বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি আক্রান্ত কোনো শিশুকে জিন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে এ চিকিৎসা দেওয়া হবে। বেসরকারি পর্যায়ে এটি করতে গেলে খরচ পড়ত ২২ থেকে ২৩ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিন থেরাপির মাধ্যমে এ চিকিৎসা সম্পন্ন হলে এটি হবে দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য বড় একটি মাইলফলক।

চিকিৎসকরা বলছেন, স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি একটি জিনগত রোগ। যেসব ছেলে শিশু বাবার কাছ থেকে এ জিন পায়, তারা ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে। এ রোগে শিশুদের পেশি দুর্বল ও শক্ত হয়ে যায়। ফলে সামান্য নড়াচড়াতেও অসুবিধা হয়। মস্তিষ্ক, শিরা ও মেরুদণ্ডের কোষ ক্ষয় হতে থাকে। মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে পেশিতে কাজের সংকেত পাঠানো বন্ধ করে দেয়। যত দিন যায় সমস্যা তত বাড়তে থাকে।

দেশে স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফির চিকিৎসা শুরু ‘আশাব্যঞ্জক’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি একটি বিরল ও জটিল স্নায়ুতন্ত্রের জন্মগত রোগ। জেনেটিক কারণে এটি হয়ে থাকে। বিগত শতকে এর কোনো চিকিৎসা ছিল না। ফলে সারা পৃথিবীতে অসংখ্য শিশু মৃত্যুবরণ করেছে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা বসতে বা দাঁড়াতে পারে না। তবে, তাদের বুদ্ধিমত্তা ঠিকই থাকে। কিন্তু শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন ও জটিলতার জন্য মৃত্যুবরণ করে।

স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি একটি জিনগত রোগ। যেসব ছেলে শিশু বাবার কাছ থেকে এ জিন পায়, তারা ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে। এ রোগে শিশুদের পেশি দুর্বল ও শক্ত হয়ে যায়। ফলে, সামান্য নড়াচড়াতেও অসুবিধা হয়। মস্তিষ্ক, শিরা ও মেরুদণ্ডের কোষ ক্ষয় হতে থাকে। মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে পেশিতে কাজের সংকেত পাঠানো বন্ধ করে দেয়। যত দিন যায় সমস্যা তত বাড়তে থাকে

‘বাংলাদেশে এ রোগের চিকিৎসা শুরু খুবই আশাব্যঞ্জক সংবাদ। জিন থেরাপির মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা নিয়মিত করা গেলে অনেক শিশুর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে।’

কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, সম্প্রতি নোভার্টিস নামক একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি এ রোগের জন্য সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য জিন থেরাপি আবিষ্কার করেছে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইউএসএফডিএ) কর্তৃক স্বীকৃত। এটি দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফির চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।

এক ডোজ ওষুধের দাম প্রায় ২২ কোটি টাকা

নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের পরিচালক কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, এ রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। চিকিৎসায় ব্যবহৃত একটি ইনজেকশনের দাম পড়ে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২২ কোটি টাকা। অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় বিনা চিকিৎসায় আমাদের দেশে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে অনেক শিশু। সম্প্রতি নোভার্টিস লিমিটেডের সহায়তায় একটি গ্লোবাল প্রজেক্টের অধীন মূল্যবান ওষুধটি ভুক্তভোগী এক শিশুকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আমাদের সহায়তা করেছে।

নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (এডি) ডা. বদরুল আলম বলেন, জিন থেরাপির এ চিকিৎসা সারা বিশ্বে নতুন আবিষ্কার। এটির প্রয়োগ যে খুব আগে থেকেই ছিল, তা নয়। এরপরও কিছু দেশ আমাদের তুলনায় এগিয়ে গেছে। কারণ, এ রোগের চিকিৎসায় যে ব্যয়, সাধারণত কোনো রোগীর পক্ষে এটি বহন করা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন >> ১২শ কিডনি প্রতিস্থাপন, মাইলফলক গড়লেন ডা. কামরুল

‘একটি ইনজেকশনের দাম যদি ২২ কোটি টাকা হয়, তাহলে কী করে সম্ভব? এ‌ছাড়া, একটি ইনজেকশন পুশ করলেই যে রোগী শত ভাগ সুস্থ হয়ে যাবে, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। প্রত্যেকটি জিনিসের সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও আছে।’

একটি ইনজেকশনের আমদানি কর এক কোটি টাকা

ডা. বদরুল আলম বলেন, ইনজেকশনটি শুধু বাংলাদেশে নয়, পাশের দেশ ভারতেও নেই। পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। এটি যখন বাংলাদেশে আমদানি করা হয়, তখন সরকার কর্তৃক ট্যাক্স ধরা হয় এক কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সহায়তার কারণে এটি আমরা আনতে পেরেছি। সুতরাং এ রোগের চিকিৎসায় এতগুলো চ্যালেঞ্জ, এগুলো মোকাবিলা করে চিকিৎসা পরিচালনা করা খুবই কঠিন।

