অনিশ্চয়তা বাড়ছে চিকিৎসা পেশায়
‘চিকিৎসক’ নামটা সামনে এলেই একসময় চোখের সামনে ভেসে উঠত দামি গাড়ি, মোটা অঙ্কের টাকা আর আলিশান জীবন-যাপনের চিত্র। তবে, সময়ের পালাবদলে এ পেশা এখন ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি বিশাল সংখ্যক চিকিৎসকের প্রতিযোগিতার বাজারে শ্রমের মূল্য যেন কমে আসছে। পেশাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসা পেশায় দিন দিন অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এ অবস্থায় পেশাগত নিরাপত্তার পাশাপাশি চিকিৎসকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়ও জোর দিয়ে ভাবা উচিত।
এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে একজন এমবিবিএস পাস চিকিৎসক বেতন পান গড়ে ২০ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ। গড়ে একজন চিকিৎসক বেতন পান ১৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা। এত অল্প টাকায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার সামলে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন>> উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ করা অন্যায় : চিকিৎসক সমাজ
আর্থিক টানাপোড়েনে জুনিয়র চিকিৎসকরা, ভুগছেন বিষণ্নতায়
আর্থিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় ডা. মো. আরাফাত ইসলামের। রাজধানীর বাড্ডা এলাকার একটা ক্লিনিকে গত চার মাস ধরে ২২ হাজার টাকা বেতনে সেবা দিয়ে আসছেন তিনি। স্ত্রীসহ উত্তর বাড্ডা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন আরাফাত। সন্তান না থাকলেও পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে বাবা-মায়ের দেখাশোনার দায়িত্বও তার কাঁধে।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এমবিবিএস শেষ করেছি, এখন পোস্ট-গ্রাজুয়েশনে চান্স পাওয়ার চেষ্টা করছি। এতদিন বাবা আমার পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচ বহন করলেও কিছুদিন হলো তিনি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। তাই এখন নিজের খরচ চালানোসহ পরিবারের খোঁজ-খবর রাখা আমার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডা. আরাফাত বলেন, এত পরিশ্রম আর এত টাকা খরচ করে চিকিৎসক হয়েছি। এখন কর্মক্ষেত্রে এসে দেখছি চিকিৎসক হওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। এখনও আমাকে আরও ছয় থেকে সাত বছরের পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু এ সময় পরিবার-সংসার সামলে কীভাবে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাব— এটাও বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু ডা. আরাফাত নয়, এমন অবস্থা সদ্য এমবিবিএস পাস করা প্রায় প্রত্যেক চিকিৎসকের। এ অবস্থায় হতাশা বাড়ছে তাদের মধ্যে।
শারীরিক সহিংসতার চেয়ে প্রকট মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা
একজন চিকিৎসক নামমাত্র বেতনে চাকরি করেও কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের সহিংসতায় ভোগেন। দেশে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা নিয়ে সম্প্রতি এক সমীক্ষা চালিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ (জনস্বাস্থ্য ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ)। সমীক্ষার ফলে দেখা গেছে, দেশের হাসপাতালগুলোতে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার প্রাদুর্ভাব ছিল। যা শতকরা বিবেচনায় প্রায় ৪৮ শতাংশ।
দেশের হাসপাতালগুলোতে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার প্রাদুর্ভাব ছিল। যা শতকরা বিবেচনায় প্রায় ৪৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে শারীরিক সহিংসতার চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতাই বেশি ছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল যৌন নির্যাতনের ঘটনাও। শতকরা হিসাবে কর্মক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা দেখা গেছে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ, শারীরিক সহিংসতা ৫ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতন ছিল ১৯ শতাংশ— বলছে বিএসএমএমইউ’র সমীক্ষা
এক্ষেত্রে শারীরিক সহিংসতার চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতাই বেশি ছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল যৌন নির্যাতনের ঘটনাও। শতকরা হিসাবে কর্মক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা দেখা গেছে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ, শারীরিক সহিংসতা ৫ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতন ছিল ১৯ শতাংশ।
সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার উচ্চ প্রাদুর্ভাব (৪৮ শতাংশ) হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতাল-প্রশাসনে সহিংসতার রিপোর্টের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। শতকরা বিবেচনায় যা প্রায় ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা রিপোর্ট করতে আগ্রহীদের সহিংসতার অভিজ্ঞতা কম ছিল। এমনকি কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার অংশগ্রহণকারীদের জীবনযাত্রার মানও কম ছিল।
আরও পড়ুন>>টাকা-উপহারে ‘বিক্রি হচ্ছেন’ চিকিৎসক, বাড়ছে ব্যয়!
