নির্দিষ্ট কিছু সেবা ছাড়া কোনো উপকরণই মেলে না হাওর এলাকার স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয়

* পিরিয়ডে অবলম্বন পুরোনো কাপড়
* প্যাডের নামই শোনেনি অসংখ্য কিশোরী
* দোকানেও রাখা হয় না প্যাড
* যৌনাঙ্গের সংক্রমণসহ জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি
* সচেতনতায় নেই উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ

কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার লাইমপাশা এলাকার বাসিন্দা রিমা খাতুন (২২)। হাওরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস হওয়ায় শিক্ষার সুযোগ যেমন হয়নি তেমনি স্বাস্থ্য সচেতনতারও কোনো বালাই নেই তার। পিরিয়ডের সময় পুরোনো কাপড়ই একমাত্র অবলম্বন রিমার। জীবনে কোনোদিন স্যানিটারি প্যাড দেখেননি, জানেন না প্যাডের নামও।

একই জেলার মিঠামইন উপজেলার চারিগ্রাম এলাকার কিশোরী সাদিয়া আক্তার (১৭)। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় তার কাছে প্যাড ব্যবহার বিলাসিতা। নাম শুনলেও কোনোদিন চোখে দেখা হয়নি এ বস্তু, ব্যবহার তো অনেক দূর!

এদিকে, সদর উপজেলার চৌদ্দশত এলাকার বাসিন্দা তাসলিমা সুলতানার (১৮) গল্প আবার ভিন্ন। জেলা শহরের কাছের এলাকায় বেড়ে ওঠায় পিরিয়ডের সময় শরীরের যত্ন নেওয়ার বিষয়ে তার ভালো ধারণা আছে। যদিও পরিবার ও সমাজে প্যাড ব্যবহার নিয়ে ‘ট্যাবু’ থাকায় নিয়মিত ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। হাতে যখন খরচের টাকা থাকে, তখন নিজেই কিনে ব্যবহার করেন।

ইটনা, মিঠামইন এবং নিকলী হাওরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় কিশোরীদের মধ্যে প্যাডের ব্যবহার খুবই কম। এক্ষেত্রে দাম বেশি, সামাজিক লাজলজ্জা এবং স্থানীয় বাজারগুলোতে সহজলভ্য না হওয়ায় পারিবারিক গুরুত্বহীনতা, প্যাডের বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা না থাকা এবং পুরোনো কাপড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে অসচেতনতাও বড় কারণ বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

যত প্রত্যন্ত অঞ্চল, প্যাড ব্যবহার তত কম

হাওর এলাকায় কিশোরীদের প্যাড ব্যবহারের বাস্তব চিত্র জানতে কিশোরগঞ্জ জেলার তিনটি উপজেলায় স্কুল-কলেজপড়ুয়াসহ অন্তত ৫০ জন কিশোরীর মধ্যে একটি জরিপ পরিচালনা করে ঢাকা পোস্ট। জরিপে এলাকা ভেদে প্যাড ব্যবহারে দুই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। প্রত্যন্ত এলাকায় প্যাড ব্যবহারের চিত্র খুবই ভয়াবহ। তবে উপজেলা শহরসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকায় তুলনামূলক ব্যবহার কিছুটা বেশি।

ইটনা উপজেলার লাইমপাশা, মৃগা, আমিরগঞ্জ এলাকায় ১৫ জন কিশোরীর সাথে কথা হয় ঢাকা পোস্ট প্রতিবেদকের, যাদের মধ্যে ১১ জনই কখনও প্যাড ব্যবহার করেনি। আর বাকি ৪ জন মাঝেমধ্যে ব্যবহার করলেও নিয়মিত ব্যবহার করেন না। যারা কখনই ব্যবহার করেনি তাদের কাছে ব্যবহার না করার কারণ জানতে চাইলে জানা যায়, ৬ জন এমন আছেন, যারা স্যানিটারি প্যাডের বিষয়ে কিছুই জানেন না, এমনকি কোনো দিন নামও শোনেননি। আর বাকিদের ব্যবহার না করার কারণগুলো মধ্যে প্রথম কারণ হলো দামি বেশি হওয়ায় প্যাড ব্যবহার ব্যয়বহুল এবং দ্বিতীয়ত পার্শ্ববর্তী বাজারগুলোতে প্যাড কিনতে পাওয়া যায় না।

