‘ধূমপানের আসক্তি দূর করতে ই-সিগারেটের ব্যবহার’ -এমন প্রচারণার কারণে থেকে দেশে গত কয়েক বছরে ই-সিগারেটের প্রতি ঝুঁকছে তরুণ-সমাজ। তবে, ই-সিগারেটসহ সব ইমার্জিং টোব্যাকো পণ্যই স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তরুণদের মধ্যে যারা এসব পণ্যে আসক্ত, তাদের মধ্যে নতুন করে সিগারেট শুরুর সম্ভাবনা দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ, ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি প্রোডাক্টগুলো তামাকপণ্য ব্যবহারের ‘গেটওয়ে’ হিসেবেও কাজ করে বলে জানায় সংস্থাটি। এই অবস্থায় তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে হলে ই-সিগারেট এখনই পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা সরাসরি নিকোটিনের সংস্পর্শে আসেন এবং এটি কিশোর মস্তিষ্ক বিকাশে বাধাগ্রস্ত করে। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের বিকাশে এটি নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ই-সিগারেটে অ্যাসিটালডিহাইড (সম্ভাব্য কার্সিনোজেন), ফরমালডিহাইড (পরিচিত কার্সিনোজেন), অ্যাক্রোলিন (টক্সিন) এবং নিকেল, ক্রোমিয়াম ও সিসার মতো ধাতুসহ কমপক্ষে ৮০টি ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাজারে ১৬ হাজার ধরনের স্বাদ/গন্ধযুক্ত (ফ্লেভার) ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে এসব পণ্যের ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে

মূলত তরুণ এবং শিশুদের টার্গেট করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস উৎপাদন ও বাজারজাত করছে তামাক কোম্পানিগুলো। উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার ও আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্যের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে, দেশে ই-সিগারেট বিক্রি নিয়ন্ত্রিত না হওয়ায় ক্ষতিকারক এসব পণ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের হাতে এটি নিয়ন্ত্রণের কোনও নিয়ন্ত্রক যন্ত্র না থাকায় তরুণ-তরুণীরা ভ্যাপ করে নিকোটিনে জড়িয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট ব্যবহারে প্রকৃত কোনও চিত্র পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, দেশে তরুণদের মধ্যে এসব পণ্যের ব্যবহার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে- ২০১৭ অনুসারে, ৬.৪ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্কই ই-সিগারেটের বিষয়ে অবগত, ০.৪ শতাংশ কখনও ব্যবহার করেছেন এবং ০.২ শতাংশ ব্যবহার করেছেন।

২০২০ সালে ঢাকা আহসানিয়া মিশন পরিচালিত ঢাকা শহরের কয়েকটি বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের বেশির ভাগই জানেন না ই-সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ই-সিগারেটের বিভিন্ন ফ্লেভারের কারণে তরুণরা সহজেই আকৃষ্ট হচ্ছে।

গবেষণায় দেখা যায়, বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী (৬৫ শতাংশ) স্বাদের কারণে ই-সিগারেট ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। স্টাইলের কারণে অনেকে ই-সিগারেট ব্যবহার করছেন বলেও জানা যায়। আবার অনেক অংশগ্রহণকারী ই-সিগারেট তাদের প্রচলিত সিগারেট ছাড়তে সাহায্য করতে পারে ভেবে এটা নিচ্ছেন বলে জানান। অংশগ্রহণকারীরা ই-সিগারেটকে প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় স্বাস্থ্যের জন্য কম ক্ষতিকর বলে মনে করেন। ই-সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়ার মাধ্যমে রিং তৈরি করার কৌশল ও তা প্রদর্শন করা পুরুষ উত্তরদাতাদের মধ্যে একটি সাধারণ কারণ ছিল।

ই-সিগারেট ব্যবহারে নিকোটিনের আসক্তি জন্মায়
বাংলাদেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসের (ই-সিগারেট, ড্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোভাই ইত্যাদি) ব্যবহার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়লেও এগুলো নিয়ন্ত্রণে/বন্ধে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তবে সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করেছে যেখানে ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং), হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ এ ধরনের সব পণ্য নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে। 

প্রস্তাবনায় ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কেউ আইনের ধারা লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। পাশাপাশি, যেকোনো ব্যক্তির জন্য এসব পণ্যের ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এই বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।

