কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল
টিকিট-ডাক্তারে দুই ঘণ্টা, ওষুধ নিতে কয় ঘণ্টা?
রাজধানীর উত্তর অংশে চিকিৎসাসেবায় রোগীদের অন্যতম ভরসা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। কম খরচে ভালো সেবার আশায় এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন রোগীরা। ভালো সেবা পাওয়ায় হাসপাতালটির ওপর রোগীদের আস্থা দিন দিন বাড়ছে। ফলে সেবা নিতে আসা রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
তবে, রোগীদের এই আস্থার বিপরীতে সেবার পরিধি বাড়াতে পারছে না হাসপাতালটি। ফলে চিকিৎসা নিতে এসে বিড়ম্বনায় পড়ছেন বেশিরভাগ সেবা প্রত্যাশী।
বিজ্ঞাপন
হাসপাতালটিতে টিকিট কাটা, ডাক্তার দেখানো আর ওষুধ সংগ্রহ করতে লম্বা সিরিয়ালে দাঁড়ানোসহ নানা বিড়ম্বনায় কাহিল হয়ে পড়েন রোগীরা। যেখানে যাবেন সেখানেই সিরিয়াল, কোথাও ফাঁকা নেই। অনেকের জন্য দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়ানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন- মুগদা মেডিকেলে নিত্যদিনের ‘যুদ্ধ’ লিফটে ওঠা
বুধবার (১২ জুলাই) বেলা ১১টায় হাসপাতালটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টিকিট কাউন্টার এবং ওষুধ কাউন্টারে একাধিক দীর্ঘ লাইন। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে টিকিট কাটতে লাগছে এক ঘণ্টা, ডাক্তার দেখাতে লাগছে এক ঘণ্টা আবার ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ সংগ্রহ করতে লাগছে আরও এক ঘণ্টারও বেশি সময়।
ওষুধের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে পাঁচ শতাধিক মানুষ
কুর্মিটোলা হাসপাতালের গেটের ভেতর ঢুকেই দেখা মেলে রোগী ও স্বজনদের দীর্ঘ লাইন। পাঁচটি লাইনের প্রতিটিতে অন্তত ১০০ জন করে মোট ৫০০ জনের মতো মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। খানিকটা এগিয়ে একজনের কাছে কীসের লাইন জানতে চাইলে বলেন, লাইনে দাঁড়ানো সবাই ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ সংগ্রহ করতে এসেছেন।
পাঁচটি ওষুধের আশায় প্রায় এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে দুটি ওষুধ পেলেন মো. রমজান আলী। তিনি বলেন, একে তো সিরিয়ালে লোক বেশি, দ্বিতীয়ত ওষুধ দিচ্ছে খুবই ধীরগতিতে। আমি এই হাসপাতালে আরও দুইবার আসছি, প্রতিবারই এমন সময় লেগেছে। হাসপাতালটির এত সুনাম শুনে এসেছি। এখন দেখছি খুবই ভয়াবহ অবস্থা। প্রতিটা জায়গায় লম্বা লম্বা লাইন। অথচ টিকিট কাউন্টার আর ওষুধের বুথ আর দুই-তিনটা করে বাড়িয়ে দিলেই এমন সমস্যা হতো না।
আরও পড়ুন- ডেঙ্গু পরীক্ষার সরকারি-বেসরকারি ফি কত?
