অর্থটাই সবকিছু নয়
জীবনে অনেক পদক পেয়েছি। সেটা ইউনেস্কো অ্যাওয়ার্ড হোক বা আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজির অ্যাওয়ার্ড। কিন্তু নিজ দেশের এমন একটা অ্যাওয়ার্ড পেয়ে মনে হচ্ছে, জীবনে আর কিছু না পেলেও কোনো দুঃখ থাকবে না...
অধ্যাপক ড. সমীর কুমার সাহা। দেশের প্রখ্যাত গবেষক, অণুজীব বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। কাজ করছেন চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে। সম্প্রতি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে করোনার জিন রহস্য আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বকে চমকে দেন তিনি। অবদানস্বরূপ মনোনীত হয়েছেন দেশের অন্যতম সম্মানজনক একুশে পদকের জন্য।
বিজ্ঞাপন
টিকা প্রয়োগে সফলতা আসলে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাবে বাংলাদেশ। কারণ, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা যতটুকু করছি, এটাই অনেক বড় ব্যাপার
ড. সমীর কুমার সাহা
শুক্রবার (৫ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হন দেশের প্রখ্যাত এই গবেষক ও বিজ্ঞানী। কথা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের নানা গবেষণা এবং দেশে গবেষণার নানা দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।
ঢাকা পোস্ট : দেশের অন্যতম একটি সম্মাননা একুশে পদক পেতে যাচ্ছেন, আপনার অনুভূতি জানতে চাই...
ড. সমীর কুমার সাহা : জীবনে অনেক পদক পেয়েছি। সেটা ইউনেস্কো অ্যাওয়ার্ড হোক বা আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজির অ্যাওয়ার্ড। কিন্তু নিজ দেশের এমন একটা অ্যাওয়ার্ড পেয়ে মনে হচ্ছে, জীবনে আর কিছু না পেলেও কোনো দুঃখ থাকবে না, এরকম একটা অনুভূতি এ মুহূর্তে কাজ করছে। এককথায় অভূতপূর্ব।
ঢাকা পোস্ট : আপনি তো সম্প্রতি করোনাভাইরাস জিনোম সিকোয়েন্স উদঘাটন করেছেন। এ গবেষণার জন্যই কি একুশে পদক পাচ্ছেন?
ড. সমীর কুমার সাহা : একদমই না। করোনার জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবনটা আসলে বড় কোনো কাজ নয়। এর বাইরেও আমি অনেক কাজ করেছি। ইনোভোকাল ভ্যাকসিন যে বাংলাদেশে এসেছে, সেটা আমার গবেষণার জন্য। এরপর হিব ভ্যাকসিন আসছে, সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এজন্য আমি ইউনেস্কো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজিতে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি (এএসএম) অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। বিল গেটসের স্বীকৃতি পেয়েছি। করোনার জিনোম সিকোয়েন্সিংটা হঠাৎ করেই মানুষ একটু বেশি জেনেছে। কিন্তু এটা আসলে যে খুব মহা আবিষ্কার, তেমনটি নয়। তবে বাংলাদেশে প্রথম করেছি, এটা একটা বড় বিষয়।
তবে কোনো নতুন ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) যদি আসেও, সেটা একদম অকার্যকর হবে না। তবে কার্যকারিতা একটু কমবে। যেভাবে আমাদের দেশ খুব দ্রুত টিকা পেয়ে গেল, এভাবে যদি এগোতে থাকি তাহলে আমরা খুবই ভালো করব
ড. সমীর কুমার সাহা
পুরস্কার বা স্বীকৃতিটা আসলে নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য নয়। এটা আজীবন আমি যত কাজ করেছি, সবগুলো মিলিয়েই। দেখা হয়েছে আমার কতগুলো পাবলিকেশন আছে, সেই পাবলিকেশনের কোয়ালিটিগুলো কেমন এবং এটাতে বাংলাদেশের কোথায় কী উন্নতি হয়েছে। এগুলোই মূলত দেখার বিষয়।
ঢাকা পোস্ট : আপনার মতে কোন গবেষণার জন্য এমন স্বীকৃতি আসতে পারে?
ড. সমীর কুমার সাহা : আমার মনে হয়, আমার গবেষণাগুলোর মধ্যে শিশুদের যে ইনফেকশাস ডিজিজগুলো হয়, সেগুলো নিয়ে আমি যে কাজ করেছি, সেটার জন্যই দিয়েছে। এক্ষেত্রে বাচ্চাদের নিউমোনিয়াটা হলো প্রধান। নিউমোনিয়া ও টাইফয়েড নিয়ে আমার যে কাজগুলো সেগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা পোস্ট : ইনফেকশাস ডিজিজ নিয়ে আপনার কাজগুলো সম্পর্কে যদি বলতেন...