আইনের সংশোধনীর যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-সিগারেট ব্যবহারের মাধ্যমে নিকোটিনের আসক্তি জন্মায়। তাই এটিও ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই ধরনের পণ্যের ব্যবহার বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে দিন দিন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে হলে এটি এখনই পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। 

তারা বলছেন, এফসিটিসি অনুচ্ছেদ ৫.২ অনুসারে এতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর জন্য ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম বা ই-সিগারেট উৎপাদন, আমদানি, বিতরণ, বিক্রয় এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করা বাধ্যতামূলক। ইতোমধ্যেই ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ৩২টি দেশ এসব পণ্য নিষিদ্ধ করেছে।

ফুসফুসের সংক্রমণ ও অসুস্থতা বাড়ায় ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস

ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট ২০১৬ এ ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সব পণ্যকে 'অনিরাপদ' বলে অভিহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং-সৃষ্ট শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে মহামারির আকার ধারণ করলে এই ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসগুলোর সত্যিকারের চেহারা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ফুসফুসজনিত রোগে ভর্তি হওয়া মোট ২ হাজার ৮০৭ জন রোগী এবং এরমধ্যে ৬৮ জনের মৃত্যুর সঙ্গে ই-সিগারেট/ভ্যাপিংয়ের যোগসূত্র থাকার কথা নিশ্চিত করেছে।

ইউএসএ সিডিসির মতে, ই-সিগারেট অ্যারোসল ক্ষতিকারক জলীয়বাষ্প নয়। তবে, ই-সিগারেট অ্যারোসল যা ডিভাইস থেকে শ্বাস নেয় এবং শ্বাস ছাড়ে তাতে ক্ষতিকারক এবং সম্ভাব্য ক্ষতিকারক পদার্থ থাকতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে- নিকোটিন, অতি সূক্ষ্ম কণা যা ফুসফুসের গভীরে শ্বাস নেওয়া যায়, উদ্বায়ী জৈব যোগ, ক্যানসার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক, ভারী ধাতু (যেমন নিকেল, টিন এবং সিসা)।

তামাক কোম্পানিগুলো প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় ই-সিগারেটকে ৯৫ শতাংশ নিরাপদ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। ৯৫ শতাংশ নিরাপদ শব্দটি ২০১৪ সালে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড দ্বারা প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে বাছাই করা হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের সাবেক প্রধান ওষুধ উপদেষ্টা ডেভিড নট। তবে পরবর্তী সময়ে এই নটকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, কারণ তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি এক্সট্যাসি বা মেথিলিন ডিঅক্সি মেথামফেটামিন এবং এলএসডি (লিসারজিক অ্যাসিড ডায়থাইলামাইড) অ্যালকোহলের চেয়ে নিরাপদ।

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের চিত্র ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে-২০১৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ (৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন, যাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ পুরুষ এবং নারী ২৫ দশমিক ২ শতাংশ। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২ কোটি ২০ লাখ (২০.৬ শতাংশ) এবং ধূমপায়ী ১ কোটি ৯২ লাখ (১৮ শতাংশ)। 

এদিকে, গ্লোবাল স্কুল বেইজড স্টুডেন্ট হেলথ সার্ভে বাংলাদেশ-২০১৪ রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯.২ শতাংশ, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে। 

২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ : এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ' শীর্ষক গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

তারুণ্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন তামাক কোম্পানির মূল টার্গেট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসের ব্যবহার তরুণ সমাজের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রাস্তাঘাট, ক্যাম্পাস, তরুণদের আড্ডাস্থল, বিভিন্ন মার্কেট এবং রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা ভ্যাপিং ক্লাবে এসব পণ্যের ব্যবহার ব্যাপকহারে চোখে পড়ছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বিক্রয় কেন্দ্র। অনলাইন এবং ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট সামগ্রী নিয়ে আলোচনা, বিক্রয় ও হাতবদল হচ্ছে।

সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪৮ শতাংশই তরুণ, যাদের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। ১৫ অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সময়কাল অতিবাহিত করছে যেখানে, নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর তুলনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ বছর দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।

আব্দুল হামিদ বলেন, একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং ইতিবাচক পরিবর্তনে তরুণ জনগোষ্ঠীর অবদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। তামাক কোম্পানিগুলোও সুযোগ কাজে লাগিয়ে এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে যেকোনো উপায়ে তামাকপণ্য ও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টে আসক্ত করে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং মুনাফা বৃদ্ধি করতে চায়। এজন্য তারা ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট ইত্যাদিকে সিগারেটের ‘নিরাপদ’ বিকল্প হিসেবে ভোক্তা এবং নীতিনির্ধারকদের সামনে উপস্থাপন করে থাকে।