জানা গেছে, এ গবেষণার জন্য মোট ১৯ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়। চিকিৎসক ও নার্স উভয়কেই এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রশ্নপত্রের নকশা করা হয়েছিল অংশগ্রহণকারীদের সামাজিক-জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য, কর্মক্ষেত্রের তথ্য, কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও জীবনযাত্রার মান ব্যবহার করে। লজিস্টিক রিগ্রেশন করা হয়েছিল স্বাস্থ্যকর্মীর কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার সঙ্গে অংশগ্রহণকারীদের জনসংখ্যা বিষয়ক বৈশিষ্ট্য এবং কর্মক্ষেত্র বিষয়ক ভ্যারিয়েবলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করার জন্য।
চিকিৎসক সুরক্ষিত হলেই আপনার স্বাস্থ্যের সুরক্ষা মিলবে : ডা. সাকলায়েন রাসেল
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. সাকলায়েন রাসেল বলেন, প্রায় সময়ই কর্মক্ষেত্রে রোগীর স্বজন কর্তৃক স্বাস্থ্যকর্মীরা হামলা-মামলার শিকার হন। তাদের মনে রাখা উচিত যে আপনার চিকিৎসক যদি সুরক্ষিত হয়, তিনি আপনার সুরক্ষার দায়িত্বও সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন।
‘আমরা যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের সঙ্গে সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করি, তখন আমরা বুঝতে পারি তাদের চেয়ে আমরা কোনো দিক থেকেই পিছিয়ে নেই। তথ্যপ্রযুক্তি বা আমাদের চিকিৎসকদের দক্ষতার দিক থেকে এখন আমরা বেশ এগিয়ে। বরং কিছু ক্ষেত্রে আমরা অন্যদের তুলনায় ভালো করছি। এমনকি বাংলাদেশ থেকে যেসব চিকিৎসক চাকরি নিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী হচ্ছেন, তারা কিন্তু সেসব দেশে সেরা চিকিৎসক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন।’
‘যদি দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেলের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে চিকিৎসক তৈরি করে দিচ্ছে বাংলাদেশ। এখান থেকে তারা ডাক্তারি পাস করে বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি নিয়ে বড় বড় চিকিৎসক হয়ে যাচ্ছেন। তারপরও আমাদের রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকদের একটু দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বলে মনে করি।’
আরও পড়ুন>>দেশসেরা হয়েও ডেন্টালে ভর্তি হবেন না অর্থী
অর্থনৈতিক অবস্থা প্রসঙ্গে ডা. সাকলায়েন বলেন, ‘বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চিন্তা করেন যে চিকিৎসক মানেই গাড়ি-বাড়ি আর অট্টালিকার মালিক। সোজা কথায়, চিকিৎসক মানেই একজন সচ্ছল মানুষের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু বাস্তবতায় এ সংখ্যা নিতান্তই কম। আজ যারা জুনিয়র চিকিৎসক, ক্লিনিকগুলোতে তাদের বেতন খুবই কম। স্বল্প বেতনে চাকরির পাশাপাশি তাদের আবার পোস্ট-গ্রাজুয়েশনে চান্সের জন্য যুদ্ধ করতে হয়। এমনকি যুদ্ধের পর তারা যখন চান্স পান তখন তাদের বলা হয়, তুমি পোস্ট-গ্রাজুয়েশনে ঢুকেছ তাই আগামী পাঁচ বছর তুমি কোনো চাকরি করতে পারবে না। বিনিময়ের তুমি এখানে ২০ হাজার করে টাকা পাবে। এক্ষেত্রেও দেখা যায়, কেউ কেউ সেই টাকাও পান না।’
‘আপনি একজন চিকিৎসককে এতগুলো বিদ্যার মাধ্যমে আমাদের একটা গর্বিত প্রতিনিধি করলেন, কিন্তু মাস শেষে আপনি তাকে বেতন দিচ্ছেন ২০ থেকে ২১ হাজার টাকা! খুব বেশি হলে ২৫ হাজার টাকা। চিত্রটি যদি আমি ঢাকার বাইরে চিন্তা করি, তাহলে চিকিৎসকের বেতন হয়ে যাচ্ছে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এমন একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে যেসব চিকিৎসক বের হয়ে আসছেন তাদের থেকে কতটুকু ভালো ব্যবহার আমরা প্রত্যাশা করতে পারি?’