নিকলী উপজেলার ছাতিরচর, দামপাড়া, জারইতলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্যাড ব্যবহারের প্রবণতা খুবই কম। ১৫ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ১২ জনই কোনো দিন প্যাড ব্যবহার করেননি। বাকি ৩ জন শখের বশে একাধিকবার কিনে এনে ব্যবহার করেছিলো, নিয়মিত না। যারা ব্যবহার করছে না, তারা বলছেন প্যাডের দাম বেশি। প্যাডের জন্য বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাওয়া তাদের কাছে লজ্জাজনক বলে মনে হয়। এদিকে, উপজেলার পার্শ্ববর্তী বাজারগুলোতে পাওয়া গেলেও দূরবর্তী গ্রামের বাজারে প্যাড কিনতে পাওয়া যায় না।

এদিকে মিঠামইন সদর উপজেলার চারিগ্রামসহ পাশের এলাকার ২০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যেকেই প্যাডের বিষয়ে জানলেও নিয়মিত ব্যবহার করে নিয়মিত প্যাড ব্যবহার করে ৮ জন, মাঝেমধ্যে ব্যবহার করে ৬ জন, ব্যবহার করে না বাকি ৬ জন। তবে, এর বাইরে সদর থানার সদর উপজেলার চৌদ্দশত এলাকায় ১০ জন স্কুল-কলেজপড়ুয়া কিশোরীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের মধ্যে নিয়মিত প্যাড ব্যবহার করে ৪ জন, মাঝেমধ্যে ব্যবহার করে ২ জন, প্যাড ব্যবহার করে না ৪ জন। যারা প্যাড ব্যবহার করে না তারা কাপড় ব্যবহার করে।

নিয়মিত প্যাড ব্যবহার করতে পারেন না তিন-চতুর্থাংশ কিশোরী

হাওরাঞ্চলে কিশোরীদের প্যাড ব্যবহার নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত কোন গবেষণা নেই। তবে শহর এবং গ্রাম এলাকার নারীদের তুলনামূলক প্যাড ব্যবহারের চিত্র নিয়ে বেশকিছু গবেষণা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজগামী কিশোরীদের (১৪-১৯ বছর) মধ্যে প্যাডের ব্যবহার ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশের মতো, আর জেলা শহরে ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে গ্রাম এবং শহর এলাকাগুলোতে সামগ্রিকভাবে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ কিশোরী নিয়মিত স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে। প্যাড ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ নারী মাঝেমধ্যে প্যাড আবার মাঝেমধ্যে কাপড় ব্যবহার করে। এছাড়াও নিয়মিত পুরাতন কাপড় ব্যবহার করে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, আর নিয়মিত নতুন কাপড় ব্যবহার করে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।

এতে বলা হয়েছে, তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি (৭৬ দশমিক ১%) কিশোরী মাসিকের সময় ঘরে প্যাড না থাকায় নিয়মিত স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে তারা হয় পুরোনো বা নতুন কাপড় ব্যবহার করেছে (৬৬ দশমিক ২%) বা অন্যদের থেকে স্যানিটারি প্যাড ধার করেছে (২৮ দশমিক ৪%) বা মাসিকের সময় অতিবাহিত করতে তারা অন্যান্য ব্যবস্থা নিয়েছে।

ঢাবির এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, কাপড় ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কিশোরী একই কাপড় পুনরায় ব্যবহার করেছে, যা প্রায় ৭১ দশমিক ১ শতাংশ। এদিকে, একই কাপড় পুনরায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রায় ৫৭ শতাংশ নারী তার কাপড় পরিষ্কারের জন্য পানি এবং সাবান ব্যবহার করেছে। শুধু পানি দিয়ে ধুয়ে পুনায় ব্যবহার করেছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী।

আরও বলা হয়েছে, পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে প্রায় সকলেই (৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ) মাসিকের সময় তাদের যৌনাঙ্গ ধুয়ে ফেলেছে। এরমধ্যে ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ তাদের যৌনাঙ্গ প্রতিদিন তিনবার ধুয়েছে, ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ চার বা তার বেশি বার ধুয়েছে, এবং ৮ দশমিক ৪ শতাংশ দিনে একবার ধুয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ যৌনাঙ্গ ধোয়ার জন্য শুধু পানি ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রে শহুরে মেয়েরা গ্রামের মেয়েদের তুলনায় দিনে চার বা তার বেশি বার তাদের যৌনাঙ্গ ধোয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল।

ফার্মেসিতে নেই প্যাড, বিক্রেতা বললেনকেউ কোনো দিন চায়নি

ইটনা উপজেলার ঢাকী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট বাজারে চারটি ওষুধের দোকান থাকলেও কোনটিতেই স্যানিটারি প্যাডের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি এক ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতার কাছে প্যাড চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এই প্রথম স্যানিটারি প্যাডের নাম শুনেছি’। অন্য আরেকটি ওষুধের দোকানে প্যাড না থাকার কারণ জানতে চাইলে বিক্রেতা বলেন, এই এলাকায় স্যানিটারি প্যাডের প্রচলন নেই। কারও কাছ থেকে কোনো দিন প্যাডের ব্যাপারে চাহিদাও আসেনি।