দেশে ই-সিগারেট প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায় রোধ করা সহজ হবে
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ই-সিগারেটকে ধূমপান ছাড়ার জন্য ব্যবহার হয়। শুধুমাত্র যারা ছাড়তে চায় তারা এটা ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের দেশে এখন এটা ফ্যাশনের মতো হয়ে গেছে। অসংখ্য তরুণ ছেলে-মেয়ে ই-সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপান জগতে প্রবেশ করছে। 

তিনি বলেন, একটা ছেলে যখন ই-সিগারেটের মাধ্যমে প্রথম প্রথম নিকোটিনে আসক্ত হবে, কখনও হয়তো এটাই নিয়মিত ব্যবহার করবে, অন্যথায় সে সিগারেট বা অন্য নেশার দিকে আসবে। এর জন্য আমরা বলি, আমাদের দেশে যেহেতু এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, সেহেতু এটাকে রোধ করা দরকার। এজন্য পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ যেভাবে এটাকে নিষিদ্ধ করেছে সেভাবে আমাদের দেশেও নিষিদ্ধ করা দরকার।

সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, যারা স্মোকিং করে, তাদের একটা নিকোটিনের আসক্তি ঘটে। আমরা ই-সিগারেটের মাধ্যমে যদি নিকোটিনটা দিতে পারি, আস্তে আস্তে সে সিগারেট ছেড়ে দেবে এবং পরে পর্যায়ক্রমে ই-সিগারেট ছেড়ে দেবে। এটাই প্রথম দিকেই সিগারেটের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে নিকোটিনের অ্যাডিকশনটা ই-সিগারেটের মাধ্যমে বজায় থাকছে। এমনকি সিগারেটের পাশাপাশি সে সিগারেট খাচ্ছে ও নিকোটিনের আসক্তি রয়েই গেছে।

তিনি আরও বলেন, এটা ঠিক সিগারেটে যে ক্ষতি হয়, ই-সিগারেটে হয়তো কিছুটা কম হতে পারে। কারণ সিগারেটের যে কেমিক্যালগুলো বার্ন হয়, সেটা ই-সিগারেটে হচ্ছে না। তবে, নিকোটিনের অ্যাডিকশনটা ঠিকই রয়ে যাচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। এছাড়াও ই-সিগারেটের ভ্যাপার তৈরি করার জন্য অন্যান্য যে কেমিক্যালগুলো ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলোও কিন্তু আমাদের শরীরের ভেতরে যাচ্ছে।

স্কুল-কলেজের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক বিক্রির দোকান থাকবে না

ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, প্রথমত আমরা চাই এটার বিপণন, বিতরণ ও ইমপোর্ট টোটালি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হোক। এক্ষেত্রে গভর্নমেন্ট মনিটর করবে যে কাজটি ঠিকমত হচ্ছে কি-না। আমরা চাই স্কুল-কলেজের ১০০ মিটারের মধ্যে কোন দোকান থাকবে না, যেখানে সিগারেট, ই-সিগারেট বা তামাকজাত কোনও পণ্য বিক্রি করা হবে। এ বিষয়টা শক্ত করে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। নয়তো আমাদের ছোট-ছোট বাচ্চারা খুব সহজেই আসক্ত হয়। যেমন, কোনও শিক্ষার্থী যদি স্কুল থেকে বেরিয়ে কাউকে দেখে যে খুব আয়েশ করে ই-সিগারেট টানছে আর মুখভর্তি ধোয়া ছাড়ছে, এতে করে কিন্তু সেও একসময় আগ্রহী হয়ে উঠবে।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ই-সিগারেটকে দেশ নিয়ন্ত্রণ করবে এবং কোনও অবস্থাতেই নন-স্মোকার, প্রেগন্যান্ট উইমেন এটা ব্যবহার করবে না। বিশেষ করে নন- স্মোকার যারা আছে, তারা যেন এটা ব্যবহার করতে না পারে সে লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে। একসঙ্গে স্মোকারদের মধ্যে যারা স্মোকিং ছেড়ে দিতে চায়, তাদের জন্য ই-সিগারেট বিষয়ক একটি নিয়ম ধরে ব্যবহারের পর এটা আস্তেধীরে ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনও নির্দেশনা মানা হচ্ছে না।