চিকিৎসকের ভালো কর্মপরিবেশ তৈরি করে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব
অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বলেন, ‘বাংলাদেশের চিকিৎসকগণ নানা সমস্যায় জর্জরিত। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা দেখছি, কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকরা নিরাপদ নন। কথায় কথায় তাদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাদের কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি তাদের শারীরিক নির্যাতনও করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এমনও ইতিহাস আছে যে বিভিন্ন সময় চিকিৎসককে মেরে-পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’
‘দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি করা, চিকিৎসকদের সুরক্ষিত রাখা এবং তারা যাতে ভালোভাবে চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন, সেই পরিবেশ আমাদের রাষ্ট্রকেই করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসকের যদি নিরাপত্তা না থাকে তাহলে কিন্তু তিনি ঠিক মতো সেবা দিতে পারবেন না। বিশেষ করে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি মুমূর্ষু রোগী থাকেন, সেখানে সেবা দেওয়াসহ রেফার করার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা এক রকম ভয়ের মধ্যে থাকেন। যে কারণে যথাযথ চিকিৎসাসেবাটা ব্যাহত হয়। সুতরাং এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসকদের সুরক্ষায় যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিত সেগুলো দ্রুততার সঙ্গে নেওয়া জরুরি।’
এ বিষয়ে চিকিৎসক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। ডা. গুলশান আরা আরও বলেন, চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রের মান ও পরিবেশ আরও বেশি উন্নত হওয়া প্রয়োজন। দেশের অসংখ্য চিকিৎসক ভালো নেই। কর্মক্ষেত্রেও তারা যথাযথ সম্মান পাচ্ছেন না। তাদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
বিশাল পুঁজির স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসকরা ‘স্বাস্থ্যশ্রমিকে’ পরিণত হবেন
বাংলাদেশ ফার্মাকোলজিক্যাল সোসাইটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে চিকিৎসকদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা আমরা এখনও নিশ্চিত করতে পারিনি। সামাজিক, মানসিক ও পেশাগত সুরক্ষার পাশাপাশি আরও বেশকিছু থ্রেট (হুমকি) চিকিৎসকদের জন্য আছে এবং আগামী দিনে আরও আসবে। যেমন- আমরা যদি ভাবি বিশাল পুঁজির স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের ফলে চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যশ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। এটা যখন কায়িক শ্রমিকে রূপান্তরিত হয় তখন যে ঝুঁকিটা আসে সেটা অর্থনৈতিকসহ সামাজিক সম্মানের ঝুঁকিতে পরিণত হয়। এটাও আগামী দিনে চিকিৎসকদের জন্য বড় থ্রেট।’
‘বেশ কিছুদিন ধরে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ মেশিন লার্নিংয়ের ফলে বলা হচ্ছে যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে স্বাস্থ্য খাত। যখনই স্বাস্থ্য খাত প্রভাবিত হবে তখনই চিকিৎসক ও খাতসংশ্লিষ্ট সব মানুষ একটা নতুন ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখি হবেন। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সুরক্ষার পাশাপাশি শারীরিক, মানসিক ও পেশাগত আক্রমণ এবং প্রযুক্তি ও পুঁজির আক্রমণ থেকেও এ খাতকে রক্ষা করা দরকার।’
আরও পড়ুন>>অসচেতনতায় ‘হিট স্ট্রোক’ কেড়ে নিতে পারে প্রাণ
