এই সময়ে ডেঙ্গুতে এত আক্রান্ত-মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা নয়
দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ বছরের প্রথম ৫ মাসে যত জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তা গত বছরের তুলনায় পাঁচ গুণ। গেল বছর এই সময়ে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য থাকলেও এবার ইতোমধ্যে ২৬ জনে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান ডেঙ্গু সংক্রমণের ধারা যদি একই হারে অব্যাহত থাকে, তাহলে রেকর্ড সংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যুর পাশাপাশি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। কথা বলেছেন ডেঙ্গু আক্রান্তের বর্তমান অবস্থা, ভয়াবহতা ও করণীয় প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু অন্যান্য সময়ের তুলনায় কেমন দেখছেন?
অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম : এ বছর এখন পর্যন্ত ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংখ্যাটিকে কোনোভাবেই কম বলার সুযোগ নেই। ২৬টি প্রাণ আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান। গত কয়েক বছরে ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু দেখিনি। এ বছরই প্রথম দেখলাম জুন মাসেই এতজন মারা গেলেন। এটা নিয়ে আমরা চিন্তায় আছি। এটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
>> জুনের ১০ দিনেই ডেঙ্গুতে ৯ জনের মৃত্যু
রোগীর সংখ্যা বাড়লে মৃতের সংখ্যা বাড়ে, আর রোগীদের মধ্যে জটিল রোগীর সংখ্যাও বাড়ে। যার ডেন-৩ সংক্রমণ হয়েছে, সে যদি আবার ডেন-৪ সংক্রমণে আক্রান্ত হয় তাহলে অবশ্যই তার অবস্থা গুরুতর হবে। এরকম অবস্থায় এসে যদি রোগীরা বাসায় ট্রিটমেন্ট নেয়, চিকিৎসা নিতে গড়িমসি করে, ওষুধের দোকান থেকে নিজের মত করে ওষুধ কিনে এনে খায়, তখনই ক্ষতিটা হয়ে যায়।
ঢাকা পোস্ট : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভূমিকা কী?
অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম : ডেঙ্গুর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অংশে রয়েছে পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট। পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন পুরোপুরি আপডেট করা আছে। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু কর্নার বা ডেঙ্গু ওয়ার্ড অথবা ডেঙ্গু রোগী ম্যানেজমেন্টের জন্য বিশেষায়িত ইউনিটের ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। পরীক্ষা, চিকিৎসা কেমন হবে, সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দেওয়া আছে। এসব প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই নিয়েছি। এখন মশার বিস্তার-উৎপত্তি যদি বন্ধ না হয়, তাহলে আপনি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন? অন্যরা তাদের জায়গা থেকে কে কতটুকু কী করল সেটাও দেখেন। শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নয়, সবাইকে নিয়েই তো ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট।
আমাদের সীমিত সম্পদ, সীমিত জনবল দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঢাকা শহরে আমরা ৯টা সার্ভে (জরিপ) করি। এরমধ্যে এয়ারপোর্টে করি দুই মাস পরপর একটা, ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে করি তিনটা (বর্ষার আগে, বর্ষায়, বর্ষার পরে)। এসব সার্ভে করে সঙ্গে সঙ্গে আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশনকে রিপোর্ট দিই। পরে তারা নিজেদের মতো করণীয় ঠিক করে। আমরা আমাদের অংশের কাজ করে ফেলেছি। বাকিটা স্থানীয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশনকেই দেখতে হবে। বিশেষ করে মশা নিধনের বন্দোবস্ত করা, এটা যেন সাসটেইন করে। পাশাপাশি ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ও কমিউনিটি এঙ্গেজমেন্টের বিষয়ে সবাই যেন অন্তত একটু করে রোল প্লে করে। তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
ঢাকা পোস্ট : ডেঙ্গুর মৌসুম এখনো শুরু হয়নি। মৌসুম শুরু হলে রোগীর সংখ্যা কেমন হতে পারে?
অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম : আগে যে সময় বর্ষা মৌসুম শুরু হতো, এখন তো সেটা হয় না। আগে-পরে হয়। এমনকি যখন শেষ হওয়ার কথা তখন শেষও হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘায়িত হয়। যে কারণে সময় বেড়ে যায়। আমাদের আশঙ্কা, অন্যান্য সময়ের তুলনায় এ বছর রোগী বেশি হবে। যদি আশঙ্কা সত্যি হয়, স্বাভাবিকভাবেই খারাপ রোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে। যদি সবাই সতর্ক থাকি, ঘরবাড়ি ও আশপাশ যদি পরিষ্কার রাখি, ঘরের বাইরে ও ছাদ বাগান যদি একটু দেখাশোনা করি, তাহলে মশা বৃদ্ধি কমিয়ে ফেলতে পারব। এটি সবার জন্যই কল্যাণকর হবে।
ঢাকা পোস্ট : ঢাকার কোন অংশে রোগীর পরিমাণ বেশি? অন্যান্য বছর গণমাধ্যমকে জানালেও এ বছর জানাচ্ছেন না কেন?
অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম : আমরা তথ্য গোপন করছি বা জানাচ্ছি না, বিষয়টি কিন্তু তা নয়। বিভিন্ন হাসপাতালের রোগীর সংখ্যা, তারা কোন কোন এলাকা থেকে এসেছেন এগুলো বের করার সুযোগ আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এই শহরের মানুষ তো মিক্সআপ। দক্ষিণের লোক উত্তরে আর উত্তরের লোক দক্ষিণে কাজ করেছেন, বসবাস করছেন। আরেকটি বিষয় হলো ঢাকার যত বড় বড় হাসপাতাল তার বেশিরভাগই দক্ষিণে। বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিডফোর্ড হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মত বড় হাসপাতালগুলো ওই অঞ্চলে। এর বাইরেও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, জাপান-বাংলাদেশ হসপিটালসহ আরও অনেক হাসপাতালের অবস্থান দক্ষিণ সিটি এলাকায়। স্বাভাবিকভাবেই রোগীরা বড় হাসপাতালগুলোতে যান। ওই হিসেবে দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় স্বাভাবিক।
এর বাইরে কোন এলাকায় মশা কেমন, সেটি বর্ষার আগের করা জরিপ শেষে বিস্তারিত তথ্য আগেই জানানো হয়েছিল। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএসে রোগীর নাম, বয়স, ঠিকানাসহ যেসব তথ্য আসে সেগুলো টালি করার কার্যক্রম চলছে। একটি সার্ভে টালি করা গেলে আমরা বলতে পারব কোন এলাকায় ডেঙ্গু মশা কেমন। এখন যদি অনুমাননির্ভর মন্তব্য করি, তাহলে পরে সেটা ভুলও হতে পারে।
>> দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু কেন বিপজ্জনক?
ডেঙ্গুর চারটি ধরন। এগুলো হলো- ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। এর কোনো একটি ধরনে আক্রান্ত হলে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, অর্থাৎ শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। গত সিজন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ডেন-৩ সেরো-সার্ভিলেন্সের (বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ) কাজ চলছে। আইইডিসিআর যদি এসব তথ্য-উপাত্ত একত্র করে আমাদেরকে রিপোর্ট দেয়, তাহলে বলতে পারব এ বছর প্রবণতা কোন এলাকায় বেশি বা সংক্রমণের হার কোন দিকে যাচ্ছে।
ঢাকা পোস্ট : ডেঙ্গুর উপসর্গে কোনো পরিবর্তন এসেছে? অনেকেই বলছেন জ্বরের সঙ্গে হাত-পা ফুলে যাচ্ছে আবার পেটে-বুকে পানি আসছে। এগুলো কি ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গ?
অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম : জ্বরের পাশাপাশি হাত-পা ফুলে যাওয়া, পেটে-বুকে পানি জমা, এগুলো হচ্ছে বিপদজনক চিহ্ন। তবে এগুলো ডেঙ্গু সংক্রমণের কারণেও হতে পারে, চিকনগুনিয়া বা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। আর ডেঙ্গু সংক্রমণের কতগুলো পর্যায় আছে- ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু, হেমোরেজিক ফিভার ও শক সিন্ড্রোম। এখন সবার তো ক্লাসিকাল হবে না, কারো কারো খারাপের দিকেও যাবে। কারো ফুসফুসে ধরবে, কারো কিডনিতে ধরবে আবার কারো পেট ফুলে যাবে। এগুলো হতেই পারে, কিন্তু সেটা স্বাভাবিক ঘটনা না। যদিও এই অবস্থা কিছুটা ক্রিটিক্যাল। তারপরও সময়মত চিকিৎসকের কাছে নিলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু কারোর অর্গান ফেইলিওর হয়ে গেলে আর কিছু করার থাকে না।
ঢাকা পোস্ট : ডেঙ্গু সংক্রমণের পাশাপাশি আশঙ্কাজনকভাবে মৃতের হারও বাড়ছে। এ অবস্থায় করণীয় কী?
অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম : স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, নিজের ঘরবাড়ি ও আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। অন্যদেরকে সচেতনতা ও অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাহলেই চাপ কমে যাবে। ডেঙ্গু সংক্রমণের যে হার, আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকা উচিত। কোনোভাবেই পরিস্থিতিটিকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।
টিআই/ওএফ