এ প্রসঙ্গে জসিম নামক এক দোকানি ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাওড় এলাকার অধিকাংশ মানুষই অশিক্ষিত। স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়ে তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ঢাকী ইউনিয়নের চারিগ্রাম বাজারে ফার্মেসিতে প্যাড পাওয়া না গেলেও 'সাজ সাজ ঘর' নামক কসমেটিকস দোকানে প্যাডের সন্ধান মিলে। এই প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রতিদিন আমার দোকানে আট-দশজন মেয়ে আসে প্যাড কিনতে। আমার এক থেকে দুই কার্টুন প্যাড বিক্রি হয়। বছর খানেক আগেও এতটা প্রচলন ছিল না। তখন মাঝেমধ্যে একজন-দুইজন আসতো, ফ্রিডম আর সেনোরা প্যাড ছিল তখন। এরপর আসল এসএমসি’র জয়া প্যাড। জয়ার মধ্যেই বেল্টসহ আবার বেল্ট ছাড়া আছে।

প্যাডের দাম জানতে চাইলে এই বিক্রেতা বলেন, ফ্রিডম বিক্রি করি ১০০ টাকা প্যাকেট, জয়া বড় প্যাকেট (বেল্ট ছাড়া) ৬০ টাকা, প্যাড থাকে ৮ পিস। সিঙ্গেল প্যাকেট আছে ৩৫ টাকা, ৫ পিস। জয়া (বেল্ট সিস্টেম) বড়টা ৭০ টাকা, ছোটটা ৪০ টাকা। সেনোরা ১০ পিসের প্যাড বিক্রি করি ১০০ টাকা। তবে সবমিলিয়ে জয়ার সিঙ্গেল প্যাকেটটাই চলে বেশি।

সচেতনতা নেই অভিভাবকদের মাঝেও

ঢাকী বাজারেই কথা হয় আমিনুল ইসলাম নামক এক অভিভাবকের সঙ্গে, যিনি কোনো দিন প্যাড নামক শব্দ বা নাম শোনেননি। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এই প্রথম আপনার কাছ থেকে এটার বিষয়ে জানলাম। এর আগে কোথাও কোনো আলোচনাও শুনিনি। পিরিয়ড চলাকালীন পরিবারের নারী সদস্যরা কী ব্যবহার করে জানতে চাইলে আমিনুল বলেন, আমি তো জানি পুরোনো কাপড়ই ব্যবহার করে। আমার মেয়ে আছে, সেও কোনো দিন বলেনি যে এমন কিছু তার লাগবে। আমার স্ত্রীর মুখেও কোনো দিন শুনিনি। এটা ব্যবহার করলে কী হয় বা না করলেই কী হয়, সেটাও আমার জানা নেই।

আরও পড়ুন : টাকা-উপহারে ‘বিক্রি হচ্ছেন’ চিকিৎসক, বাড়ছে ব্যয়!

গফুর মিয়া নামক আরেক ব্যবসায়ীর কাছে প্যাডের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিন মেয়ে বিয়ে দিয়েছি, আরও একজন ঘরে আছে। কোনো দিন তাদের মুখেও প্যাডের কথা শুনিনি। মাসিকের সময় শুধু জানি তারা পুরাতন কাপড়ই ব্যবহার করে।

কাপড় ব্যবহারে ঝুঁকির বিষয়ে জানেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটার কারণে কোন সমস্যা হয় কিনা জানি না। তবে মেয়ের মায়ের কাছে শুনেছি মাঝেমধ্যে সমস্যা হয় এবং ওষুধ কিনে এনে খায়। এসব সমস্যায় ওষুধের টাকাটাও কোনো দিন আমার কাছে চায়নি। মেয়ের মায়ের কাছে বললে সেই আমাকে বলে।

তবে মিঠামইন সদর এলাকায় বসবাসকারী ভাড়ায় চালিত এক মোটরসাইকেলের চালকের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি এর আগে জেলা শহরে একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি জানান, তার পরিবার প্যাডের বিষয়ে সচেতন। একমাত্র মেয়েকে কোনো দিন তিনি পুরোনো কাপড় ব্যবহার করতে দেননি। খোকন সরকার নামের এই অভিভাবক বলেন, মেয়ের যখন প্রয়োজন হয়, তখনই তার মাকে জানায়। আমিও আমার স্ত্রীকে বলে দিয়েছি বাসায় যেন অতিরিক্ত প্যাড নিয়ে রাখে। আমি এবং আমার পরিবার এ বিষয়ে সচেতন।

