বিআরটিসি চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলামের সাক্ষাৎকার
বাস কেনার চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণে জোর দিচ্ছি
আগামী এক বা দুই মাসের মধ্যে আরও ১০০ গাড়ি (বিআরটিসি বাস) সচল হবে। বাস কেনার চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণে জোর দিচ্ছি। তারপরও আমি বলব, বিআরটিসি কাঙ্ক্ষিত লাভটুকু করতে পারেনি। এখানে ব্যবস্থাপনার সমস্যা ছিল— বলছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম।
বিআরটিসি চেয়ারম্যান হিসেবে গত ৭ ফেব্রুয়ারি যোগ দেন তিনি। সংস্থাটির আয় বাড়ানো ও ব্যয় সংকোচনের পাশাপাশি যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন তাজুল ইসলাম। বিআরটিসির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপসহ নানা বিষয়ে সম্প্রতি নিজ কার্যালয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের বিশেষ প্রতিবেদক পার্থ সারথি দাস।
বিজ্ঞাপন
মো. তাজুল ইসলাম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ১১তম ব্যাচের সদস্য। বিআরটিসিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি মাঠ প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন
ঢাকা পোস্ট : বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন?
তাজুল ইসলাম : চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি বিআরটিসির চেয়ারম্যান পদে যোগ দিই। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হই। সমস্যা নিরসনে কিছু কৌশল আমরা নির্ধারণ করি। সহকর্মীদের বোঝাতে চেষ্টা করি, আমরা যে ধারায় চলছি সে ধারায় চললে বিআরটিসিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমি তিনটি মূলমন্ত্র নিয়ে কাজ শুরু করি।
মন্ত্র তিনটি হলো- আয় বাড়াতে হবে, আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় সংকোচন করতে হবে এবং যাত্রীসেবার মান বাড়াতে হবে।
ওই তিনটি মন্ত্র সামনে নিয়েই যাত্রা শুরু করি। আমি মনে করি, সহকর্মীদের প্রচেষ্টায় আমরা অনেকটা সফল হয়েছি। আয় বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যয় সংকোচন করতে পেরেছি। ফলে লাভের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। যদিও চলতি বছরের (২০২১ সাল) প্রায় চার মাস আমরা করোনার কঠিন পরিস্থিতি পার করেছি। তখন বিআরটিসি গাড়ি চালাতে পারেনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে আমি যোগ দিই। এখন পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বকেয়া নেই। ইতোমধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। সারাদেশে বিআরটিসি-সংশ্লিষ্টদের বৈশাখী ভাতা পরিশোধ করেছি। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া জুলাই মাসের ইনক্রিমেন্টের বিষয়টিও আমাকে যোগ করতে হয়েছে। সহকর্মীদের প্রচেষ্টায় সে লক্ষ্যও পূরণ করতে পেরেছি।
ঢাকা পোস্ট : বিআরটিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। বিশেষ করে তাদের ভাতা পরিশোধের বিষয়ে একটি অভিযোগ ছিল...
তাজুল ইসলাম : যেহেতু বিআরটিসি একটি করপোরেশন, সেহেতু এখানে পেনশন নেই। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্র্যাচুইটি, সিপিএফ (প্রদেয় ভবিষ্য তহবিল) ও ছুটি নগদায়নের টাকা পরিশোধ করতে হয়। আমি এখানে যোগ দেওয়ার পর দেখলাম এসব এলোমেলোভাবে পরিশোধ করা হচ্ছে।
ভাতাদি পরিশোধের বিষয়টি আমরা নিয়মের মধ্যে এনেছি। আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢাকার বাইরে থেকে কষ্ট করে প্রধান কার্যালয়ে আসতে হতো। তাদের আবেদন করতে হতো এবং আবেদনটি চেয়ারম্যান পর্যন্ত না পৌঁছানো পর্যন্ত কোনো সুরাহা হতো না। ভাতাদি পাবেন কি না, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাতে আশ্বস্ত হতে পারতেন না। সেই অবস্থা বদলে দিতে পেরেছি।
এ মুহূর্তে আমাদের ৪২৮ কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। আগে তাদের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে আসতে হতো। সময় মতো কারও কারও কাজ হতো, কারও হতো না। এসব বিবেচনায় আমরা অনলাইন ব্যবস্থা চালু করছি।
কে কত টাকা পাবেন, তাদের মোবাইল ফোনে এ সংক্রান্ত মেসেজ চলে যাবে। এসবের জন্য একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম ডিসেম্বর মাসেই সিপিএফ ও গ্র্যাচুইটির টাকা দেব। বিজয়ের মাসে (ডিসেম্বর) ৪২৮ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সে টাকা চলে যাচ্ছে। তাদের কাউকে ঢাকায় আসতে হচ্ছে না। আমি মনে করি, এটি আমাদের সাফল্য, বর্তমান সরকারের সাফল্য।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নই তার স্বপ্ন। এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান। আমরাও প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করার জন্য সক্রিয়। সবাইকে বলতে চাই, আমরা একসঙ্গে কাজ করব এবং বিআরটিসিকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব।
ঢাকা পোস্ট : অভিযোগ আছে, বিআরটিসির বহরে যোগ হওয়া গাড়ির একটি অংশ মেরামতের নামে অচল রাখা হয়। ফলে যাত্রীরা এসব বাসের সেবা থেকে বঞ্চিত হন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছি?
