আপনার হাতেই মৃত্যুঝুঁকি, হেলমেট নাকি প্লাস্টিকের বাটি!
২০২০ সালে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে তিন হাজারের বেশি। এর মধ্যে এক হাজারেরও বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন প্রায় এক হাজার ১০০ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের প্রধান কারণ নিম্নমানের হেলমেটের ব্যবহার। ৯০ শতাংশ মানুষ হেলমেটের নামে ‘প্লাস্টিকের বাটি’ পরছেন। যা সুরক্ষার বদলে চালক ও আরোহীদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে…
একটা সময় ছিল রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের অধিকাংশ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীরা হেলমেট পরতেন না। তবে ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ‘কারাদণ্ড’ ও ‘জরিমানা’ এড়াতে গত দুই-তিন বছর ধরে পাল্টেছে চিত্র। চালক ও আরোহীদের অধিকাংশই এখন হেলমেট পরছেন। কিন্তু হেলমেট পরার হার বাড়লেও কমেনি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও স্থায়ী পঙ্গুত্বের হার। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে নিম্নমানের হেলমেটকে।
বিজ্ঞাপন
‘পাঠাও’-এর বিবৃতিতে বলা হয়, পাঠাও রাইডারদেরকে ২০ হাজারের বেশি হেলমেট প্রদান করেছে এবং আরও হেলমেট প্রদান করবে। আমরা বিআরটিএ ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছি, কারণ আমাদের রাইডার ও ইউজারদের সেফটি আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘প্লাস্টিকের বাটি’ সমমানের এসব হেলমেট যাত্রীদের সুরক্ষার বদলে উল্টো মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট- এআরআই’র এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১০-২০১৭ সালজুড়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৮৮ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে হেলমেট না পরার কারণে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে হেলমেট থাকা সত্ত্বেও দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ নিম্নমানের হেলমেটের ব্যবহার।
দেশে হেলমেট তৈরি হয় না। উন্নত হেলমেট বিদেশ থেকে দেশে আসে। এছাড়া আমাদের দেশে হেলমেটের স্ট্যান্ডার্ড (মানদণ্ড) নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই
নূর মোহাম্মদ মজুমদার, চেয়ারম্যান, বিআরটিএ
গত ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় নিম্নমানের হেলমেটের কারণে জীবন দিতে হয় আকাশ ইকবাল (৩৩) ও মায়া হাজারিকা মিতু (২৫) দম্পতিকে। ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান। এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক ইমরান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আজমেরী পরিবহনের বাসটি যখন আকাশ-মিতু দম্পতির মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দেয় তখন তারা ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান। দম্পতির ব্যবহার করা দুটি হেলমেটই ভেঙে দুমড়েমুচড়ে যায়। আসলে এগুলো ছিল হেলমেটের নামে ‘প্লাস্টিকের বাটি’। তারা পুলিশের মামলা থেকে বাঁচতে এসব নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহার করতেন। নিজেদের সুরক্ষার কথা ভেবেও যদি ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার করতেন তাহলে তাদের এভাবে মরতে হতো না।’
সড়কে থেকে দুর্ঘটনা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন এমন পুলিশ ট্রাফিক সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেকোনো দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী বা চালক যখন পড়ে যান তখন তিনি প্রথম আঘাতটি পান মাথায়। মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাথায় একটি ভালো মানের হেলমেট থাকলে বড় ধরনের আঘাত থেকে বেঁচে যান চালক বা আরোহী। সেক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত হলেও প্রাণহানির ঝুঁকি থাকে কম। কিন্তু নিম্নমানের হেলমেটগুলো আঘাত পাওয়ামাত্রই ভেঙে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। হেলমেটের ভাঙা প্লাস্টিক মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ঢুকে মারাত্মক আঘাতের সৃষ্টি করছে। এতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। অনেকে আবার স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছেন।