তিন মাস প্যাড নেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, চার বছরে বরাদ্দ ৪১৬টি

বর্তমানে সারাদেশে পরিবার পরিকল্পনার অধিদপ্তরাধীন ৩ হাজারের অধিক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন সহস্রাধিক ইউনিয়ন সাব সেন্টার রয়েছে। এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি স্যানিটারি প্যাডসহ বেশকিছু উপকরণ কিশোরীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরবরাহ করার কথা রয়েছে। তবে নিয়মিত কিছু স্বাস্থ্যসেবা ছাড়া আর কোনো উপকরণ নিয়মিত পাওয়া যায়নি হাওর এলাকার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলোতে।

এ বিষয়ে মিঠামইন উপজেলার ঢাকী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ফয়সাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত চার বছরে আমরা মাত্র ৪১৬টি স্যানিটারি প্যাড বরাদ্দ পেয়েছি, তাও সবগুলো ২০২২ সালে। গত বছরের ৪ অক্টোবর আমাদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্যাড শেষ হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন প্যাড আসেনি। এ বিষয়ে উপজেলায় যোগাযোগ করা হলে বরাদ্দ নেই বলে জানায়।

হাওর এলাকায় পুরোনো কাপড় ব্যবহারের ভয়াবহ চিত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী এলাকাগুলোর অসংখ্য কিশোরীই প্যাডের ব্যবহার ও সচেতনতা থেকে পিছিয়ে আছে। পার্শ্ববর্তী এলাকার মেয়েরা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়মিত আসতে পারলেও দূরের গ্রামগুলো থেকে তাদের জন্য আসা অনেকটাই কঠিন ব্যাপার। তাদের প্রায় অধিকাংশ প্যাডের পরিবর্তে পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে। আমাদের জায়গা থেকে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। সব সময় আমাদের কাছে প্যাড থাকে না। অনেকেই প্যাড নিতে এসে একাধিকবার ঘুরে যায়। তবে আমরা যদি নিয়মিত প্যাড সাপ্লাই পাই, তাহলে আরও বেশি কিশোরীদের মধ্যে আমরা এটি ছড়িয়ে দিতে পারব।

আরও পড়ুন : প্রতিরোধে মনোযোগ নেই, শুধু ওষুধ আর ওষুধ

ফয়সাল আহমেদ বলেন, হাওর এলাকায় এর আগে প্যাড ব্যবহার নিয়ে একদমই সচেতনতা ছিল না। তারা জানতও না প্যাডের ব্যাপারে। তবে, আমাদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিনামূল্যে প্যাড বিতরণ শুরুর পর থেকে কিছুটা ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে প্যাড নিয়ে কিশোরীদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ উৎসাহ দেখি। তাদের প্যাড শেষ হয়ে গেলেই আমাদের কাছে আসে এবং পরবর্তীতে আবারও কবে দেওয়া হবে এসব বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে যায়। এর মাধ্যমে বুঝা যায় প্যাডের চাহিদা আছে।

পুরোনো কাপড় ব্যবহারে নানা জটিলতা কিশোরীদের

পুরোনো কাপড় ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্য জটিলতা নিয়ে রোগীরা কেমন আসে, জানতে চাইলে ফয়সাল আহমেদ বলেন, মূত্রনালির সংক্রমণ, প্রস্রাবের সংক্রমণসহ এই ধরনের নানা সমস্যা নিয়েই আমাদের কাছে রোগীরা আসে। বেশি আসে মূত্রনালির সংক্রমণ নিয়ে। আমি গত এক মাসেই এই সংক্রমণ নিয়ে আসা ১০ জনের মতো কিশোরীদের চিকিৎসা দিয়েছি। প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫ জনের মতোই আসে। ১৩ থেকে ১৯ বছরের মেয়েরা ছাড়াও নানা বয়সী নারীরা আমাদের কাছে আসে। আমরা তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা এবং পরামর্শ দেই, বেশি সমস্যা থাকলে আমরা মিঠামইন সদর হাসপাতালে রেফার করে দেই।

কিশোরী ও অভিভাবকদের সচেতনতায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভূমিকা জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, কিশোর-কিশোরীদের সচেতনতায় আমাদের কিশোর-কিশোরী কর্নারে প্রতি সপ্তাহে একদিন (মঙ্গলবার) বিশেষ ক্লাস নেওয়া হয়। প্রতি ক্লাসেই ১০ থেকে ১৫ জন করে উপস্থিত থাকে। এছাড়াও আমরা উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসাররা প্রতিমাসে চারটি স্কুল ভিজিট করি। সেগুলোতে গিয়ে আমরা স্কুল স্বাস্থ্য শিক্ষা, বয়ঃসন্ধিকালে করণীয়, হাইজিন, বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাস নেই। হাওর এলাকার অভিভাবকরা এ বিষয়টি নিয়ে একেবারেই সচেতন নয়। তবে আমরা তাদেরকে ডেকে ডেকে যতটুকু সম্ভব কাউন্সেলিং করছি।

