প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে কম সংখ্যকই গণমাধ্যমে আসে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে, বছরে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে।  

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার এসব খবর যদি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পরিবেশন করা না হয় তাহলে ওই খবরের কারণেও আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।

রোববার (৩ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে আয়োজিত ‘রেসপন্সিবল রিপোর্টিং অন সুইসাইড’ শীর্ষক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে ‘আত্মহত্যার সংবাদ : কেমন হওয়া উচিত’ এ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

এ সময় তিনি বলেন, প্রায় সময়েই সংবাদের শিরোনাম হয় ‘পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহত্যা’, আর এ ধরনের শিরোনাম পরের বছরে পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রটিকেই মূলত আত্মহত্যার উপায় বাতলে দেয়। কারণ এই সংবাদের শিরোনামেই পরীক্ষায় ফেল করলে কী করতে হবে, সেটির একটি বার্তা তুলে ধরা হয়েছে। সংবাদটিতে আত্মহত্যার ঘটনায় সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে আত্মহত্যাকারীকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ‘নায়কোচিত’ ভূমিকায় রূপান্তর করা হয়। এমনকি এর ফল হয় ভয়াবহ।

তিনি আরও বলেন, আত্মহত্যা করলে ‘মৃত আমি’ অনেক সহমর্মীতা পাবো যা অনেকটা সামাজিক ন্যায়বিচারের বিকল্প হবে, এই বোধে ঘটতে পারে আরও নতুন আত্মহত্যা। সুতরাং আত্মহত্যা রোধে মিডিয়ার অনেক ভূমিকা রাখতে হবে।

এ চিকিৎসক বলেন, ২০০৮ সালে হংকংয়ের মিডিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফু কে ডাব্লিও তার এক গবেষণাপত্রে উপস্থাপন করেন যে, হংকংয়ের চাইনিজ ও ইংরেজি ভাষায় প্রচারিত সংবাদপত্রগুলোতে আত্মহত্যার সংবাদগুলো প্রকাশ না করা বা প্রকাশ করলেও অত্যন্ত কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করায় সেদেশে আত্মহত্যার হার ও প্রবণতা কমে গেছে।

কেমন হবে আত্মহত্যার সংবাদ?

ডা. হেলাল বলেন, আত্মহত্যার সংবাদটি প্রথম পৃষ্ঠায় বা অন্যত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রকাশ করা যাবে না। শিরোনামে এমন কোনো শব্দ বা বাক্যরীতি ব্যবহার করা উচিত নয় যা পাঠক বা দর্শককে উদ্দীপনার খোরাক দেয় আবার এমনভাবেও প্রকাশ করা যাবে না যে আত্মহত্যা একটি স্বাভাবিক মৃত্যুমাত্র। যেমন; ‘অপমান সইতে না পেরে রেল লাইনে মাথা পেতে দিলো অমুক’ বা ‘অভিমান করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অমুক’ ইত্যাদি আলংকারিক বাক্যরীতির চাইতে কেবল সংক্ষিপ্ত শিরোনাম দেয়া উচিত ‘অমুকের আত্মহত্যা'।

বিশিষ্ট এ মানসিক বিশেষজ্ঞ বলেন, পত্রিকার শিরোনামে যেন এমন কোনো বার্তা না থাকে যাতে মনে হয় আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান। যেমন, ‘ঋণ থেকে চির মুক্তি পেল অমুক’ বা ‘প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তরুণের বিষপান’ ইত্যাদি শিরোনাম যেন না হয়। কীভাবে একজন আত্মহত্যা করেছে বা করার চেষ্টা করে কেন ব্যর্থ হয়েছে, সে বিষয়গুলো যেন বিস্তারিত বিবরণ আত্মহত্যার সংবাদে না থাকে। এ ধরনের বিবরণ ভবিষ্যতে আরও একজনকে একটি ‘সফল' আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

কোন স্থান যেন 'সুইসাইড স্পট' হয়ে না উঠে

মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, আত্মহত্যার স্থান নিয়ে যেন কোনো সংবাদ না থাকে। এক্ষেত্রে স্থানটিকে নিরাপদ রাখতে প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষকে আলাদা করে জানানো যেতে পারে। যেমন, কোনো বিশেষ উঁচু স্থান, বিশেষ পুকুর ইত্যাদিতে প্রায়ই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বলে প্রচার মাধ্যমে সাধারণের জন্য সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না।