নামকাওয়াস্তে হেলমেটের ব্যবহার রাইড শেয়ারিংয়ে
নিম্নমানের হেলমেটের রমরমা ব্যবহার হচ্ছে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে চালকদের যেসব হেলমেটে দেওয়া হয়, সেগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের— বলছেন বিশেষজ্ঞরা। মাত্র ২ থেকে ৫ শতাংশ চালক ভালো হেলমেট ব্যবহার করছেন; তাও নিজ উদ্যোগে।
হেলমেটের মান নির্ধারণে আমাদের একটি ল্যাব নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা। ল্যাবটি হয়ে গেলে আমরা হেলমেটের মান নির্ধারণ করত পারব
মোহাম্মদ আবু হানিফ, পরীক্ষক (পুর, পদার্থ), বিএসটিআই
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এবং রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের যে হেলমেট দেওয়া হচ্ছে সেগুলো নিম্নমানের, এক কথায় বলা যায় ‘প্লাস্টিকের বাটি’। কোনো রাইড শেয়ারিং কোম্পানি ভালো মানের হেলমেট চালকদের সরবরাহ করছে না।
এ বিষয়ে দেশের সবচেয়ে বড় মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান ‘পাঠাও’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা পোস্টকে ইমেলের মাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠায়। তাদের বিবৃতিতে হেলমেটের সংখ্যা আছে। কিন্তু এর মান নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
‘পাঠাও’-এর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পাঠাও রাইডারদেরকে ২০ হাজারের বেশি হেলমেট প্রদান করেছে এবং আরও হেলমেট প্রদান করবে। আমরা বিআরটিএ ও অনান্য সরকারি সংস্থার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছি, কারণ আমাদের রাইডার ও ইউজারদের সেফটি আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
হেলমেটের মান নিয়ে যা বলছে বিআরটিএ ও বিএসটিআই
হেলমেটের মানদণ্ড নিয়ে কাজ করছে বিআরটিএ ও বিএসটিআই। প্রতিষ্ঠান দুটির কারও কাছেই হেলমেটের মানদণ্ড নির্ধারণে কার্যকর কোনো পদ্ধতি নাই। বিআরটিএ বলছে, তারা হেলমেট দেখে মানদণ্ড ঠিক করেন। আর বিএসটিআই বলছে, তাদের কোনো ল্যাব নেই হেলমেটের মান পরীক্ষার। প্রতিষ্ঠানটির চোখে দেশে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ হেলমেট ‘প্লাস্টিকের বাটি’ ছাড়া আর কিছু নয়।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত হেলমেটের মান নির্ধারণে একটি স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছে। কিন্তু আমরা এখনও তৈরি করতে পারিনি। এটা করা খুবই জরুরি
অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ, এআরআই, বুয়েট
এ বিষয়ে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেশে হেলমেট তৈরি হয় না। উন্নত হেলমেট বিদেশ থেকে দেশে আসে। এছাড়া আমাদের দেশে হেলমেটের স্ট্যান্ডার্ড (মানদণ্ড) নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই।’
‘তবে যারা হেলমেট ব্যবহার করেন, তাদের আমরা নির্দেশনা দিয়েছি ভালো মানের হেলমেট পরার জন্য। নিজের সুরক্ষার জন্যই এটা পরতে হবে। যদিও স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণের কোনো প্রক্রিয়া নেই তবে দেখলে বোঝা যায় কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ। সেই অনুযায়ী আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি। এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছি। সেই কমিটি কাজ করছে।’
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষক (পুর, পদার্থ) মোহাম্মদ আবু হানিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হেলমেটের মান নির্ধারণে আমরা এখন কোনো কাজ করছি না। তবে এ বিষয়ে আমরা দ্রুত কাজ শুরু করব। হেলমেটের মান নির্ধারণে আমাদের একটি ল্যাব নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ল্যাবটি হয়ে গেলে আমরা হেলমেটের মান নির্ধারণ করত পারব। তখন আশা করি বাজারে আর নিম্নমানের হেলমেট থাকবে না।’
অভিজ্ঞ রাইডাররা যা বলছেন
রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা মাহাবুব এলাহী আক্তার শাওন গত ১০ বছর ধরে মোটরসাইকেল চালিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি এখন স্বনামধন্য একজন মোটরসাইকেল রাইডার। তার ‘Moonshine Motorist’ নামে একটি ফেসবুক পেইজ রয়েছে। যেখানে তিনি নতুন রাইডারদের ভালো মানের হেলমেট ব্যবহারসহ নিরাপদে রাইডিংয়ের জন্য নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে একটি মোটরসাইকেল কিনতে পারি, কিন্তু নিজের জীবন বাঁচাতে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে ভালো মানের একটি হেলমেট কিনতে পারি না