তাজুল ইসলাম : বিআরটিসির বহরের গাড়ির সংখ্যা কোনোভাবেই যেন না কমে, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। শতাধিক গাড়ি, যেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছিল, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেগুলো বহরে যোগ করেছি। আমাদের বহরে অন-রুট এক হাজার ৪০০ গাড়ি রয়েছে। কিছুসংখ্যক গাড়ি আমরা মেরামতের আওতায় নিয়ে এসেছি।
জানলে খুশি হবেন, ২০১২ সালে বিআরটিসির সমন্বিত কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেটি গত জুনে চালু করেছি। গাজীপুরের একটি পেট্রোল পাম্প ১০ বছর ধরে বন্ধ ছিল। চলতি মাসেই সেটি চালু করেছি। বিভিন্ন কারণে বিআরটিসি নিচের দিকে যাচ্ছিল, সেটি আমরা উপরে তোলার চেষ্টা করছি।
বাসের ট্রিপের সংখ্যা বাড়াতে আমরা জোর দিয়েছি। আগে ক্ষুদ্র মেরামতের নামে কারখানায় একেকটি বাস পাঁচ-সাত দিন পড়ে থাকত। এমনকি এক মাসও পড়ে থাকত। এখন তা এক দিনের মধ্যেই করা হচ্ছে। রাত ৮টার মধ্যে বাস কারখানায় ঢুকলে সকালের মধ্যেই মেরামত করতে হয়। আগে রাতে ওয়ার্কশপে মেরামত চলত না, এখন সারারাত চলে। ফলে দিনের বেলা গাড়িটি সড়কে চলতে পারে।
ঢাকা পোস্ট : বিআরটিসিতে প্রকৌশলী ও চালকের সংকট দীর্ঘদিনের। সংকট নিরসনে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
তাজুল ইসলাম : এখানে জনবল নিয়োগ দিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে। আমরা গত তিন মাসে ৩০০ জনকে নিয়োগ দিয়েছি। আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন, বিআরটিসিতে আমি যোগ দেওয়ার পর কোন কাজটি সবচেয়ে ভালো হয়েছে। জবাবে বলি, স্বচ্ছতার সঙ্গে ৩০০ লোককে নিয়োগ দিতে পেরেছি। এর মধ্যে টেকনিশিয়ান ৭৬ জন। কারণ, তারা অচল বাস দ্রুত সচল করেন। গত ৮ থেকে ৯ বছর বিআরটিসিতে টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক চালক নিয়োগ দিয়েছি। ছয়জন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার (মেকানিক্যাল) নিয়োগ পেয়েছেন। তারা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। অর্থাৎ ৭৬ জন টেকনিশিয়ান ও ছয়জন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার— সবমিলে ৮২ জন গাড়িবহর ঠিক রাখার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। নিয়োগটা আগে হলে কোনো সংকট তৈরি হতো না।
ঢাকা পোস্ট : বাস অচল করার পেছনে ডিপো ম্যানেজারদের দায়ী করা হয়। এ বিষয়ে আপনি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন কি না?
তাজুল ইসলাম : এখন আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বিআরটিসির কোনো বাস অচল পড়ে থাকবে না, চলবে। আমার স্লোগান হলো, গাড়ি বসার (অচল) আগে ম্যানেজার বসে যাবেন। গাড়ি কোনোভাবেই অচল থাকতে পারবে না। কোনো গাড়ি বসিয়ে রাখতে হলে আমাকে আগাম নোটিশ করতে হবে।
আমাদের এখানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের একটি টিম আছে। তারা প্রতিনিয়ত কারিগরি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। তাদের বলে দেওয়া আছে, কোনো কিছুতে যেন ছাড় না দেওয়া হয়; তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। টিম যে রিপোর্ট দেয়, সেটি শতভাগ এক্সিকিউট করা হয়। এ কারণে ভারী গাড়িগুলোর মেরামতও দ্রুত হচ্ছে।
প্রতি ১৫ দিনে যদি পাঁচটি ভারী গাড়ি মেরামত করতে পারি তাহলে প্রতি মাসে ১০টি গাড়ি গাজীপুরের কারখানা থেকে সচল হচ্ছে। আশা করছি, আগামী এক বা দুই মাসের মধ্যে আরও ১০০ গাড়ি সচল হবে। বাস কেনার চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণে জোর দিচ্ছি। তারপরও আমি বলব, বিআরটিসি কাঙ্ক্ষিত লাভটুকু করতে পারেনি। এখানে ব্যবস্থাপনার সমস্যা ছিল।
সড়কমন্ত্রী প্রতিনিয়ত যে নির্দেশনা দিচ্ছেন, তা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সবসময় চান, বিআরটিসি একটি আদর্শ রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকুক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সাল থেকে সরকার বিপুলসংখ্যক বাস ও ট্রাক দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেন, যাতে বিআরটিসিকে আরও সামনে নিয়ে যাওয়া যায়।
ঢাকা পোস্ট : শত ব্যস্ততার মধ্যে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
তাজুল ইসলাম : ঢাকা পোস্টকেও অনেক ধন্যবাদ।
পিএসডি/আরএইচ