ডা. হেলাল উল্লেখ করেন, বিখ্যাত নায়াগ্রা জলপ্রপাতে আত্মহত্যার বিভিন্ন খবর প্রকাশের পর স্থানটি যেন সুইসাইড স্পটে পরিণত হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৮৫৬ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত নায়াগ্রা জলপ্রপাতে দুই হাজার৭৮০ জন আত্মহত্যা করে।

তিনি বলেন, আত্মহত্যার পরে মৃতদেহের ছবি বা ভিডিও ফুটেজ কোনোভাবেই প্রকাশ করা উচিত নয়। সেলিব্রেটি বা বিখ্যাত বা জনপ্রিয় কেউ আত্মহত্যা করে ফেললে বিষয়টিকে দ্বিগুণ সতর্কতার সাথে নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে।

আত্মহত্যাকারীর স্বজনদের সাক্ষাৎকারে সতর্ক হতে হবে

একটি পরিবারের একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে সে পরিবারের বাকি সদস্যরা মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত থাকেন। এই অবস্থায় তার স্বজনদের সাথে কথা বলা বা সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় খুবই সংবেদনশীল হতে হবে।

এ বিষয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এই চিকিৎসক বলেন, আত্মহত্যাকারীর পরিবারের নিকটজনদের শোকের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এমন কোনো শব্দ বা তথ্য দেওয়া যাবে না যাতে নিকটজনদের শোক আরও ঘনীভূত হয় এবং তাদের মধ্যেও আবার আত্মহত্যার ইচ্ছা জেগে উঠে। এক্ষেত্রে মিডিয়াগুলোকে পরিবার বা স্বজনদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়ে অতি সতর্ক হতে হবে।

তিনি বলেন, সংবাদে সচেতনতামূলক তথা, আত্মহত্যার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা কোথায় সাহায্য পেতে পারেন সে বিষয়ে তথ্য থাকতে পারে। এক্ষেত্রে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি ও প্রচার মিডিয়াকর্মীদের কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

সেলিব্রেটিদের আত্মহত্যার খবরে প্রয়োজন অধিকতর সতর্কতা

তিনি বলেন, আত্মহত্যার ঝুঁকি রয়েছে এমন মানুষ কীভাবে জীবনের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন, এমন ফিচার ও বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে। একইসঙ্গে সেলিব্রেটি/আলোচিত ব্যক্তিদের আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় অধিকতর সতর্ক হতে হবে। কারণ অধিকাংশ সময় মানুষ সেলিব্রেটিদের অনুসরণ করে থাকে।

তথ্য সরবরাহকারীদের উদ্দেশে বলা হয়, তথ্য উপাত্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক উৎস থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য প্রদান করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আত্মহত্যার সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনকারী সংবাদকর্মী নিজেও আত্মহত্যার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। প্রয়োজনে তাকেও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে হতে পারে।

শিরোনামে ‘আত্মহত্যা’ শব্দ পরিহার করা উচিত

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডি শাখার প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শহীদুল ইসলাম বলেন, সারাবিশ্বেই আত্মহত্যা বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তবে আত্মহত্যা প্রতিরোধে মিডিয়াগুলো বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। আত্মহত্যার খবর প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পলিসি হলো শিরোনামে 'আত্মহত্যা' শব্দটি পরিহার করা। এটি হয়তো আমাদের গণমাধ্যমে হঠাৎ করেই সম্ভব না। তবে, ধীরে ধীরে সেটি কমিয়ে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের মূল কাজ ছিল আমরা কোন ট্র্যাকে ছিলাম আর এখন কোন ট্র্যাকে আছি বা যেতে হবে, এমনকি সেক্ষেত্রে করণীয়গুলো ধরিয়ে দেওয়া। আশা করি আমরা সেটি পেরেছি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে আত্মহত্যাকারীদের বেশিরভাগের বয়স ২১-৩০ বছরের মধ্যে। অধিকাংশ আত্মহত্যার শিকার নারীরা।

২০১৭ সালে সারা বাংলাদেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১০ হাজার ২৫৬টি। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার। ২০১৯ সালে সারা বাংলাদেশে ১০ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। আর ২০২০ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৩৬ টিতে। আর সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশনের একটি তথ্য বলছে, ২০২১ সালে শিক্ষার্থী ১০১ জন আত্মহত্যা করেছেন।

টিআই/এসকেডি