গণতন্ত্র কি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে?
বিজয়ের ৫০ বছরে দেশের অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও রাজনৈতিকভাবে একটি স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি দেশ— এমনটি মনে করছে বিরোধীপক্ষ। তাদের অভিযোগ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও দেশে গড়ে ওঠেনি সুষ্ঠু কোনো নির্বাচন-ব্যবস্থা। ফলে স্থায়ীভাবে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়নি।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শেষপ্রান্তে এসেও সরকারের বাইরে থাকা দলগুলো এখনও স্বাধীনভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছে না। যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে তারা তাদের বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয় না। বিভিন্ন উপায়ে প্রতিপক্ষের ওপর নিপীড়ন চালায়।
বিজ্ঞাপন
তবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি— যে দলই ক্ষমতায় এসেছে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান ঘটেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিজয়ের ৫০ বছরে এসে আমাদের অর্জন কতটুকু— জানতে চাওয়া হয় প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থনীতিতে আমাদের অগ্রগতি অনেক। এক্ষেত্রে প্রবাসীদের বড় অবদান রয়েছে। কিন্তু দেশে কার্যকর গণতন্ত্র নেই। সুষ্ঠুভাবে গণতন্ত্র কাজ করছে না। ফলে, সরকারের বাইরে থাকা দলগুলো তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছে না।
‘দেশ স্বাধীনের ৫০ বছরেও আমরা একটি স্থায়ী নির্বাচন-ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পরিনি। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন প্রণয়নও করতে পারিনি। দেশের চলমান অগ্রগতিকে স্থায়ী রূপ দিতে হলে রাজনৈতিকভাবে দেশকে আগে একটি স্থিতিশীল জায়গায় আনতে হবে। জনগণের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।’
বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘অনেক বাধা-বিপত্তির পরও বাংলাদেশের অর্জন বিশাল। সেটি গর্ব ও অহংকার করার মতো বলে আমি মনে করি। একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সময়ে যেসব দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের চেয়ে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারতাম। কারণ, আমরা অত্যন্ত শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।’
‘আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে, সেখানে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব থাকবেই। সরকারি দল একটা কাজ করলে, বিরোধী দল তার বিরোধিতা করবেই। আবার সেই সরকারি দল যখন বিরোধী দলে যায়, তারাও একই কাজ করে। এটাকে আমি সমস্যা বলে মনে করি না। এর মধ্যে থেকেও কাজ করতে হবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
অনেকে অভিযোগ করেন যে দেশে কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নেই— এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটা আমাদের দেশে নাই। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে ক্রমাগতভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে গণতন্ত্র সঠিক রাস্তায় এসে দাঁড়াবে। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম।’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কতটুকু প্রতিফলন ঘটেছে— জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জনগণের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটা কিন্তু আজও পূরণ হয়নি। রাজনৈতিভাবে আমরা এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। ১৯৭১ সাল কিংবা তার আগে মানুষের যে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো হরণ করে নিয়েছিল পাকিস্তান সরকার, বর্তমান পরিস্থিতি তার থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়।
‘বাংলাদেশেরই একটি রাজনৈতিক দল, যারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিল, তার আগেও সংগ্রামে ছিল; তাদের হাতেই দ্বিতীয়বারের মতো গণতন্ত্র হত্যা হয়েছে। মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে তারা। আমাদের ভোটের অধিকার, স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, ভিন্ন মতের অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা— সবকিছুই এখন একটা দলের হাতে চলে গেছে। যেটা বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিনই চায়নি।’
কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন তো হয়েছে— এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে যেটা হয়েছে, ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরিব আরও গরিব হয়েছে। যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তার ভিত্তি স্থাপন করেছিল জিয়াউর রহমান। গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশের মধ্য দিয়ে, শ্রমিকদের বাইরে পাঠিয়ে এবং কৃষিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেই ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। সুতরাং এক কথায় যেটা বলা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানুষের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে আজ ৫০ বছর পরও সেটা পূরণ হয়নি।’