ডা. সাইদুর রহমানের মতে, এটা মানবকল্যাণের খাত। এ বৈশিষ্ট্য আমরা হারিয়ে ফেলতে পারি যদি এর সব ধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারি। শারীরিক, মানসিক, পেশা ও প্রযুক্তিগত এবং পুঁজিবাদের আগ্রাসন থেকে যদি স্বাস্থ্য খাতকে রক্ষা করা না যায় তাহলে মানবসভ্যতা এক ধরনের হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। এমনকি যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে, সেটাও মুখ থুবড়ে পড়বে।
বর্তমান বাজারে একজন চিকিৎসকের বেতন কত হওয়া উচিত— এমন প্রশ্নের জবাবে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমি ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে মনে করি, একজন চিকিৎসকের বেতন সর্বনিম্ন ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা হওয়া উচিত। এর নিচে হলে কোনোভাবেই একজন চিকিৎসকের সুন্দরভাবে খেয়ে-পড়ে বাঁচা সম্ভব নয়।
সম্মানজনক বেতন কাঠামো নির্ধারণ জরুরি : ডা. এ কে আজাদ খান
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ‘আমি মনে করি সব পেশাই মহান। তবে, চিকিৎসা পেশা আমার কাছে শুধু মহানই নয়, অনন্য এক পেশা। এখন পর্যন্ত চিকিৎসা পেশাটা সাধারণ মানুষের মধ্যে শ্রদ্ধাভক্তির একটা জায়গা হিসেবেই আছে। কিন্তু এটা যখনই ব্যবসায়িক অ্যাঙ্গেলে ডিজাইন করা হবে, তখনই আর কোনো সম্মান থাকবে না।’
‘চিকিৎসকদের সুরক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু ব্যক্তিগত বা সামাজিক সুরক্ষা নয়, তাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষাও জরুরি। এক্ষেত্রে তাদের জন্য একটা সম্মানজনক বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে দেওয়া এবং এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া সিনিয়রদের কর্তব্য। পাশাপাশি চিকিৎসকদের উচিত নিজ পেশার আত্মসম্মানবোধ ঠিক রেখে কম বেতনে চাকরি করা থেকে বিরত থাকা।’
ডা. এ কে আজাদ বলেন, আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় পাবলিক কমিউনিকেশন বিষয়ে তেমন বলা হয় না। যদিও এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কারণে আমরা সমাজের জন্য যতটুকু করি, সে অনুপাতে সাধারণ মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি না। অর্থাৎ আমরা অন্যান্য পেশার লোকজনের মতো মানুষের সঙ্গে ততটা কমিউনিকেট করতে পারি না। তাই ভালো কাজ করেও আমরা এর ফল ঘরে তুলতে পারি না। আমি মনে করি, এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। এমনকি চিকিৎসাশিক্ষায় বিষয়টা অন্তর্ভুক্তও করা উচিত।
ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি বলেন, বর্তমান চিকিৎসাসেবা দ্রুত পরিবর্তনশীল। এ পরিবর্তনের সঙ্গে কিন্তু আমাদের চিকিৎসকদেরও পরিচিত হতে হবে। আমরা যতই বলি না কেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আমাদের এ পেশায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে। মনে রাখতে হবে যে কোনো প্রযুক্তিই আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যদি আমরা সে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে না পারি। মোবাইল ফোনের কথা বলি, এর অনেক ক্ষতিকারক দিক রয়েছে। কিন্তু মোবাইল ফোন ছাড়া কি আমাদের একটা দিনও চলে? এজন্য আমাদের প্রযুক্তিগতভাবেও সমৃদ্ধ হতে হবে।
‘আমাদের চিকিৎসকদের আত্মসমালোচনা করা শিখতে হবে। আমরা যে সমাজে এত বড় একটা সেবা দেই, তারপরও কেন সমাজে আমরা উপেক্ষিত হব? কেনই বা কর্মক্ষেত্রে আমাদের ওপর আঘাত আসবে? আমরা যদি পাবলিক কমিউনিকেশন-টা শিখি, সাধারণ মানুষের ভাষা বুঝতে পারি এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারি তাহলে প্রতিকূল পরিস্থিতিগুলো আস্তে আস্তে সরে যাবে।’
