ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে ঢাকায় গেল, ডেঙ্গু মেয়েটাকে লাশ বানিয়ে পাঠাল
ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর সংখ্যা এবার এত বেশি হবে বা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হবে এমনটা কে ভেবেছিল? কেউ ভাবেনি বলেই হয়ত দেশে ডেঙ্গু এখনও লাগামহীন। সাধারণ মানুষ থেকে চিকিৎসক, কেউই রেহাই পাচ্ছে না ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকে। তাদেরই একজন দীপান্বিতা বিশ্বাস। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে খুলনা থেকে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন সলিমুল্লাহ মেডিকেলের এমবিবিএস প্রথম বর্ষের এ শিক্ষার্থী। ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রথম দিন থেকে চিকিৎসকদের নজরে থাকার পরও বাবা-মায়ের নজর থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছেন তিনি।
দীপান্বিতা বিশ্বাসের বাবা অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস পাওয়ারগ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রকৌশলী। এক ছেলে আর এক মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে জীবনে কোনো সঞ্চয় করেননি। বুক ফুলিয়ে বলতেন— আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ আমার ছেলে-মেয়ে। প্রাণঘাতী ডেঙ্গু তার অর্ধেক সম্পদ কেড়ে নিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
মেয়ে দীপান্বিতাকে নিয়ে অতীতের নানা স্বপ্ন, চিরতরে হারানো ও পরিবারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেন অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস
জীবনে কোনো সঞ্চয় করিনি, সন্তানই ছিল বড় সম্পদ
স্মৃতিচারণ করে দীপান্বিতার বাবা বলেন, ‘পাওয়ারগ্রিড কোম্পানিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে দীর্ঘদিন চাকরি শেষে রিটায়ার করেছি। ব্যক্তিগত জীবনে আমার সঞ্চয় বলতে সন্তানরা ছাড়া কিছুই ছিল না। আমার একটা ছেলে ও একটা মেয়ে। মেয়েটা ছোট, পরিবারে সে যে কতটা আদরের ছিল সেটা বলে বোঝাতে পারব না। মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল, সে স্বপ্ন নিয়েই তাকে মেডিকেলে ভর্তি করেছিলাম।’
অমল কৃষ্ণ বলেন, ‘গত ৮ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) প্রথমে তার জ্বর আসে। সেদিন রাতেই ফোন করে আমাকে অসুস্থতার কথা জানায়। আমরা পরদিন (শনিবার) সকালেই খুলনা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই এবং সন্ধ্যার দিকে তার হলে গিয়ে পৌঁছাই। তখন হলের ভেতরে আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, তবে আমার স্ত্রী ভেতরে যায় এবং মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এরপর সেখান থেকে বের করে তাকে নিয়ে আমরা সেদিনই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাই, পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে।’
‘এরপর মিটফোর্ডের ইমার্জেন্সিতে গিয়ে ডাক্তার দেখালে নাপাসহ খুবই সাধারণ কিছু ওষুধ দেয়। সেদিন রাতে তাকে হলে পৌঁছে দিয়ে আমি এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যাই। সেখান থেকে আবার ভোরে উঠেই তার কাছে চলে যাই। তখন তার শিক্ষকের সঙ্গে মেয়েকে খুলনায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন— ডেঙ্গু সাধারণ একটা রোগ, এজন্য তাকে খুলনায় নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে খুলনায় চিকিৎসা নেওয়া কঠিন হবে। বরং আপনারা খুলনায় যান, দীপান্বিতা ঢাকায় থাকুক।’
সবার অজান্তেই ভেতরে ভেতরে তার (দীপান্বিতার) অবস্থা খারাপ হচ্ছিল
দীপান্বিতার বাবা বলেন, ‘বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আলোচনার মধ্যেই তার (দীপান্বিতা) শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, এরপর দ্রুত হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলাম এবং হাসপাতালে ভর্তি করালাম। ভর্তি থাকা অবস্থায় তার শিক্ষকসহ অন্য চিকিৎসকরা আসত, দেখে যেত এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিত। কিন্তু, ভেতরে ভেতরে যে তার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছিল, সেটা হয়ত কেউই টের পায়নি।’
অতিরিক্ত পড়াশোনা দেখে আমরা বরং দীপান্বিতাকে একটু কম পড়াশোনা করে শরীরের যত্ন নিতে বলতাম। কিন্তু, যে মেয়েটা বড় ডাক্তার হওয়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে খুলনা থেকে ঢাকায় গিয়েছিল, সেই মেয়েটা ডেঙ্গুতে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরল
