দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। ইতোমধ্যে এ বছরের রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে গত মাসে (জুন)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের হার যদি এভাবে বাড়তে থাকে তাহলে জুলাই মাসে ছাড়িয়ে যাবে পূর্ববর্তী সব রেকর্ড।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বর্তমানে (৩ জুলাই দুপুর পর্যন্ত) সবচেয়ে বেশি ২৫১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মুগদা হাসপাতাল ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য ভরসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর যেকোনো এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রোগী ছুটে আসছেন মুগদা হাসপাতালে।

ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। অনেকে ফ্লোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোগীর তুলনায় অবকাঠামো এবং জনবলের সীমাবদ্ধতা থাকায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা।

রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ রোগী প্রথম অবস্থায় জানতেন না যে তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। জ্বরের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত শরীর ব্যথা ও মাথা ব্যথা যুক্ত হওয়ার এক-দুইদিন পর হাসপাতালে আসছেন তারা। তবে দেরিতে এলেও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত সেবায় সুস্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন বেশিরভাগ রোগী।  

মুগদার মান্ডা এলাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ইমরান হোসেন নামে এক ব্যক্তি। ঢাকা পোস্টকে তিনি বেলেন, আমি গত রোববার থেকে বুঝতে পারি আমার হালকা জ্বর। এর সঙ্গে যোগ হলো শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা। দু’দিন পর গিয়ে পরীক্ষা করি। রিপোর্ট আসে ডেঙ্গু পজিটিভ। এরপর দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হই। 

তিনি বলেন, বাসায় ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিলাম, গতকাল আবার একটু অসুস্থ লাগছিল, তাই হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছি। এখন শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভালো।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর রাজধানীর কদমতলি এলাকা থেকে এসে এখানে ভর্তি হয়েছেন আহসান হাবিব সুজন। তিনি বলেন, গত ২৮ জুন ভোর থেকেই কিছুটা জ্বর-জ্বর লাগছিল। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। এরপর রাত থেকে অনেক জ্বর এলো, তখনও আমরা ভেবেছি স্বাভাবিক জ্বর। ব্যথায় টিকতে না পেরে ঈদের দিন (২৯ জুন) এসে ডেঙ্গু পরীক্ষা করলাম এবং জানতে পারলাম আমার ডেঙ্গু পজিটিভ।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পরামর্শ করলাম কোন হাসপাতালে যাব। সবাই মুগদা হাসপাতালের কথা বলল। তাই এখানে এসে ভর্তি হলাম। আলহামদুলিল্লাহ খুব দ্রুত সুস্থ হচ্ছি।

আহসান হাবিব বলেন, জীবনে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছি। কিছুটা ভয় পেয়ে গেছি। প্রথম দু’দিন আমার খুব খারাপ অবস্থা ছিল। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা ছিল, সহ্য করার মতো নয়। এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। 

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী আমার হাসপাতালে। এখন আমার হাসপাতালে রোগী ভর্তি আছেন ২৫১ জন। এরমধ্যে গত একদিনে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ৮৪ জন। 

কোন এলাকা থেকে বেশি রোগী আসছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন আর নির্দিষ্ট কোনো এলাকা নয় সারা ঢাকা শহর থেকেই রোগী আসছে। যদিও এর আগে সবাই বলত কাজলা, যাত্রবাড়ী, মান্ডা, মুগদা, বনশ্রী থেকে বেশি রোগী আসছে কিন্তু এখনকার আমার পর্যবেক্ষণ হলো ডেঙ্গু এখন সব জায়গাতেই ছড়িয়ে গেছে। এমনকি আমাদের হাসপাতালে ঢাকার বাইরে থেকেও প্রচুর রোগী এসে ভর্তি হচ্ছে।

ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী আমরা সামাল দিচ্ছি, যদিও আমাদের জনবল খুব বেশি নেই। তাছাড়া, আমরা শুধু ডেঙ্গু রোগেরই চিকিৎসা দিচ্ছি তা নয়, সব ধরনের রোগীকেই আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। স্বল্প জনবলে একসঙ্গে সব সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও তো কিছু করার নেই। আমার হাসপাতালে রোগী এলে তাকে তো ফিরিয়ে দিতে পারব না।

তিনি বলেন, আমার নার্সের সংকটও তীব্র, ডাক্তারের সংকটও তীব্র। তারপরও আমরা ম্যানেজ করে চালিয়ে নিচ্ছি। এক্ষেত্রে রেশনিং করতে হচ্ছে। যেখানে আমাদের অন্য একটা ওয়ার্ডে তিনজন চিকিৎসকের ডিউটি করার কথা, সেখানে দুই জন দিয়েই ২৪ ঘণ্টা চালাতে হচ্ছে। এরপরও ভালো লাগার বিষয় হলো, আমাদের চিকিৎসক-নার্সদের সেবায় রোগীরা সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছে।

প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই (শনিবার) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ২৩৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১২৩, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে ৭৩, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৫, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ২৪ এবং শিশু হাসপাতালে ১৯ জনসহ সরকারি ২০টি হাসপাতালে সর্বমোট রোগী ভর্তি আছেন ৫৯৮ জন।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে। সেখানে ৪৬ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া আজগর আলী হাসপাতালে ৩৬ জন, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ২৪ জন, আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯ জনসহ ৩৩টি বেসরকারি হাসপাতালে মোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন ৩৪৬ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে সোমবার পাঠানো সব শেষ তথ্য মতে,  বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১৫৩১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১০২২ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫০৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।

চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৯১৯৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৬৬৫৫ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৫৩৮ জন।

আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৭৬০৬ জন। ঢাকায় ৫৫৮৯ এবং ঢাকার বাইরে ২০১৭ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

টিআই/এসএম