শহর, গ্রাম হাওরে প্যাড ব্যবহারে বড় পার্থক্য

শহর এবং গ্রাম এলাকার নারীদের তুলনামূলক প্যাড ব্যবহার নিয়ে গবেষণার অন্যতম সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জাকিউল আলম। গবেষণা প্রসঙ্গে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল শহর এবং গ্রামীণ এলাকায় হাইজিন প্র্যাকটিসটা খুঁজে বের করা। আমরা সেখানে দেখেছি নারীরা পিরিয়ডের সময় ঠিকমতো পানি ব্যবহার করে কিনা, প্যাড ব্যবহার করে কিনা, বা পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে কিনা, করলে সেটি ঠিক মতো ধোয়া হয় কিনা।

তিনি বলেন, গবেষণায় গ্রাম এবং শহরে প্যাড ব্যবহারে বড় একটি পার্থক্য উঠেছে। আর এই পার্থক্যের কারণ হলো শিক্ষার হার। যারা প্যাড ব্যবহার করে না, তাদের কেউ কেউ পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে, কেউ বা নতুন কাপড় ব্যবহার করে। এমনকি কারও ক্ষেত্রে আনহাইজেনিক (অস্বাস্থ্যকর) প্র্যাকটিসও পেয়েছি। তবে শহরাঞ্চলে প্যাডের প্র্যাকটিসটা মোটামুটি বেশি।

গবেষক বলেন, আমরা গ্রামাঞ্চলে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশের মতো প্যাড ব্যবহার পেয়েছি। তবে হাওর এলাকার চিত্র তো খারাপ হবেই। কারণ, ওই এলাকাটাকে বলাই হয়ে থাকে 'হার্ড টু রিচ এরিয়া'। এসব এলাকায় আশেপাশে বাজার-ঘাট নেই। শিক্ষার হার কম। মানুষের জীবনযাত্রা বেশ নিম্নমানের। যারাই প্যাডের বিষয়ে জানে, দুই-তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে প্যাড কিনে আনার চেয়ে তাদের কাছে কাপড় ব্যবহারটা স্বাচ্ছন্দ্যের। এছাড়াও গ্রামীণ এলাকায় আমাদের জরিপটি হয়েছে মূলত স্কুলগামী কিশোরদের মধ্যে, যারা মোটামুটি কিছুটা সচেতন। কিন্তু হাওড় এলাকাগুলোর অধিকাংশ কিশোরীই একটা সময়ের পর আর পড়াশোনাও করে না। ফলে তাদের মধ্যে সচেতনতার বার্তাগুলো পৌঁছেনি।

জাকিউল আলম বলেন, ব্যবহারকারীদের মধ্যে কেউ কেউ আছে নিয়মিত প্যাড ব্যবহার করে, কেউ কেউ আছে মাঝেমধ্যে ব্যবহার করে, বাকিরা প্যাডের পরিবর্তনে কাপড় ব্যবহার করে। গবেষণায় কাপড় ব্যবহারের ক্ষেত্রে একই কাপড় বারবার করে কিনা, এটা বড় বিষয় ছিল। আমরা দেখেছি, যাদের থেকে আমরা রেসপন্স নিয়েছিলাম, তাদের ৭১. ১ শতাংশ একই কাপড় পুনরায় ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন ছিল ধোয়ার ক্ষেত্রে সাবান বা অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার হয় কিনা, এক্ষেত্রে ভালো রেসপন্স পেয়েছি। শুধু পানি দিয়ে ধোয় ৭. ৪ শতাংশ।

তিনি আরও বলেন, কাপড় বা প্যাড ব্যবহারের ক্ষেত্রে দিনে কতবার পরিবর্তন করা হয়, এটিও একটি বড় বিষয়। দেখেছি যে দৈনিক ৩ বার বা তারও বেশি ৪৯ শতাংশ। দিনে দুইবার ৪০ শতাংশের মতো আর দিনে একবার পরিবর্তন করে ১০ শতাংশের মতো ছিল। এই চিত্রটা হাওড় এলাকায় গেলে হয়তো আরও খারাপ অবস্থা পাওয়া যাবে।