আগামী সংসদেই স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন পাস : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে প্রায় সময়ই চিকিৎসকরা নানা ধরনের সমস্যায় পড়েন। অনেক সময় রোগীর স্বজনদের মাধ্যমে হাসপাতাল ভাঙচুর হয়। এমনকি ভুল বোঝাবুঝির কারণে মারামারি পর্যন্ত হয়। এটা অন্যায়। চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের অরক্ষিত রেখে কখনই রোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না। তাই এসব সমস্যার সমাধানে আমরা স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন করছি। আগামী সংসদেই আইনটা পাস করার চেষ্টা করব।
যা আছে স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের খসড়ায়
খসড়া আইনের ৬ ধারার ২ (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতাল প্রদত্ত সেবা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা মানসম্মত না হলে এবং এ আইন, বিধি বা নির্দেশ বা লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গের প্রকৃতি যদি এমন হয় যে ওই হাসপাতালকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া সমীচীন নয়, সে ক্ষেত্রে জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করে তাৎক্ষণিকভাবে সেটা বন্ধ করা যাবে।
আরও পড়ুন>>‘বিনামূল্যে’ সেবা দিতে ক্যান্সার হাসপাতাল বানাতে চান সাকিবরা
১০ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, সরকারি বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় কর্মরত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া ব্যক্তি নির্ধারিত অফিস সময়ে বা দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনকালে বেসরকারি হাসপাতাল বা ব্যক্তিগত চেম্বারে সেবা দিতে পারবেন না। একই ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে, ছুটির দিনে নিজ কর্মস্থলের বা জেলার বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে ফি নিয়ে সেবা দিলে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমতি নিতে হবে। তবে, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যেকোনো সময়ে অনুমতি স্থগিত বা বাতিল করতে পারবেন।
আইনের ২৫ ধারায় (অপরাধ ও দণ্ড) বলা হয়েছে, বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপনে কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা দুই বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া ব্যক্তিকে হুমকি, ভীতি প্রদর্শন, দায়িত্ব পালনে বাধা, আঘাত কিংবা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির ক্ষতিসাধন বা দখল করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা দুই বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। সরকার নিযুক্ত কোনো কর্মকর্তা বা কমিটিকে হাসপাতাল পরিদর্শন, তল্লাশি ও জব্দ করার কাজে বাধা দিলে ওই প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে তিন লাখ টাকা জরিমানা বা এক বছরের কারাদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।
ওই ধারায় আরও বলা হয়েছে, সরকারি বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় নিয়োজিত ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে বা পালাক্রমিক দায়িত্ব পালনকালে কোনো বেসরকারি হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে সেবা দিলে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড হবে; সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অফিস সময়ে বেসরকারি হাসপাতালে সেবাদানে নিয়োজিত করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড হবে; ব্যক্তির ক্ষেত্রে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হবে।
টিআই/এফকে