অমল কৃষ্ণ বলেন, ‘সবশেষ আরেকটা পরীক্ষা করার পর তারা বুঝতে পারে যে অবস্থা বেশ খারাপ, যেকোনো সময় খারাপ কিছু হতে পারে। এরপর বুধবার চিকিৎসক জানায়— তার (দীপান্বিতা) অবস্থা সংকটাপন্ন, তাকে দ্রুত আইসিইউতে নিতে হবে। পরে তাকে আইসিইউতে রাখা হলো।’
‘সেখানে নেওয়ার পর তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়, যেটি রক্তে দেওয়ার কথা সেটি হয়ত মাংসপেশিতে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে তার শরীর-চোখ ফুলে যায়। তারপর আইসিইউ থেকে বলা হলো— মুখে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। তারপর অবস্থার অবনতি হলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক আমাকে বলেন— তাকে অন্যত্র রেফার করার চিন্তা করছি। কারণ, কিছু পরীক্ষা আমরা এখানে করতে পারছি না।’
আরও পড়ুন-
তিনি আরও বলেন, ‘শুক্রবার আমরা তাকে (দীপান্বিতা) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসি। এখানে আসার পর শনিবার তার চিকিৎসায় একটা বোর্ড বসল। রোববারও তার শারীরিক অবস্থায় কোনো পরিবর্তন এল না। পরদিন চিকিৎসক আমাকে বাইরে থেকে একটা ইনজেকশন আনতে বলল, বাইরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন এল মেয়ের অবস্থা খারাপ। যাওয়ার পর শুনি আমার মেয়ে আর নেই।’
আইসিইউতে নেওয়ার পর মেয়েটা আমাকে বলছিল— বাবা আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, অক্সিজেন কোনোভাবেই টানতে পারছি না। আমি কি মরে যাব? তখন আমি তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম এবং ভগবানের নাম নিতে বললাম। মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলতে হবে, আমরা এটা বুঝতে না পারলেও সে ঠিকই বুঝতে পেরেছিল তার সময় হয়ত শেষ।
হয়ত জীবনে কোনো পাপ করেছিলাম, যে কারণে মেয়েটাকে হারিয়েছি
অমল কৃষ্ণ বলেন, ‘হয়ত জীবনে কোনো পাপ করেছিলাম, যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে আমার মেয়েকে হারিয়ে। নয়ত ডাক্তাররা এত চেষ্টা করল, তারপরও আমার মেয়েকে সামান্য ডেঙ্গু থেকে রক্ষা করতে পারলাম না। এটা আমরা কেউই মেনে নিতে পারছি না। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি— আমার মেয়ের ডেঙ্গুটা ছিল সবচেয়ে খারাপ ডেঙ্গু। গত বুধবার যদি আমরা তাকে আইসিইউতে না শিফট করতাম, তাহলে হয়ত সে তখনই মারা যেত।’
‘মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সে বুঝতে পেরেছিল তার সময় শেষ’— উল্লেখ করে দীপান্বিতার বাবা বলেন, ‘আইসিইউতে নেওয়ার পর মেয়েটা আমাকে বলছিলো, বাবা আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, অক্সিজেন কোনোভাবেই টানতে পারছি না। আমি কি মরে যাব? তখন আমি তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম এবং ভগবানের নাম নিতে বললাম। মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলতে হবে, আমরা এটা বুঝতে না পারলেও সে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো যে তার হয়ত সময় শেষ।’
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে প্রথম ডাক্তার হতো দীপান্বিতা
অমল কৃষ্ণ বলেন, ‘আমার মেয়েটাকে নিয়ে শুধু আমি নই, আমাদের পুরো আত্মীয়-স্বজন আশাবাদী ছিল যে— সে (দীপান্বিতা) বড় ডাক্তার হবে। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ডাক্তার ছাড়া প্রায় সব পেশারই মানুষ আছে, তাই সবার প্রত্যাশা ছিল আমাদের দীপান্বিতা ডাক্তার হয়ে সেই গ্যাপটা পূরণ করবে।’
তিনি বলেন, ‘মেয়েটাও স্বপ্ন দেখত সে অনেক বড় ডাক্তার হবে, সে অনুযায়ী নিজেকেও সে ওইভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করেছিল। তার পড়াশোনা দেখে আমরা বরং একটু কম পড়াশুনা করে শরীরের যত্ন নিতে বলতাম। কিন্তু, যে মেয়েটা বড় ডাক্তার হওয়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে খুলনা থেকে ঢাকায় গিয়েছিল, ঢাকা থেকে সে ডেঙ্গুতে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরল।’
পরিবারের অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেকে এটা সেটা বলে সান্ত্বনা দিই। কী করবো, আমার তো কিছু করার নেই। কিন্তু আমার স্ত্রীকে এখন পর্যন্ত আমি কোনো সান্ত্বনা দিতে পারিনি। এখনো সে আমার মেয়ের স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। জানি না আমাদের মেয়ে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে কতদিন সময় লাগবে।’
প্রসঙ্গত, গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় দীপান্বিতা বিশ্বাসের মৃত্যু হয়। তিনি রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।
টিআই/এমজে