সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল নিজেই যেন ‘রোগী’
জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের সংকট, যন্ত্রপাতির অভাব, ওষুধের স্বল্পতাসহ নানা সমস্যায় খাবি খাচ্ছে রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য দেশের একমাত্র বিশেষায়িত এ হাসপাতালটিতে প্রয়োজনীয় সেবা পান না আগত রোগীরা। অবকাঠামো থাকলেও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এটি নিজেই যেন ‘রোগী’ হয়ে আছে।
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্যসেবায় সন্তুষ্ট নন রোগীরা
এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ঢাকা জিপিওর চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, আমরা যারা ছোটখাট সরকারি চাকরি করি, আমাদের এই সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ওপরই নির্ভর করতে হয়। কিন্তু এখানে চিকিৎসা নিতে এসে দেখি অনেক অব্যবস্থাপনা। যেমন টিকিট কাটা এবং ওষুধের জন্য লাইন ধরার এখানে কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। দালাল আর হাসপাতালের স্টাফদের অনিয়মে সাধারণ রোগীরা এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন ধরে থাকতে হয়। এছাড়া হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ থাকে না। ডাক্তার পাঁচটি ওষুধ লিখে দিলে হাসপাতালে পাওয়া যায় একটি বা দুটি। আবার অনেক সময় ওষুধই থাকে না।
তিনি বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেও ঝামেলা হয়। আল্ট্রাসনোগ্রামের মতো নৈমিত্তিক কিছু পরীক্ষাও প্রায়ই এখানে করা যায় না। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা চিকিৎসক থাকেন না। কিংবা মেশিন বিকল থাকে। সবমিলিয়ে হাসপাতালটিতে নানা সমস্যা লেগেই থাকে। এসব বিষয় সমাধান হলে আমাদের জন্য একটু ভালো হয়।
এখানকার সেবায় আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট— জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ধরেন ৫০ শতাংশের মতো। চিকিৎসা নিতে এসে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরক্তিকর অবস্থায় পড়ে যাই। তাদের আরও সেবার মান বাড়ানোর সুযোগ আছে।
ওষুধ সংকট, রোগীদের দীর্ঘ লাইন
পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কর্মরত হাফিজ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি চাকরিজীবনের শুরু থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। সেবায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হলেও কিছু তো করার নেই। স্বল্প বেতনের চাকরি। বাধ্য হয়েই এখানে আসতে হয়।
তিনি বলেন, আজ চিকিৎসক দুটি ট্যাবলেট লিখে দিয়েছেন, বলেছেন এখানেই পাব। কিন্তু দুটির জায়গায় পেয়েছি একটি। দামি ওষুধ পাওয়া যায়নি। এটি এখন বাইরে থেকে কিনে খেতে হবে। এ ছাড়া তো কিছু করার নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক সরকারি কর্মচারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানকার ওষুধ নিয়ে সব রোগীরই অভিযোগ। পর্যাপ্ত ওষুধ থাকে না। তার মানে কি সরকার ওষুধ দেয় না? অবশ্যই পর্যাপ্ত ওষুধ আসে। আমার ধারণা, সেগুলো রোগীদের দেওয়া হয় না।
তিনি বলেন, এই হাসপাতালে হাতে গোনা কয়েকটি পরীক্ষা হয়। জটিল কোনো রোগের পরীক্ষা এখানে হয় না। সবগুলো বাধ্য হয়েই বাইরে থেকে করতে হয়। হাসপাতালে চিকিৎসক থাকলেও সংখ্যা কম, যে কারণে রোগীদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের তো অফিস রেখে এখানে চিকিৎসা নিতে আসতে হয়। এখানে যদি দেরি হয়, তাহলে আমাদের অফিসে সমস্যা হয়।
১৭ বিভাগের ১৪টিতে নেই সিনিয়র চিকিৎসক
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে মেডিকেল অফিসার আছেন ৪৬ জন। যার মধ্যে ২১ জন নন-ক্যাডার ও ২৫ জন ক্যাডার (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে) রয়েছেন। এছাড়া সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক আছেন ২০-৩০ জন। তবে অধ্যাপক পর্যায়ের সিনিয়র (জ্যেষ্ঠ) চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। হাসপাতালের ১৭টি বিভাগের মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট আছেন মাত্র তিনটি বিভাগে।
তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হাসপাতালটি শিগগিরই ৫০০ শয্যায় উন্নীত হবে। নতুন করে ১ হাজার ৭৬২ জনবলের চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। যেখানে চিকিৎসক থাকবেন ৫০০ জনের মতো।
দৈনিক হাজারেরও বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন
সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক এক হাজারেরও বেশি রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রোগীই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এর বাইরেও দৈনিক শতাধিক সাধারণ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন।
হাসপাতালটির পরিসংখ্যান বিভাগে কর্মরত এক কর্মচারী জানিয়েছেন, প্রতি শনিবার সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। সেদিন চিকিৎসকদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়।
চাহিদামতো ওষুধ সাপ্লাই দিতে পারে না ইডিসিএল
সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি তৌহিদ বিন হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের বলা আছে, হাসপাতালে ৬০ শতাংশ ওষুধ দেওয়া হবে এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) থেকে এবং বাকি ৪০ শতাংশ বাইরে থেকে কিনতে হবে। এখন আমাদের ডাক্তাররা তো শুধু এই বিষয় মাথায় রেখে ওষুধ দেবেন না, তারা প্রেসক্রিপশন দেবেন রোগীর রোগ অনুযায়ী।
তিনি বলেন, আমাদের ইডিসিএল থেকে ওষুধ কিনতে হয়। সেখান থেকে যে ৬০ ভাগ ওষুধ আমাদের পাওয়ার কথা, তা তারা নিয়মিত সাপ্লাই (সরবরাহ) দিতে পারে না। যে কারণে অনেক সময় চিকিৎসক তাদের কোনো ওষুধ লিখে দিলেও আমরা দিতে পারি না। এটি শুধু আমাদের ক্ষেত্রেই নয়, কোনো সরকারি হাসপাতালই শতভাগ ওষুধ দিতে পারে না।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রসঙ্গে তৌহিদ বিন হাসান বলেন, আমাদের এখানে যে মেশিনগুলো রয়েছে, সেগুলো দিয়ে যেসব পরীক্ষা হয়, সেগুলো আমরা করে থাকি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী হাসপাতালটি ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হচ্ছে। তা হয়ে গেলে অলমোস্ট সবগুলো পরীক্ষাই করা যাবে। আশা করছি, পরীক্ষা নিয়ে আর কোনো অভিযোগ থাকবে না।
৫০০ শয্যা কবে থেকে চালু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালের ডিপিপি অনেক আগেই জমা দেওয়া হয়েছে। ডিপিপি এখনো অনুমোদন হয়নি। তবে ডিপিপিতে তারিখ ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ জুন। আশা করছি এ সময়ের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন হবে।
সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত একটি হাসপাতাল। ২০১৫ সাল পর্যন্ত হাসপাতালটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ছিল। মহামারিকালে হাসপাতালটিতে করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া হলেও এখন অন্য সব রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালটি। হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যুগ্মসচিব আবু আহমদ ছিদ্দীকী।
টিআই/আরএইচ