পুরোনো কাপড় ব্যবহারে যেসব ইনফেকশনের ঝুঁকি

পিরিয়ডকালীন নারীদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট গাইনিকোলজিস্ট ডা. ছাবিকুন নাহার। প্যাডের পরিবর্তনে পুরোনো কাপড় ব্যবহারে কী কী সমস্যা হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরোনো ও অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন (সংক্রমণ) দেখা দিতে পারে। যেমন- ইউটিআই ইনফেকশন (মূত্রনালির সংক্রমণ), ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন (যৌনাঙ্গের সংক্রমণ), ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (প্রস্রাবের সংক্রমণ)।

আরও পড়ুন : টিকায় সাফল্য, ডেঙ্গুতে নাজেহাল

তিনি বলেন, যৌনাঙ্গের সংক্রমণ হলে পরবর্তীতে ক্রনিক পেলভিক পেইন অর্থাৎ তলপেটে অনেক ব্যথা হয়। হাঁটা-চলা সবকিছুতেই ব্যথা অনুভব হয়। এর থেকেও ইনফার্টিলিটি দেখা দেয়। এছাড়াও তার পেইনফুল মিকচারেশন (ব্যথাযুক্ত প্রস্রাব) হবে। এছাড়াও স্বামীর সঙ্গে মেলামেশা করতেও তার ব্যথা হবে। সবসময়ই সে ব্যথা ব্যথা বলতে থাকবে। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে যে কাজগুলো আমরা করতে পারি, সেগুলোতে সে ব্যথা অনুভব করবে। এমনকি লাস্ট স্টেজে বাচ্চা আসতে সমস্যা হবে।

সমস্যার কারণ প্রসঙ্গে ডা. ছাবিকুন নাহার বলেন, কেউ যদি অনেকক্ষণ একই কাপড় ব্যবহার করে, সাবান দিয়ে ভালো করে না ধোয় এবং রোদে না শুকায়, তাহলে ইনফেকশন হওয়ার চান্স থাকে। যদি সে কাপড়টা ফেলে দেয় এবং নতুন কাপড় ব্যবহার করে তাহলে ইনফেকশনের ঝুঁকি কম। কিন্তু গ্রাম অঞ্চলে অনেকেই ব্যাপারটা জানে না।

'যেহেতু এটা নিয়ে গ্রাম্য মেয়েদের মধ্যে একটি আড়ষ্টতা কাজ করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মেয়েরা সেটি ভালো করে ধুচ্ছে না। বা ধুলেও সে মানুষের জন্য রোদে দিতে পারছে না, দিচ্ছে কোন স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায়। সেই জায়গাটিতে যদি ফাঙ্গাল ইনফেকশন থাকে, সেটি ব্যবহারের কারণে মাসিকের রাস্তায় ইনফেকশন হতে পারে। অনেক সময় এই ইনফেকশন মাসিকের রাস্তা দিয়ে উপরের দিকে গেলে নারীদের প্রজনন অঙ্গে শ্রোণিদেশ প্রদাহ জনিত রোগ বা পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (পিআইডি) হতে পারে। এমনকি সেখান থেকে পরবর্তীতে ইনফার্টিলিটিও (বন্ধ্যাত্ব) দেখা দিতে পারে।'

এটা ঠিক যে সবাই চাইলেই প্যাড ব্যবহার করতে পারবে না। বা এই মুহূর্তে সবার কাছে প্যাড পৌঁছে দেওয়াও সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে যারা কাপড় ব্যবহার করবে, তাদেরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হবে। নিয়মিত ব্যবহৃত কাপড়টি ভাল করে ধুতে হবে এবং সেটিকে রোদে ভালো করে শুকাতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় সব সময় নতুন কাপড় ব্যবহার করতে পারলে। একটি কাপড় ব্যবহারের পর সেটিকে ফেলে দিয়ে পরবর্তীতে নতুন কাপড় ব্যবহার করা। আমরা বলি যে, ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা পরপর কাপড়টি পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে কারো যদি ঋতুস্রাবের মাত্রা বেশি হয়, তাহলে দুই ঘণ্টা পরপরও কাপড় পরিবর্তন করা লাগতে পারে।

সচেতনতার ঘাটতি, নেই জোরালো পদক্ষেপ

ডা. ছাবিকুন নাহার আরও বলেন, আমাদের গাইনি চিকিৎসকদের কাছে যত রোগী আসে, সেগুলোর প্রায় ৪০ শতাংশই পিরিয়ড সংক্রান্ত সমস্যা নিয়েই হয়। একজন মা থেকে মেয়ে, সবাইকেই পিরিয়ডকালীন সময়ে একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শহরাঞ্চলে বিষয়টি নিয়ে মোটামুটি সচেতনতা থাকলেও মফস্বল এলাকাগুলোতে হাইজিন, মাসিক ব্যবস্থাপনা, নিয়ে কোন সচেতনতা নেই। এসব এলাকার অধিকাংশ মেয়েই জানে না সে সময়ে কীভাবে কী করতে হয়। এমনকি তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জোরালো কোন প্রয়াসও নেই। এটা নিয়ে দেশে তেমন বই পত্র নেই, ওরকমভাবে কেউ বলেও না।