ই-সিগারেট হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকির কারণ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নিয়ে এখনও তেমন কোনও গবেষণা হয়নি। তবে নিকোটিন অ্যাডিকশন যেহেতু আছে, সেক্ষেত্রে এটা অনেক রোগের কারণ হতে পারে। এমনকি এক পর্যায়ে গিয়ে হৃদরোগেরও কারণ হতে পারে।

ধূমপান-তামাকের ব্যবহার অসংক্রামক রোগের প্রধান ঝুঁকির কারণ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেন আমিন বলেন, দেশে বর্তমানে হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ অসংক্রামক রোগগুলো উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মোট মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশের কারণ এ সব অসংক্রামক রোগ। উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের জন্য ধূমপান ও তামাকের ব্যবহার অন্যতম প্রধান ঝুঁকির কারণ। এই ঝুঁকি নির্মূলের জন্য বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী-২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সবাই সমন্বিতভাবে সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গভীর উদ্বেগের সঙ্গে প্রচলিত তামাক পণ্যসমূহের বাইরে আধুনিক কিছু পণ্যের প্রচলন পর্যবেক্ষণ করছে এবং সময়োপযোগী যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্যের ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে। ই-সিগারেট এমনই একটি নতুন প্রজন্মের তামাকজাত পণ্য। ব্যাটারি চালিত এই যন্ত্রের মাধ্যমে আরও কিছু কেমিক্যালসহ তামাকের নির্যাস বা নিকোটিনকে বাষ্পীভূত করা হয় যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করা যায়। নিকোটিন ছাড়া এতে সরাসরি ব্যবহৃত কেমিক্যালসমূহের মধ্যে থাকে প্রোপাইলিন গ্লাইকল, গ্লিসারল এবং বিভিন্ন ফ্লেভার।

রোবেদ আমিন বলেন, নিকোটিন একটি উচ্চমাত্রার আসক্তিকর কেমিক্যাল এবং এর ব্যবহারে হৃৎস্পন্দন ও রক্তচাপে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। গর্ভবতী নারী ও শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে নিকোটিনের ব্যবহার শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ই-সিগারেটে ব্যবহৃত কেমিক্যালসমূহ খাদ্যমান সম্পন্ন হলেও দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসতন্ত্রে ঝুঁকির কারণ আশঙ্কায় জনস্বাস্থ্যের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। এছাড়াও ই- সিগারেটে ব্যবহৃত তরল বাষ্পীভূত করার ফলে ফরমালডিহাইড উৎপন্ন হয়, যা ক্যান্সারের কারণ। গবেষণায় ই-সিগারেটের বাষ্পে সিসা, নিকেল, ক্রোমিয়ামসহ অন্যান্য ভারী ধাতুর উপস্থিতিও প্রমাণিত হয়েছে, যা ক্যান্সারসহ নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ।

মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পূর্ণ সমর্থন
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেন আমিন বলেন, শিশু-কিশোরদের ই-সিগারেটের প্রতি আগ্রহ এবং ই-সিগারেট নিয়ে শুরু করে পরে ধূমপানে আসক্তি, যা যুক্তরাষ্ট্রে প্রমাণিত, এই ক্ষেত্রে আরও একটি বিশেষ উদ্বেগের বিষয়। ই-সিগারেট বাজারজাতকরণে কোম্পানিগুলির শিশু-কিশোরদের চিত্তাকর্ষক বাজারজাতকরণ কৌশল এবং প্রতিষ্ঠিত তামাক কোম্পানিগুলির ই-সিগারেট ব্যবসায় সম্প্রসারণ এই উদ্বেগকে আরও বৃদ্ধি করে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে ই-সিগারেটের উৎপাদন-বিপণন নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে। মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত সংশোধনীর প্রতি স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরের পূর্ণ-সমর্থন রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সার্বিক বিবেচনায় জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও ভবিষ্যৎ প্রজনকে নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশে ই-সিগারেটের বাজার নিয়ন্ত্রণে এর আমদানি, ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবনার পাশাপাশি এর সম্প্রসারণে সহায়ক সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সংবাদে প্রচারিত বাংলাদেশে ই-সিগারেট কারখানা স্থাপনে বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং জনহিতকর পণ্য উৎপাদনে বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদানের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে।

টিআই/এসএম