ওষুধ প্রসঙ্গে রমজান আলী বলেন, ডাক্তার যদি পাঁচটা ঔষধ লিখে দেন, এখান থেকে দেয় দুইটা, বাকিগুলো বাইরে থেকে কিনে নিতে হয়। একজন মানুষ সমস্যায় পড়েই তো সরকারি হাসপাতালে আসে। তাকে যদি আবার বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয় তাহলে এখানে এসে লাভ কী হলো।
ব্যথার চিকিৎসা করাতে এসে ব্যথা নিয়েই এক ঘণ্টা সিরিয়ালে
কোমরে ব্যথা নিয়ে কুমিল্লা থেকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন মো. এনামুল হক। তিনি বলেন, ব্যথার জন্য কুমিল্লায় ডাক্তার দেখিয়েছি, অনেক ওষুধ খেয়েছি কিন্তু ভালো হয়নি। শুনেছি কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসা ভালো, তাই এখানে এসেছি। কিন্তু ডাক্তার দেখাতে এসে লাইনেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে দেড় ঘণ্টা, এখন আবার ওষুধের জন্য এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি।
তিনি বলেন, কুর্মিটোলায় সিরিয়ালের কোনো শেষ নেই। ভেতরে ঢুকে দেখেন আরও কত সিরিয়াল। ১০ মিনিট হলো এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে অন্তত আরও একঘণ্টা লাগবেই। প্রায় প্রতিদিনই এই সিরিয়াল লেগেই থাকে।
এনামুল হক আরও বলেন, প্রত্যেকটা জায়গায় লম্বা সিরিয়াল। কেউ যদি এই হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা করাতে আসে, তাহলে অন্তত ৩ ঘণ্টার আগে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার তার কোনো সুযোগ নেই।
এপেন্ডিসাইটিসের তীব্র ব্যথা, তারপরও টিকিট, তারপরও সিরিয়াল
মেয়ের এপেন্ডিসাইটিসের তীব্র ব্যথা। তার জন্য টিকিট কাটতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন মা আসমা আক্তার। তিনি বলেন, আধাঘণ্টা যাবৎ লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, মনে হচ্ছে আরও ঘণ্টাখানেক লেগে যাবে। কেন এত সময় লাগছে বুঝতে পারছি না। এদিকে আমার মেয়ের তীব্র ব্যথা। সে দাঁড়িয়ে থাকতেই পারছে না। তাকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
আসমা আক্তার বলেন, টিকিট কাউন্টারে যদি দুয়েকজন লোক বাড়িয়ে দেওয়া যায়, যদি একটা আলাদা বুথ খোলে তাহলেই কিন্তু সিরিয়ালটা কমে যায়। প্রথমবার এই হাসপাতালে আসলাম, এখন কোথায় যাবো, কার কাছে গেলে তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখাতে পারব, কিছুই বুঝতে পারছি না।
দুর্ভোগ চলতে থাকলে কুর্মিটোলার সুনাম থাকবে না
রোগীকে হাসপাতালের ফ্লোরে বসিয়ে রেখে টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন মো. রবিউল ইসলাম নামে এক স্বজন। তিনি বলেন, আমার রোগী বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দাঁড়ালে হঠাৎ করেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে যায়। তার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছি। কিন্তু এখানে এসেও সেই দাঁড়িয়েই থাকতে হচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার অবস্থা, এজন্য তাকে একটা জায়গায় বসিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
রবিউল ইসলাম বলেন, অসংখ্য রোগী জরুরি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। কিন্তু টিকিট কাটতেই যদি এত দুর্ভোগ হয়, তাহলে তো সমস্যা। আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব যেন প্রতিটি জায়গায় আরও একাধিক বুথ করে দেয়। কুর্মিটোলা হাসপাতালের সুনাম আছে, রোগীদের যদি প্রতিনিয়ত এভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তাহলে এই সুনাম আর থাকবে না।
আরও পড়ুন- অস্বাভাবিক অনুভব করলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করুন
মুক্তা রানী নামে এক রোগী বলেন, আমার হাতে সার্জারি হয়েছে, এটা থেকে গত কিছুদিন যাবৎ পানি বের হচ্ছিল। তাই এখন ডাক্তার দেখাতে এসেছি। ১০ মিনিট হলো লাইনে দাঁড়িয়েছি, অন্যরা বলছে ঘণ্টা দুয়েক হয়ত দাঁড়িয়ে থাকা লাগতে পারে। একজন অসুস্থ মানুষের জন্য ১০ মিনিটই দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। কীভাবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব?
আরেক রোগী জেসমিন আক্তার বলেন, সিরিয়ালে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা লাগে। অনেকে ফজরের নামাজ পড়ে চলে এসে সিরিয়ালে দাঁড়ান। ৫টা থেকেই সিরিয়াল শুরু হয়ে যায়। এভাবে চলে দুপুর দুইটা পর্যন্ত। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই এমন চিত্র দেখা যায়।
সেবার মান ভালো, তাই রোগী বেশি : হাসপাতাল পরিচালক
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার গুণগত মান ভালো, আমরা রোগীদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। এ কারণেই বেশি বেশি রোগী এখানে সেবা নিতে আসছে।
তিনি বলেন, এই হাসপাতালে যারা একবার সেবা নিতে আসেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে তারা প্রতিবেশীদেরও আসতে বলেন। যে কেউ হাসপাতালে এসে সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভর্তি হতে পারেন, পরীক্ষা করাতে পারেন এবং চিকিৎসা নিতে পারেন। কারণ আমাদের হাসপাতালে কোনো দালাল নেই। রোগীরা স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা নিতে পারেন।
সিরিয়াল আর লাইনে দাঁড়ানোর ভোগান্তি কমাতে বিশেষ কোনো ব্যবস্থার পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে পরিচালক জানান, আমরা খুব শীঘ্রই ডিজিটাল ব্যবস্থায় চলে যাব। তখন আর টিকিট কাটতে রোগীদের দীর্ঘ সিরিয়ালে দাঁড়াতে হবে না।
টিআই/এমজে/জেএস