গত ১৫ মাসে বাংলাদেশে জেট ফুয়েলের (উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জ্বালানি/তেল) দাম বেড়েছে ১১ বার। কমেছে মাত্র দুবার। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীন ‘পদ্মা অয়েল’ দেশের জেট ফুয়েলের বাজারে একক আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে।  অভিযোগ উঠেছে, প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যথাযথভাবে সমন্বয় না করে ইচ্ছামতো তেলের দাম বাড়াচ্ছে। ফলে ব্যয় বাড়ছে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর। বাড়তি ব্যয় উঠাতে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে টিকিটের মূল্য। যা সরাসরি পড়ছে যাত্রীদের ঘাড়ে।

অন্যদিকে, সাশ্রয়ী মূল্যে তেল পাওয়ায় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো কম ভাড়ায় যাত্রী বহন করতে পারছে। ফলে প্রতিযোগিতার এ বাজার থেকে ছিটকে পড়ছে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো।

বাংলাদেশে সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি জেট ফুয়েলের দাম সমন্বয় করা হয়। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য বর্তমানে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের দাম পড়ছে ৭৪ টাকা। অথচ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে দশমিক ৬৭ মার্কিন ডলার (৫৭ টাকা প্রায়)।

বাংলাদেশে সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি জেট ফুয়েলের দাম সমন্বয় করা হয়। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য বর্তমানে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের দাম পড়ছে ৭৪ টাকা। অথচ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে দশমিক ৬৭ মার্কিন ডলার (৫৭ টাকা প্রায়)

২০২০ সালের ডিসেম্বরে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের দাম ধরা হয় ৪৮ টাকা। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে তা বাড়িয়ে করা হয় ৫৩ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ৫৫ টাকা, মার্চে ৬০ টাকা এবং এপ্রিলে করা হয় ৬১ টাকা। তবে, মে মাসে লিটারপ্রতি এক টাকা দাম কমানো হয়। জুনে ফের লিটারপ্রতি তিন টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৬৩ টাকা, জুলাইয়ে ৬৬ টাকা, আগস্টে ৬৭ টাকা, অক্টোবরে ৭০ টাকা এবং নভেম্বরে সাত টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৭৭ টাকা। নতুন বছরের শুরুতে (২০২২ সালের জানুয়ারি) তিন টাকা কমিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয় ৭৪ টাকা। জেট ফুয়েলের এমন মূল্যবৃদ্ধি সারা বিশ্বে বিরল— জানাচ্ছে দেশের এয়ারলাইন্সগুলো।

বিপিসির অধীন ‘পদ্মা অয়েল’ দেশের জেট ফুয়েলের বাজারে একক আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে / ছবি- সংগৃহীত 

যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো

পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ হয় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে। অর্থাৎ তেলের দাম বাড়লে বাড়ানো হয়, কমলে কমানো হয়। বাংলাদেশেও এটি মানার চেষ্টা করা হয়। এজন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) একটি বোর্ড রয়েছে। বোর্ডের প্রধান বিপিসির অপারেশন্স বিভাগের পরিচালক।

অভিযোগ আছে, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম বাড়ে, বোর্ড তখন তেজি ষাঁড়ের মতো জেট ফুয়েলের দাম বাড়ায়। তবে, দাম কমলে তাদের তৎপরতা তেমন দেখা যায় না। কোনোরকম দায়সারা মূল্য নির্ধারণ করেন তারা।

এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি এয়ারলাইন্সের ৪০ শতাংশ পরিচালন ব্যয় হয় জেট ফুয়েলে। জেট ফুয়েলের দাম যত বেশি, ব্যয়ও তত বাড়ে। যেসব প্রতিষ্ঠান কম দামে তেল কেনে, তাদের পরিচালন ব্যয়ও কম। যাত্রীদের তারা কম দামে টিকিট দিতে পারে। অথচ, বাংলাদেশে জেট ফুয়েলের দাম বেশি হওয়ায় এয়ারলাইন্সগুলোর রাজস্ব দিন দিন কমছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক এভিয়েশন বাজারের প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বে বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলো। যার প্রমাণ রিজেন্ট, জিএমজি ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনে ‘নিজেদের অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয়ের’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

গত ১৫ মাসে বাংলাদেশে জেট ফুয়েলের দাম বেড়েছে ১১ বার। কমেছে মাত্র দুবার / ছবি- সংগৃহীত 

এ বিষয়ে বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এয়ারলাইন্সগুলো দীর্ঘদিন ধরে জেট ফুয়েলের দাম কমানোর কথা বলে আসছে। তবে, বিপিসি কখনওই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। করোনার মধ্যে বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলো যখন নানা সমস্যার সম্মুখীন, সেই মুহূর্তে (২০২১ সাল) কয়েকবার তেলের দাম বাড়ানো হয়। ফলে আমাদের এয়ারলাইন্সগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই রেশ কিন্তু এখনও চলছে। অন্যদিকে, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো কম দামে নিজ দেশ থেকে তেল কিনছে। ফলে, তারা কম ভাড়ায় যাত্রী বহন করতে পারছে।

তিনি বলেন, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশে আসার সময় সর্বোচ্চ পরিমাণে তেল নিয়ে আসে। অথচ বাংলাদেশে যদি তেলের দাম কমানো হয় তাহলে তারা এখান থেকে তেল রিফিল করতে পারত। সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন পদ্মা অয়েলের রাজস্ব বাড়ত, সরকারও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত।

বলতে বলতে ক্লান্ত এয়ারলাইন্সগুলো, পাত্তা দেয় না কেউ

বিশ্ববাজারের সঙ্গে জেট ফুয়েলের দাম সামঞ্জস্য রাখতে দীর্ঘদিন ধরে বিপিসিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠির পর চিঠি দিয়ে আসছে এয়ারলাইন্সগুলো। তবে উত্তর আসছে ‘না’। উল্টো ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করছে বিপিসি!