ঢামেকের এই নারী চিকিৎসক আরও বলেন, সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে দায়িত্বটা নিতেই হবে আমাদেরকেই। পরিবারের শিক্ষিত বড়রা যারা আছেন, তাদেরকে কথা বলতে হবে। এটা আসলে লুকিয়ে রাখার মত কোন বিষয় না। অসংখ্য মেয়েরা জানি না যে প্যাড নামক একটা কিছু আছে, যা ব্যবহার করা যায়। এখন আপনি আমি কথা বলে এটাকে কতটুকু ছড়াবো, কথা বলতে হবে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে।

করণীয় প্রসঙ্গে ডা. ছাবিকুন নাহার বলেন, আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কাজে লাগাতে পারি। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এই বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। আমি যেহেতু বিষয়টি নিয়ে কাজ করি, আমি বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইগুলো দেখে জানার চেষ্টা করেছি যে পিরিয়ডকালীন ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু আছে কি না। কিন্তু এমন কোন শ্রেণি নাই যেখানে এই বিষয়টা নিয়ে অন্তত আলাদা একটা টপিক বা প্যারা রয়েছে। আমার তো মনে হয় একটি ছেলে এবং মেয়ে যখন বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত হয়, তাদের প্রতিটি ক্লাসেই এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলা উচিত। তা না হয় আমাদের ছেলেমেয়েরা এ বিষয়গুলোতে অভ্যস্ত হবে না। প্রতিনিয়ত মানুষ এভাবে নানা রোগে উপমিত হতে থাকবে এবং দিন দিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।

দাম বেশি বলে কাপড় ব্যবহার যৌক্তিক নয় : এসএমসি

দাম বেশি হওয়ায় হাওর এলাকায় অনেকে প্যাড ব্যবহার করছে না— এমন প্রসঙ্গে জয়া প্যাড প্রস্তুতকারী এসএমসি’র ডেপুটি ম্যানেজার লাইলা নূর নিশি বলেন, আপনি যদি অন্যান্য কোম্পানির সাথে আমাদের কোয়ালিটি দেখে দামের তুলনাটা করেন, তাহলে দেখবেন যে আমাদের ধারেকাছেও কেউ নেই। অন্যান্যদের তুলনায় আমাদের প্যাডের দাম অনেক কম। এক্ষেত্রে যারা বলে টাকার জন্য প্যাড ব্যবহার করতে পারছে না, এটা মনে হয় খুব বেশি যৌক্তিক কারণ নয়। এক মাসে ৩০/৪০ টাকা জোগাড় করা আমি মনে করি কোন মেয়ের জন্যই কঠিন কোনো বিষয় নয়।

তিনি বলেন, আমি মনে করি এটা নিশ্চয়ই সচেতনতার ঘাটতি। কারণ, যে মেয়েটা টাকার জন্য প্যাড ব্যবহার করছে না সে ঠিকই দুইটা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ব্যবহার করছে। অথচ দুইটা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর চেয়ে তার ভালো থাকার জন্য স্যানিটারি প্যাডটা বেশি জরুরি। আমাদেরকে এই সচেতনতার জায়গাটায় আরও কাজ করতে হবে। দেখা গেলো যে, গ্রামের একটা মেয়ে ঠিকই তার বাবার কাছে তার জামাকাপড়, প্রসাধনীর বিষয়ে চাহিদার কথা জানাচ্ছে, কিন্তু প্যাডের বিষয়টা লজ্জায় বলছে না। এমনকি এই কারণে সে ব্যবহারও করছে না। কিন্তু সে তো নিজে বলতে না পারলেও তার মায়ের কাছে বলতে পারে। আমি মনে করি, শুধু মা নয়, বাবার সাথেও এই বিষয়গুলো আলোচনায় আসা উচিত। আমরা এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করছি। সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবাইকেই এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

প্যাডের দাম হ্রাসের কোন পরিকল্পনা আছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে প্যাডের দাম কমানোর কোন সুযোগ নেই। কারণ, ডলারের মূল্য বেড়েছে, কাঁচামালের দাম বেড়েছে, মজুরি বেড়েছে, সবমিলিয়ে আমরা যে খুব ভালো আছি তা নয়।