ড. সমীর কুমার সাহা : দেশে নিউমোনিয়ার টিকা যে আসছে, আমাদের কাজের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, এটা আমাদের খুবই দরকার। এর তথ্য-উপাত্তগুলো আমরা তৈরি করেছি। সেই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সরকার সেটা নিয়ে আবার কাজ করেছে, যোগাযোগ করেছে এবং ফ্রি টিকা আনতে পেরেছে। সেই টিকাটা নিয়ে আমরা শিশুদের দিতে পেরেছি। সে কারণেই আমাদের শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমেছে। এটি একটি বড় অবদান।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশে গবেষণা ও এর ক্ষেত্রটা কেমন? গবেষকদের জন্য কতটুকু সুযোগ রয়েছে?
ড. সমীর কুমার সাহা : বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রটা যে খুব ভালো, এমনটা বলা যাবে না। স্বাস্থ্য খাতে যে আমরা খুব ভালো গবেষণা করতে পেরেছি, তা নয়। দেশে ইদানীং অনেক গবেষণা হচ্ছে। বিশেষ করে কৃষিতে আমাদের গবেষণা ঈর্ষান্বিত ব্যাপার। এত বড় গবেষণা হচ্ছে, এটা ভাবাই যায় না। অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের এখানে গবেষণাটা কম। আশা করি সামনে হয়তো হবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে গবেষণার অনেক চেষ্টা আছে। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে দেশের গবেষণাগুলো সামনে এগোবে।
আমি বলব, যারা চলে যাচ্ছেন, যাক; সমস্যা নেই। অন্য দেশে গিয়ে ভালো করলেও আমাদের নাম হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, দেশে থেকেও অনেক কিছু করা যায়। অর্থ উপার্জন খুবই জরুরি একটা বিষয়। তবে, অর্থটাই সবকিছু নয়
ড. সমীর কুমার সাহা
স্বাস্থ্য খাতে আসলেই আমাদের অনেক বেশি গবেষণার সুযোগ আছে। এ সুযোগটা আমাদের নেওয়া উচিত। বিষয়টা যেন এমন না হয় যে, বাইরে থেকে কেউ আসবে, আর আমাদের থেকে সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে চলে যাবে। আমাদের নিজেদের জন্য নিজেদেরই কাজ করতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো কী? আমাদের কি গবেষকের সংকট, নাকি গবেষণা ক্ষেত্রের সংকট?
ড. সমীর কুমার সাহা : আমাদের মনে হয় সবদিকেই সংকট রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের গবেষকরা গবেষণা করতে যান, কিন্তু পরে আর ফিরে আসেন না। অনেকে আসলেও বিদেশে যেমন অনেক কাজ করেন, দেশে এসে সে কাজগুলো হয়তো আর ওভাবে গুছিয়ে করতে পারেন না। কারণ, আমাদের এখানে কাজ করাটা কঠিন। কিন্তু আমরা তো জানি-ই আমাদের দেশে কাজ করা কঠিন হবে, আমাদের এ কঠিন অবস্থার মধ্যেই কাজ করে যেতে হবে। এই মনোবলটা যদি না থাকে, তাহলে কিন্তু অসুবিধা।
আমি কোনোভাবেই আমার বাংলাদেশকে দোষ দেব না যে, এ দেশে তো কাজের পরিবেশ নাই, এজন্যই কাজ করতে পারি না। এক্ষেত্রে কথা হলো, সীমাবদ্ধতা থাকলেও আপনি তো এ দেশেরই মানুষ। এখান থেকেই তো আপনাকে গবেষণা করতে হবে।
আমি শিশু হাসপাতালে কাজ করছি। এটা খুবই দরিদ্র একটা হাসপাতাল। আমি একটা ভাঙা টেবিলে বসে কাজ করতাম। বারান্দায় বসে কাজ করতাম। সেখান থেকে আমি বড় ল্যাবরেটরি তৈরি করেছি। যদিও সেটার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। একইভাবে আমার কলিগ যারা ছিলেন, প্রত্যেকেই আমাকে হেল্প করেছেন। সবাইকে নিয়ে কাজ করলে অবশ্যই দেশে ভালো কিছু করা যাবে।
আমি কোনোভাবেই আমার বাংলাদেশকে দোষ দেব না যে, এ দেশে তো কাজের পরিবেশ নাই, এজন্যই কাজ করতে পারি না। এক্ষেত্রে কথা হলো, সীমাবদ্ধতা থাকলেও আপনি তো এ দেশেরই মানুষ। এখান থেকেই তো আপনাকে গবেষণা করতে হবে
ড. সমীর কুমার সাহা
ঢাকা পোস্ট : গবেষকদের অনেকেই তো দেশে থাকতে চান না, এতে দেশে কি কোনো সংকট তৈরি হচ্ছে বা হতে পারে?