‘সামগ্রিকভাবে এ রোগের চিকিৎসায় রাষ্ট্র যদি দায়িত্ব না নেয়, তাহলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কারও পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। এমনকি আমাদের পক্ষেও সম্ভব নয়। হয়তো একটা সময় বাংলাদেশে আসবে, যখন আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়বে। ওষুধটি গ্রাহক পর্যায়ে আরও সহজলভ্য হবে।’

দেশে দ্বিতীয়বার এ জিন থেরাপি প্রয়োগ কখন সম্ভব— জানতে চাইলে এ চিকিৎসক বলেন, এ বছর আমরা ওষুধটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পেয়েছি। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান লটারির মাধ্যমে বাংলাদেশকে এটি দিয়েছে। যে কারণে দ্বিতীয়টি আমরা কবে পাব বা ব্যবস্থা করতে পারব, সেটি বলা যাচ্ছে না। তবে, আমাদের চেষ্টা থাকবে আগামী বছর যেন আরও দুই থেকে তিনটি পেতে পারি। দাম যদি এমনই থাকে তাহলে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকবে না। কারণ, এত দামি ওষুধ আমরা পয়সা দিয়ে কিনে রোগীর দেহে পুশ করব, আপাতত এমন চিন্তা আমাদের নেই।

স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফির উপসর্গ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, জেনেটিক এ রোগে শিশুর হাত ও পা দুর্বল হয়ে পড়ে। ওঠা-বসা, হাঁটায় সমস্যা হয়। পেশি সঞ্চালনে অসুবিধা হয়। শরীরের সন্ধিস্থলগুলো শক্ত হয়ে যায়। হাড় বিশেষ করে মেরুদণ্ডে ব্যথা হয়। খাবার গিলতে ও শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়।

স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফির শ্রেণিবিভাগ

টাইপ- ১ স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি সাধারণত ছয় মাসের শিশুদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তাদের শরীরে বেশকিছু জটিল উপসর্গ দেখা দেয়। টাইপ- ২ সাত থেকে ১৮ মাসের শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। এটি আগের ধাপের চেয়ে জটিল। টাইপ- ৩ সাধারণত ১৮ বছরের ওপরের শিশুদের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। এ ধাপে উপসর্গ তেমন জটিল হয় না। টাইপ- ৪ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়, উপসর্গ মৃদু হয়।

আরও পড়ুন >> ভারী ব্যাগ বহনে শিশুরা মেরুদণ্ডের সমস্যা নিয়ে বেড়ে ওঠে

টাইপ- ১ হলে বছর-খানেকের মধ্যে মারা যায় শিশু। টাইপ- ২ বেশ প্রাণঘাতী। তবে, টাইপ- ৩ ও ৪ এর ক্ষেত্রে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকে না।

স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি কেন হয়

চিকিৎসকদের মতে, বাবার কাছ থেকে জিন-সূত্রে এ অসুখ লাভ করে শিশুরা। তাই ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের আগে কিছু দিক বিবেচনায় আনা জরুরি।

১. আগে কোনো সন্তান থাকলে তার স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফির উপসর্গ দেখা দিয়েছিল কি না।

২. মা-বাবা উভয়ের বংশে স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি আক্রান্ত কেউ আছেন কি না। যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে শিশুর স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফির আশঙ্কা থাকতে পারে।

আরও পড়ুন >> দেশে ওমিক্রনের নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট ‘এক্সবিবি’

এক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় দুটি টেস্টের মাধ্যমে আগত শিশু স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফিতে আক্রান্ত হতে পারে কি না, তা বোঝা যায়। এগুলো হলো- করিওনিক ভিলাস স্যামপ্লিং, যা গর্ভাবস্থার ১১-১৪ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষাটি করানো হয়। আরেকটি হলো- অ্যামনিওসেন্টেসিস, যা গর্ভাবস্থার ১৫-২০ সপ্তাহের মধ্যে করানো হয়।

এছাড়া শিশুর জন্মের পরও কয়েকটি টেস্টের মাধ্যমে তার স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি আছে কি না, তা বোঝা যায়। প্রথমত, জেনেটিক ব্লাড টেস্টের মাধ্যমে শিশুর স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি আছে কি না, তা বোঝা যায়। ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাফি টেস্ট, এটি অতি সূক্ষ্ম সূচ পেশির মধ্যে ঢুকিয়ে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। মাসল বায়োপসি, এক্ষেত্রে পেশির নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করে দেখা হয়।

টিআই/এমএআর/