দেশে স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগে ভুগছে প্রায় ৩ কোটি মানুষ। যাদের ঘুমের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এশিয়া মহাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ইউরোপ-আমেরিকার ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ মানুষ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত। চিকিৎসকেরা মনে করেন, এই রোগটি মানুষের জন্য গুপ্তঘাতক।

রোববার (২৭ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর হোটেল প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে স্লিপ অ্যাপনিয়া বিষয়ক এক আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানান।

আলোচকরা বলেন, বয়স অনুযায়ী মানুষের ঘুমের প্রয়োজনীয় সময় ভিন্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের পরামর্শ অনুযায়ী ৬ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের রাতে অন্তত ৯-১১ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ৮-১০ ঘণ্টা এবং ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের রাতে ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ৬৫ বছরের চেয়ে বেশি বয়সীদের জন্য ঘুমানো প্রয়োজন ৭-৮ ঘণ্টা। অনেকেই এর চেয়ে কম ঘুমিয়েও সুস্থ থাকতে পারেন। তবে এর নানাবিধ ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। ঘুমের সমস্যাজনিত বিভিন্ন রোগের মধ্যে স্লিপ অ্যাপনিয়া অন্যতম। দীর্ঘ মেয়াদি স্লিপ অ্যাপনিয়া একজন মানুষের মৃত্যুর কারণও হতে পরে। 

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রখ্যাত নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এই রোগে আক্রান্ত বেশিভাগ মানুষই জানেন না তারা এই রোগে আক্রান্ত। অনেকে স্লিপ অ্যাপনিয়া জনিত রোগকে বয়সজনিত স্বাভাবিক রোগ মনে করেন। ফলে তারা চিকিৎসকের কাছে আসেন না। 

তিনি বলেন, বেশিরভাগ মানুষ এটি যে একটি মারাত্মক রোগ তাই জানেন না। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। এ অবস্থায় সচেতনতা তৈরি জরুরি। এ সময় স্বাস্থ্যখাতে সরকারের নানা উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে চিকিৎসকদের আরও মানবিক আচরণের পরামর্শ দেন অধ্যাপক প্রাণ গোপাল।

অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, স্লিপ অ্যাপনিয়া একটি মারাত্মক রোগ। আমাদের দেশে এখন এ রোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। বিএসএমএমইউতে ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে স্লিপ অ্যাপনিয়া শনাক্ত ও অবস্থা নির্ণয় করা হয়। এটির ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এ লক্ষ্যে চিকিৎসক সমাজ ও গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে।
     
অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, মানুষ তার জীবনের এক তৃতীয়াংশ ঘুমিয়ে কাটায় কিন্তু ঘুম মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ। একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। ঘুমের অভাবে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস হৃদরোগ ব্রেন স্ট্রোক বন্ধ্যাত্ব ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ এবং মানসিক ব্যধিতেও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। 

তিনি বলেন, পৃথিবীতে করোনার আগে ৫৫ শতাংশ মানুষ এবং করোনার পরে ৭৭ শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব অথবা ঘুমের জটিলতা ভুগছেন। তার মধ্যে ২৪ থেকে ২৯ শতাংশ মানুষ নাক ডাকেন, আর স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগে ভুগছেন।

স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এতে আক্রান্ত রোগীদের ঘুমের মধ্যে প্রতি ঘণ্টায় ৫ বারের বেশি ১০ সেকেন্ডের জন্য দম বন্ধ হয়ে যায়। গিনেস বুক অব রেকর্ডসে না ঘুমানোর কোন রেকর্ড করা যাবে না বলে নিষেধ করা আছে। ঘুমের অভাবে মানুষ মাত্র ১১ দিন বাঁচতে পারে। অথচ না খেয়ে বাঁচতে পারে ৬৬-৭৭ দিন। প্রতিবছর আমেরিকাতে ৪১১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয় ঘুমের সমস্যার কারণে, ৮০ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে প্রতি বছর, চেরনোবিল ও থ্রি মাইল নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটেছিল কর্মরত ব্যক্তিদের ঘুমিয়ে পড়ার কারণেই।

মনিলাল আইচ লিটু আরও বলেন, ৮০ শতাংশ স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগী সারাজীবন বুঝতে পারে না যে তিনি একটি ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত। এ অবস্থায় ২০১৪ সালে আমরা এ সংগঠন তৈরি করি। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য স্লিপ অ্যাপনিয়া সু-চিকিৎসা ব্যবস্থা ও জনসচেতনতা তৈরি করা।

অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এসএম খোরশেদ আলম মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিতি ছিলেনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান।

এমএইচ/এসকেডি/এনএফ