মাহাবুব এলাহী আক্তার শাওন, মোটরসাইকেল রাইডার
হেলমেটের মান নিয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একটি মানসম্পন্ন হেলমেটকে অবশ্যই ডট, ইসিই অথবা সার্প রেটিংয়ের সার্টিফাইড হতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে ৮০-৯০ শতাংশই প্লাস্টিকের অতি নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহার করেন। দেশে হেলমেটের মান নির্ধারণের ব্যবস্থা না থাকায় এ অবস্থা।’
’১০ বছরে আমি দেখেছি, শুধুমাত্র হেলমেটের কারণে কত রাইডার তাদের জীবন হারিয়েছেন অথবা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।’ পরামর্শ দিয়ে মাহাবুব এলাহী বলেন, ‘আমরা চার ধরনের হেলমেট কিনে নিজেদের জীবন বাঁচাতে পারি। পলি কার্বনেট (পাঁচ হাজার টাকা), থার্মাল গ্লাস (পাঁচ হাজার টাকা), ফাইবার গ্লাস (১০-৪০ হাজার টাকা) ও কার্বন হেলমেট (২০-৯০ হাজার টাকা মূল্যের)। এসব হেলমেট দেশের বাজারে পাওয়া যায়। এর বাইরে হেলমেট কিনলে জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই।
‘এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে একটি মোটরসাইকেল কিনতে পারি, কিন্তু নিজের জীবন বাঁচাতে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে ভালো মানের একটি হেলমেট কিনতে পারি না আমরা’— প্রশ্ন রাখেন অভিজ্ঞ এই রাইডার।
নিরাপদ হেলমেট যেমন হওয়া উচিত
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা হেলমেটের মান নির্ধারণেও কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্ট (ডট), ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ (ইসিই), যুক্তরাজ্যে সার্প (দ্য সেফটি হেলমেট অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড রেটিং প্রোগ্রাম) এবং বিশ্বজুড়ে স্নেল মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন দীর্ঘদিন ধরে হেলমেটের মানদণ্ড নিয়ে কাজ করছে।
এসব প্রতিষ্ঠান হেলমেটের স্থিতি পরিমাপ, জি-ফোর্স চাপ সামলানো, আঘাত সহনীয় পরীক্ষাসহ অন্তত ২৫-৩০ ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে হেলমেটের মানদণ্ড নির্ধারণ করে। পরীক্ষার ফল অনুযায়ী হেলমেটগুলোকে এক থেকে পাঁচ এর মধ্যে রেটিং করা হয়। ওই রেটিংয়ের ওপর ভিত্তি করে হেলমেটগুলোর দাম নির্ধারণ হয়।
চালক বা আরোহী হেলমেট পরেছেন কিনা, সেটি আমরা নিশ্চিত করি। কিন্তু এটার মান কেমন, আমরা সেটা দেখি না এবং আমাদের দেখার কথাও না
ডিসি ওয়ালিদ হোসেন, ডিএমপি
প্রতিষ্ঠানগুলোর সনদ ছাড়া ওইসব দেশসহ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে কোনো নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান তাদের হেলমেট বাজারজাত করতে পারে না। এছাড়া কোনো চালক বা আরোহী এসব প্রতিষ্ঠানের সনদ সম্বলিত হেলমেট ছাড়া অন্য কোনো হেলমেট ব্যবহার করতে পারেন না।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হলে একটি হেলমেটকে ১.৮৩ মিটার ওপর থেকে লোহার পাটাতনের ওপর ফেলা হয়। নির্দিষ্ট দিক থেকে হেলমেটের ওপর চাপ দেওয়া হয়। হেলমেটটি কতটা শক্তিশালী তা যাচাইয়ের জন্য দুই মিনিট ধরে ৩০০ পাউন্ডের বল প্রয়োগ করা হয়। হেলমেটটি ঘর্ষণ প্রতিরোধক কিনা, তা পরীক্ষা করা হয়। হেলমেটটির শেল ৬৮ কেজি চাপে বেঁকে/ভেঙে যায় কিনা, তাও যাচাই করা হয়।
হেলমেটের ভাইসরটিতে এয়ারগান দিয়ে তিনটি সীসার বুলেট ফায়ার করার মাধ্যমে তা পরীক্ষা করা হয়। তবে বাংলাদেশে এসবের কোনোটি করা হয় না। পুলিশের মামলা থেকে বাঁচতে যে যার মতো প্লাস্টিকের বাটি সাদৃশ্য হেলমেট কিনছেন। বিক্রি ভালো, তা-ই দেদারসে বিক্রেতারাও বিক্রি করছেন।
পুলিশের কাজ কী
নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহারের বিষয়ে পুলিশ বরাবরই বলছে, হেলমেটের মান নিয়ে তারা কাজ করেন না। কোনো মোটরসাইকেল আরোহী বা চালক হেলমেট পরেছেন কিনা, সেটা তারা নিশ্চিত করেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আইনি পদক্ষেপ নেন। মোটরসাইকেল চালক বা আরোহী মামলা থেকে বাঁচতে নিম্নমানের হেলমেট পরেন জেনেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় পুলিশ এ ক্ষেত্রে কিছু করতে পারে না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ওয়ালিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মোটরসাইকেল চালক বা আরোহী হেলমেট পরেছেন কিনা, সেটি আমরা নিশ্চিত করি। কিন্তু এটার মান কেমন, আমরা সেটা দেখি না এবং আমাদের দেখার কথাও না।’