ড. সমীর কুমার সাহা : আমি বলব, যারা চলে যাচ্ছেন, যাক; সমস্যা নেই। অন্য দেশে গিয়ে ভালো করলেও আমাদের নাম হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, দেশে থেকেও অনেক কিছু করা যায়। অর্থ উপার্জন খুবই জরুরি একটা বিষয়। তবে, অর্থটাই সবকিছু নয়।
গবেষণা করলেও তার সঙ্গে আমরা অন্যান্য যে কাজ করি, সেগুলোর সঙ্গে যদি দেশে গবেষণাও করি, তাহলে অল্পতেই অনেক বেশি আনন্দ পাওয়া যায়।
ঢাকা পোস্ট : করোনাভাইরাস নিয়ে আপনার সর্বশেষ কোনো গবেষণা বা আপডেট আছে কী?
ড. সমীর কুমার সাহা : আমরা করোনার জন্য টেস্টিংগুলো করছি, সিকোয়েন্সিংগুলো করছি। কোনটা কোথা থেকে আসল, বুঝতে চেষ্টা করছি। এছাড়া নবজাতকদের যে করোনা হতে পারে বা থাকতে পারে, সেটা আমরা প্রথম পাবলিশ করি। এটাও দেখতে চেষ্টা করছি যে, অভারঅল করোনাভাইরাসের জন্য কী কী প্রভাব পড়ছে। আমাদের যখন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির লোকজন একসঙ্গে আসল, কাজ করল বা করছে, এতে কী কী প্রভাব পড়ছে...। সারাদেশে লকডাউন হলো, তখন কী কী উপকার আমরা পেলাম বা আদৌও কিছু হয়েছে কিনা, সেগুলো দেখছি। দেশের ফ্লাইট যখন বন্ধ ছিল, তখন কী প্রভাব পড়েছে; এখন আবার ফ্লাইট শুরু হয়েছে, এতে কোনো প্রভাব পড়ছে কিনা, সেগুলোও সিকোয়েন্সিং করে আমরা দেখার চেষ্টা করছি।
ঢাকা পোস্ট : করোনার নতুন ধরনে টিকা কতটুকু কার্যকর হবে বলে মনে করেন?
ড. সমীর কুমার সাহা : এককথায় বলতে গেলে, টিকা খুবই কার্যকর হবে। তবে কোনো নতুন ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) যদি আসেও, সেটা একদম অকার্যকর হবে না। তবে কার্যকারিতা একটু কমবে। যেভাবে আমাদের দেশ খুব দ্রুত টিকা পেয়ে গেল, এভাবে যদি এগোতে থাকি তাহলে আমরা খুবই ভালো করব। আমরা ইতোমধ্যে করোনার সূচকে নিচের দিকে যাচ্ছি।
স্বাস্থ্য খাতে আসলেই আমাদের অনেক বেশি গবেষণার সুযোগ আছে। এ সুযোগটা আমাদের নেওয়া উচিত। বিষয়টা যেন এমন না হয় যে, বাইরে থেকে কেউ আসবে, আর আমাদের থেকে সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে চলে যাবে। আমাদের নিজেদের জন্য নিজেদেরই কাজ করতে হবে
ড. সমীর কুমার সাহা
টিকা প্রয়োগে সফলতা আসলে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাবে বাংলাদেশ। কারণ, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা যতটুকু করছি, এটাই অনেক বড় ব্যাপার।
একনজরে অধ্যাপক ড. সমীর কুমার সাহা
সমীর কুমার সাহা ১৯৫৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চাঁদপুর শহরের কদমতলার সাহা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন। পিতা বরেণ্য ব্যবসায়ী চন্দ্রকান্ত সাহা, মা দুলালী প্রভা সাহা। তার অন্য ভাই-বোনরা হলেন- কবিতা সাহা, প্রবীর সাহা ও তৃপ্তি সাহা। সমীর কুমার সাহার মেয়ে অণুজীব বিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা। স্ত্রী ড. সেতারুন্নাহার গণস্বাস্থ্যের গবেষক। ছোট ছেলেও পেশায় অণুজীব বিজ্ঞানী।
তিনি ঢাকা শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজির ডায়াগনস্টিক বিভাগের অধ্যাপক, সিনিয়র পরামর্শদাতা এবং বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দ্য চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) নির্বাহী পরিচালক।
ড. সমীর কুমার সাহা নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস ও এন্টারিক জ্বর বিশেষজ্ঞ; বিশেষত পেডিয়াট্রিক সংক্রামক রোগগুলোর জন্য তার গবেষণা ব্যাপক পরিচিত। ২০১৭ সালে ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজিতে অসামান্য গবেষণার জন্য আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি (এএসএম) অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। তিনি আমেরিকান একাডেমি অব মাইক্রোবায়োলজিতে ফেলোশিপ নির্বাচিত হন। একই বছর সাহা মাইক্রোবায়োলজিতে ইউনেস্কো কার্লোস জে ফিনলে পুরস্কার পান।
ড. সমীর কুমার সাহা চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ও এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া ১৯৮৯ সালে ভারতের বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
টিআই/এমএআর/