বিজয়ের ৫০ বছরে আমাদের অর্জন কতটুকু— জানতে চাওয়া হয় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের কাছে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের পর থেকে অফিসিয়ালি আমাদের দেশে বিরোধী দলের কোনো ভূমিকা নেই। কিছু বক্তব্য-সুপারিশ তুলে ধরা, সমালোচনা ছাড়া। সরকার যদি জনকল্যাণকর কাজ না করে, তা করতে বাধ্য করার বিষয়ে বিরোধী দলের কোনো ভূমিকা কখনই ছিল না। ১৯৯১ সালের পর থেকে বিরোধী দল সব সময় সংসদ বর্জনের রাজনীতি করে আসছে।
‘সার্বিকভাবে আমাদের রাজনীতিতে বিভিন্নভাবে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষে-মানুষে বৈষম্য, দলগতভাবে বৈষম্য; রাজনৈতিক দলগুলো সরকারি দলে গেলে এক রকম, বিরোধী দলে গেলে আরেক রকম আচরণ করে। প্রতি বছরই এটা বাড়ছে। মানুষের আয় ও সম্পদের দিক থেকেও বৈষম্য বাড়ছে। এগুলো হলো নেতিবাচক দিক।’
তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের অনেক ইতিবাচক দিকও রয়েছে— উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, অবকাঠামো খাতে দেশের অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। জীবন-জীবিকার মান কিছুটা বেড়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ারই অংশ। তবে বেসিক বিষয়গুলো, বিশেষ করে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা— যে কারণে মানুষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল, সেসব জিনিস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
‘অনেক উন্নয়নের পরও স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা এখনও রাজনৈতিকভাবে একটা শক্ত জায়গায় যেতে পারিনি’— উল্লেখ করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি এখনও দুর্বল অবস্থানে আছে। এখানে যে দল সরকারে থাকে তারা কখনও বিরোধীদের সহ্য করতে পারে না। তারপরও বিরোধী দলগুলো কাজ করে যাচ্ছে, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।’
বিজয়ের ৫০ বছরে রাজনীতিতে বাংলাদেশের অর্জন কেমন দেখছেন— প্রশ্ন রাখা হয় সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সাধারণ সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদারের কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিতে এখন বিরোধী দলশূন্য হয়ে পড়েছে। সংসদেও বিরোধী দল নেই। মাঠেও নেই। বর্তমানে বিএনপির কোমর ভেঙে গেছে। বিএনপির নেতৃত্বশূন্যতা শুধু তাদের জন্যই নয়, আমাদের জন্যও খারাপ পরিণতি বয়ে এনেছে।’
‘রাজনীতিতে যে একটা ভারসাম্য থাকার কথা, সেটা এখন আর নেই। রাজনীতিতে যদি ভারসাম্য, নজরদারিত্ব না থাকে তাহলে যারা ক্ষমতা থাকেন তারা তো বেসামাল হয়ে যাবেন। যেটা এখন হচ্ছে।’
তার মতে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কতগুলো অধিকার থাকতে হয়। তার মধ্যে কতগুলো সংবিধান-স্বীকৃত, কতগুলো মৌলিক অধিকার। যেমন- বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা ইত্যাদি। এখন এগুলো ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনসহ কতগুলো আইনের মাধ্যমে অপরাধে পরিণত করা হয়েছে। কেউ যদি কারও বাসায় সামাজিক অনুষ্ঠানও করে, সেখানে গিয়ে পুলিশ হাজির হচ্ছে। আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো অপরাধে পরিণত করায় দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থানে বড় দুই দলই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে’— বলেও অভিযোগ করেন বদিউল আলম মজুমদার। বলেন, ‘নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করতে পারে— এমন কোনো কাজ করেনি কোনো দলই। বিএনপি ধর্মভিত্তিক দল (জামায়াত) নিয়ে একত্রে ক্ষমতায় থেকেছে। আওয়ামী লীগও তাদের সঙ্গে আন্দোলন করেছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের সঙ্গে খেলাফত মজলিসের একটি চুক্তি হয়। যেটি পরে বাতিল হয়। ওই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে তো আমরা মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতাম। আসলে আমাদের দেশে কোনো দলের মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি নেই। এটিই হলো বাস্তবতা।’
‘দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই’ বলেও দাবি করেন সুজন সম্পাদক। বলেন, ‘রাজনীতি থাকতে হলে নির্বাচন থাকতে হবে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ থাকতে হবে। বর্তমানে প্রশাসনিভাবে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন এতে বড় ভূমিকা রাখছে। রাজনীতি হলো আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়া, সমঝোতার প্রক্রিয়া; সেটা এখন নেই।’
এএইচআর/এমএআর/