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম বাড়ানো হলেও কমার ক্ষেত্রে সেটি মানা হয় না / ছবি- সংগৃহীত

এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) মহাসচিব ও নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্টপর্যায়ে মৌখিক ও লিখিতভাবে চিঠি দিয়ে তেলের দাম সুষ্ঠুভাবে সমন্বয়ের কথা বলেছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েও দেনদরবার করেছি। তবে কাজ হয়নি। তেলের দামটা বর্তমানে আমাদের জন্য খুবই অসহনীয়।

তিনি বলেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ বেশি দামে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে তেল কিনতে হচ্ছে। আমরা আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণের দর সমান-সমান চাই।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিপিসির বর্ধিত মূল্য এয়ারলাইন্সগুলোর অপারেশন খরচ বাড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয় কিন্তু যাত্রীদের ঘাড়েই পড়ছে। কারণ, খরচ বাড়লে টিকিটের দামও বাড়ে।

বেশি দামে তেল কেনায় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে পেরে উঠছে না দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো / ছবি- সংগৃহীত

‘আমরা দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো যখন তেলের খরচের কারণে টিকিটের দাম বাড়ায়, তখন এটা নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারা কিন্তু আমাদেরটা বাদ দিয়ে কম ভাড়ার বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোই বেছে নেয়। তেলের দাম সহনীয় ও প্রতিযোগিতামূলক না থাকলে বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলোর টিকে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়বে।’

যে কারণে ইচ্ছামতো তেলের দাম নির্ধারণ করছে বিপিসি

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে জেট ফুয়েলের দাম কিছুটা বেশি। বিভিন্ন দেশে জেট ফুয়েল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের শহর আবুধাবিতে বর্তমানে প্রতি লিটার জেট ফুয়েল দশমিক ৬২ মার্কিন ডলার, দুবাইয়ে দশমিক ৬২ ডলার, শারজায় দশমিক ৬৪ ডলার, নেপালে দশমিক ৬৪ ডলার, যুক্তরাজ্যে দশমিক ৬২ ডলার, যুক্তরাষ্ট্রে দশমিক ৬৪ ডলার, থাইল্যান্ডে দশমিক ৬৩ ডলার, মালয়েশিয়ায় দশমিক ৬৩ ডলার, সৌদি আরবে দশমিক ৬৩ ডলার, সিঙ্গাপুরে দশমিক ৬৩ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। এসব দেশে অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটের জন্য তেলের দাম একই অথবা কম। শুধুমাত্র বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটের জন্য তেলের দাম দিতে হয় বেশি।

জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে কেন সামঞ্জস্যতা রাখা হচ্ছে না— জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একাধিক জেট ফুয়েল সাপ্লায়ার (সরবরাহকারী) আছে। বাংলাদেশে একমাত্র সাপ্লায়ার পদ্মা অয়েল। বিকল্প বিক্রেতা না থাকায় তারা তেলের বাজার মনোপলি মার্কেটে (একচেটিয়া বাজার) পরিণত করেছে। পছন্দ হলে নাও— এমন ভাব তাদের। না নিয়েও উপায় নেই দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর।

‘যেহেতু প্রতিষ্ঠান একটাই, তাই তেল বিক্রিতে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। দেশে যদি আরও দু-একটা সাপ্লায়ার থাকত এবং সরকার যদি তেলের দামে নাক না গলাত তাহলে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয়টা বন্ধ করা যেত। মনোপলি ব্যবস্থা ভেঙে দিলে এ সমস্যার সমাধান হতো।’

কৌশলী অবস্থানে বিপিসি-পদ্মা অয়েল

তেলের দামের সমন্বয় নিয়ে বিপিসি ও পদ্মা অয়েলের বক্তব্য প্রায় একই। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজার, পাশাপাশি কলকাতা, মুম্বাই, কলম্বো, ইয়াঙ্গুনসহ বিভিন্ন বিমানবন্দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ করা হয়।

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের / ছবি- সংগৃহীত

পদ্মা অয়েলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (এভিয়েশন) এস এম রেজাউর রহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)। আমরা শুধুমাত্র তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করি। দামের অসামঞ্জস্যতার বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান (সচিব) এ বি এম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি মাসেই জেট ফুয়েলের দাম সমন্বয় করা হয়। এটা নির্ধারণের জন্য বিপিসির একটি কমিটি রয়েছে। কমিটি প্রতি মাসে বসে দাম নির্ধারণ করে। আমাদের প্রাইসিংটা (মূল্য নির্ধারণ) করা হয় কলকাতা (ভারত), শ্রীলঙ্কাসহ আশপাশের দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে। সারা পৃথিবীর সঙ্গে বা সব দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এটা সমন্বয়ের সুযোগ নেই।

দেশের এয়ারলাইন্সগুলো বিদেশি এয়ারলাইন্স থেকে বেশি দামে তেল কিনছে— এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা বাংলাদেশ সরকারের নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিদেশি মালিকানাধীন ফ্লাইটগুলো শুল্কমুক্তভাবে তেল নেয়। তবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুটে যেসব ফ্লাইট তেল নেয়, সেসব ফ্লাইটের ক্ষেত্রে শুল্কযুক্ত দাম ধরা হয়। এ কারণে দামটা বেশি পড়ে।

এআর/এমএআর/