতিদিন ৬০-৭০ জন ব্যবহার করছেন সেখানেই একজন মেয়ে প্যাড চেঞ্জ করছেন। এমনটা হওইয়া উচিত না। স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা হাইজিন কর্নার থাকা উচিত। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যাবহারের জন্য পৃথক কক্ষ এবং সব ধরনের সুবিধা থাকা উচিত। আমরা সেভ দ্য চিলড্রেন থেকে বিভিন্ন প্রজেক্ট করেছিলাম সে সকল প্রজেক্টে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা করে কর্নার করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে এটা তারা ধুতে পারবে, কেউ যদি ন্যাপকিন ইউজ করে কিংবা ডিসপোজাল করতে পারবে। সুতরাং এটি অবশ্যই আলাদা জায়গায় হবে, এক জায়গায় তো আসলে হয় না। কারণ ওই পরিমাণে তো ওয়াশরুম গুলো পরিষ্কার করা হয় না। পরিষ্কার না করলে এটা তো আসলে হাইজিনটাই মেইনটেইন হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে তো আরও সমস্যা হতে পারে।
মাসিক ব্যবস্থাপনায় কৌশলী জবাব প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের
মাসিক ব্যবস্থাপনায় সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী ও প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। মাসিক ব্যবস্থাপনায় স্কুলে বিভিন্ন ধরনের সুবিধার কথা বলা হলেও একাধিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা তার মিল পাওয়া যায়নি। স্কুল থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দাবি করলেও সরেজমিন পরিদর্শন করে মিলেছে ভিন্ন চিত্র।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের কথা হলে তিনি জানান, স্কুলের প্রতি ফ্লোরেই হাইজিন কর্নার রয়েছে। তবে বাস্তবে সেসবের প্রমাণ মেলেনি। স্কুলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে নার্স কেউই দিতে পারেনি সেসব হাইজিন কর্নারের খোঁজ। একই চিত্র রাজধানীর প্রায় বেশিরভাগ স্কুলেই। এদিকে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আ.ন.ম. শামসুল আলম খান একই দাবি করলেও স্কুলটির একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেও তার প্রমাণ মেলেনি।
এমএম/এমএ