দীর্ঘ হচ্ছে নিম্নমানের হেলমেটে মৃত্যুর তালিকা
দেশের সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো, দুর্ঘটনা এড়ানো এবং চালক ও যাত্রীদের যানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ‘সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট’ (এআরআই) ও ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি’।
প্রতিষ্ঠান দুটির ২০২০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গেল বছরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে তিন হাজারের বেশি। এর মধ্যে এক হাজারেরও বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন প্রায় এক হাজার ১০০ যাত্রী।
সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে দ্রুত হেলমেটের একটি সঠিক মানদণ্ড নির্ধারণ করা। সারা দেশে বিক্রেতাদের এ মানদণ্ডের সনদ নিয়ে ক্রেতাদের কাছে হেলমেট বিক্রিতে বাধ্য করা
মোজ্জামেল হক, সভাপতি, যাত্রী কল্যাণ সমিতি
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে যারা মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী আছেন, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র ১০ শতাংশ মানুষ মানসম্মত হেলমেট পরছেন। বাকি ৯০ শতাংশ মানুষ হেলমেটের নামে নিম্নমানের ‘প্লাস্টিকের বাটি’ পরছেন। যা সুরক্ষার বদলে চালক ও আরোহীদের জন্য অন্যতম মৃত্যুর ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, বাস, ট্রাক, লেগুনা ও প্রাইভেটকারের বেপরোয়া চলাচল, হঠাৎ লেন পরিবর্তন ও হুটহাট মোড় ঘোরানোসহ নানা কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। কিন্তু দুর্ঘটনার পর নিম্নমানের হেলমেটের জন্য দীর্ঘস্থায়ী পঙ্গুত্ব ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। এসব দুর্ঘটনায় ৮০-৯০ শতাংশ মৃত্যু এবং দীর্ঘস্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্য দায়ী নিম্নমানের হেলমেট।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজ্জামেল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারা দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলে সংখ্যা ৩১ লাখেরও বেশি। নতুন করে প্রতি বছর পাঁচ লাখ মোটরসাইকেল দেশে নামছে। কিন্তু নীতিমালা না থাকায় ৯০ শতাংশ মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহার করছেন।
‘এসব হেলমেট তো তাদের সুরক্ষা দিচ্ছে না, উল্টো সামান্য দুর্ঘটনাকে ভয়াবহ রূপ দিচ্ছে। সরকারের উচিত সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে দ্রুত হেলমেটের একটি সঠিক মানদণ্ড নির্ধারণ করা। সারা দেশে বিক্রেতাদের এ মানদণ্ডের সনদ নিয়ে ক্রেতাদের কাছে হেলমেট বিক্রিতে বাধ্য করা।’
বুয়েটের এআরআই’র সহযোগী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আগে দেখা যেত, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হেলমেট না পরার কারণে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যেত। বিগত ২০১০-২০১৭ সাল জুড়ে করা আমাদের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৮৮ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে হেলমেট না পরার কারণে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে হেলমেট থাকা সত্ত্বেও দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ নিম্নমানের হেলমেটের ব্যবহার।’
তিনি বলেন, ‘পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৭০-৮০ শতাংশ বাইকার মামলা থেকে বাঁচতে নিম্নমানের হেলমেট পরছেন। ফলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের সংখ্যাও বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত হেলমেটের মান নির্ধারণে একটি স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছে। কিন্তু আমরা এখনও তৈরি করতে পারিনি। নিরাপদ সড়কের জন্য যে ১১১টি সুপারিশ করা হয়েছিল, তাতে একটি সুপারিশ ছিল হেলমেটের মান নির্ধারণের জন্য। এটি করা খুবই প্রয়োজন এবং তা দ্রুত করতে হবে।’
এমএসি/এমএআর