লাইলা নূর বলেন, হাওড়সহ দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে প্যাড ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আমরাও জানি সারাদেশের মধ্যে প্যাড ব্যবহারের ক্ষেত্রে হাওর এলাকাগুলো অনেকটা পিছিয়ে। এর প্রধান কারণ হলো যোগাযোগব্যবস্থার সমস্যা। হাওড়ে একটি গ্রাম থেকে অন্য আরেকটি গ্রাম বা একটি বাজার থেকে অন্য আরেকটি বাজারের দূরত্ব অনেক বেশি। পাশাপাশি রাস্তাঘাট এবং যানবাহন স্বল্পতায় মেয়েরা বাজার থেকে গিয়ে পেট সংগ্রহ করতে পারে না। আরেকটা বিষয় হলো ওই এলাকাগুলো সামগ্রিকভাবে অনেকটাই অনুন্নত এবং শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে। এক্ষেত্রে প্যাড ব্যবহার না করায় সচেতনতার অভাবও একটি বড় কারণ।

সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস

হাওরাঞ্চলে প্যাডের স্বল্পতা, পুরোনো কাপড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা স্বীকার করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (এমসিএইচ, এআরএইচ) ডা. মনজুর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রদানটা আসলে আমাদের কার্যক্রমে ঢুকানো হয়েছে গত তিন/চার বছর ধরে। এখনও আমাদের কাছে সর্বমোট যে চাহিদা আসে, সে অনুযায়ী আমরা দিতে পারছি না।

আরও পড়ুন : নিপাহ ভাইরাস ‘মারাত্মক সংক্রামক’, ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু

তিনি বলেন, আমাদের মূলত প্রতি ৫ বছর পরপর ওপি (অপারেশনাল প্ল্যান) হয়। সেখানে পরবর্তী ৫ বছরের জন্য চাহিদাপত্র তৈরি করা হয়। সম্প্রতি আমাদের পূর্ববর্তী ওপি কার্যক্রম শেষ হয়েছে। নতুন করে আবারও ওপি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এই ওপিতে আমরা চাইব যেন এই খাতে আরও বেশি করে বরাদ্দ রাখা যায়। ইতোমধ্যে আমাদের স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান সম্পন্ন হয়েছে, এখন আমরা আগামী ৫ বছরের জন্য কী পরিমাণ প্যাড লাগবে সেটি আমরা নির্ধারণ করে সরকারের কাছে অনুমোদন চাইব। সরকার সে অনুযায়ী আমাদেরকে একটা ফান্ড (অর্থায়ন) দেবে।

ডা. মনজুর হোসেন বলেন, আমরা যখন আমাদের বিভিন্ন সেন্টারে স্যানিটারি প্যাড ডিস্ট্রিবিউট করি, তখন প্রতিটি সেন্টারেই সমানভাবে দেওয়ার চেষ্টা করি। এর মধ্যে যদি কোনো সেন্টারে প্যাড শেষ হয়ে থাকে, তাহলে নিয়ম হলো সে জায়গা থেকে আমাদের কাছে একটা রিকুইজিশন (চাহিদাপত্র) দিতে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের অপি থেকে হয়তো আমরা একটা বরাদ্দ দিতে পারবো। এটা অনেকটা নির্ভর করে ডিমান্ড এবং সাপ্লাইয়ের ওপর। আমরা সাধারণত কোন জায়গা থেকে রিকুইজিশন পাওয়ামাত্রই সেখানে প্যাড দেওয়ার চেষ্টা করি।

সচেতনতার তাগিদ দিয়ে তিনি আরও বলেন, শুধু বিনা মূল্যে প্যাড সরবরাহ করেই স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনা যাবে না। এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হতে পারি। আর আমরা যে শুধু কিশোরীদের মধ্যে প্যাডই সরবরাহ করি তা কিন্তু নয়, প্যাড ব্যবহার নিয়ে, পিরিয়ডকালীন নানা জটিলতাসহ নানা বিষয়ে আমাদের সচেতনতা কার্যক্রমও আছে। আমরা অভিভাবকদেরও বিষয়টি নিয়ে সচেতন করে থাকি। হয়তো আমরা যতটুকু চাহিদা, ততটুকু পারি না, তবে আমাদের সর্বোচ্চটা আমরা করে থাকি। এক্ষেত্রে হাওর অঞ্চলসহ গ্রামীণ বিভিন্ন এলাকাতেই আমাদের জনবলের সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা যদি আরও বেশি জনবল দিতে পারি, তাহলে প্রতিটি কার্যক্রমই আরও বেশি গতিশীল হবে।

টিআই/এমএআর