হেনরি কিসিঞ্জারের সেই ‘বটমলেস বাস্কেট’-এর দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে সক্ষমতার চমক দেখাচ্ছে বিশ্বকে। চমকের ৫০-এ এসে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার (২০২১ সালের নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী)। ১৯৭১ সালে ১২৯ ডলারে শুরু করা বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৫৪ ডলার।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যার পর একাধিক গণতান্ত্রিক সরকার ও স্বৈরশাসক দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসলেও আর্থিক খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমকপ্রদ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় বিজয়ের ৫০ বছরে অর্থ ও বাণিজ্যের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক মুক্তি, রিজার্ভ, প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ে উন্নত দেশগুলোকেও টেক্কা দিচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে অনেক দেশ বাংলাদেশের উত্থানের কারণ খুঁজছে। উন্নয়ন ও ভৌগোলিক কারণে বিশ্বদরবারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের আগে যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত ৮০ শতাংশ মানুষ, আজ সেই সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যে। বাংলাদেশের প্রথম অর্থবছরে (১৯৭২-৭৩) বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ৫০ বছরের মাথায় এসে সেটি দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকায়।

বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৫৪ ডলার / ফাইল ছবি

গ্রামাঞ্চলে এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। বার্ষিক মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বশেষ পরিমাণ ২৪ হাজার মেগাওয়াট। খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪৫১ লাখ টন। স্বাধীনতার আগে এর পরিমাণ ছিল অনেক নিচে।

অন্যদিকে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৩৪৮ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় বেড়ে চলতি অর্থবছরের নভেম্বর মাসে ৪০৪ কোটি ১৪ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। টাকার অঙ্কে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) যা দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে যা ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) হিসাবে প্রায় ২০ বিলিয়ন (এক হাজার ৯৭৯ কোটি) ডলারের রফতানি আয় দেশে এসেছে। ওই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি কৃষি, তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স খাত। এতে ভর করেই বেড়েছে জিডিপি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘদিন ছিল ৩ থেকে ৫ শতাংশের ঘরে। তবে গত কয়েক বছর ধরে তা ৮ শতাংশের ওপরে ছিল। করোনা মহামারির কারণে এবার সেটা কিছুটা কমলেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। শিক্ষা, গড় আয়ু, আমদানি, রফতানি, রিজার্ভ, ডলারের মান, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু আয়ের মতো প্রতিটি সূচকে এখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে। অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এখন ভারত থেকেও এগিয়ে। বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানের কারণ খুঁজছে ভারতও।

উন্নয়নশীল দেশের সব সূচকে এগিয়ে বাংলাদেশ

উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে এক হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে প্রয়োজন হয় ৬৬ পয়েন্ট। এ সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান পয়েন্ট ৭৫.৩। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩৬ পয়েন্টের বেশি থাকা দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত হয়। এর মানে ৩২ পয়েন্টে আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করে কোনো দেশ। সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২ শতাংশ।

বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন / ছবি- সংগৃহীত

বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের আগে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পরিবার অতিদরিদ্র ছিল। মানে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষমতা ছিল না। বর্তমানে সংখ্যাটা কোভিডের আগে প্রায় ২০ শতাংশে নেমে এসেছিল। মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে ৭০-৮০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা উল্লেখযোগ্য বড় অর্জন।’

বেড়েছে সাক্ষরতার হার

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘উন্নয়নের সঙ্গে সাক্ষরতার হারও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দেশ স্বাধীনের পর বেশির ভাগ মানুষের অক্ষরজ্ঞান ছিল না। বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রাইমারি স্কুলে এনরোলমেন্ট প্রায় শতভাগ। মাধ্যমিকেও অনেক বেড়েছে। শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এটাও উন্নয়নের আরেকটা অর্জন।’

৫০ বছরে গড় আয়ু বেড়েছে ৩০ বছর

জাহিদ হোসেন বলেন, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক যেটা ধরা হয়, সেটা হচ্ছে আয়ুষ্কাল। আগে যেখানে মানুষ ৪০-৪১ বছর বাঁচত, এখন সেটা ৭০-এর ওপরে। তার মানে ৫০ বছরে গড় আয়ু বেড়েছে ৩০ বছরের ওপরে। এগুলো উন্নয়নের চূড়ান্ত ফসল।

কৃষির ওপর নির্ভরতা কমেছে

ড. জাহিদ হোসেনের ভাষায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর হয়েছে। যেমন- আমাদের শুরুতে সম্পূর্ণ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ছিল। ওই সময় প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। সেখান থেকে বর্তমানে কৃষি অর্থনীতি ৪০-৪২ শতাংশে নেমে এসেছে। এখন সেবা, শিল্প ও নির্মাণ খাতে জনগণের অংশগ্রহণ বেড়েছে। বর্তমানে কৃষির বহুমুখীকরণ হয়েছে। তার মানে, কৃষিতে এখন আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে, বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষির উৎপাদন হচ্ছে। স্বাধীনতার পর পাট ও চা ছিল রফতানি আয়ের প্রধান উৎস। সেখান থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে শিল্পপণ্যভিত্তিক রফতানি আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।’

মধ্যবিত্তের সামর্থ্যের মধ্যে আবাসন সুবিধা

‘আজ ঢাকায় যে বড় বড় ভবন হচ্ছে এর পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্তরা ঘরের মালিকানার স্বপ্ন দেখছেন। আগে কিন্তু এমন আবাসনের সুযোগ ছিল না। নির্মাণ খাতে বড় ধরনের একটা রূপান্তর ঘটেছে’— মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

বদলে গেছে যোগাযোগ-ব্যবস্থা

ড. জাহিদ হোসেনের মতে, স্বাধীনতার পর আমরা যখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতাম তখন তিনটি ফেরি পার হতে হতো। এখন তো সরাসরি গাড়িতে উঠে এক ঘুমেই চট্টগ্রামে পৌঁছানো যায়। এখন দেশের দক্ষিণ ও উত্তর দিকে যোগাযোগের সার্বিক উন্নয়ন হয়েছে। এছাড়া পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেলের কাজ হয়ে গেলে যোগাযোগের একটা বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। অন্যদিকে, গ্রামীণ অবকাঠামোয় গ্রামের রাস্তা ও বিদ্যুতায়নে আমরা ব্যাপক উন্নয়ন দেখেছি’

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অভাবনীয় সাফল্য

১৯৭১ সালে একটা বিষয় দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। দেশে ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষ। বছরে তিন শতাংশ হারে জনসংখ্যা বাড়ছিল। তখন এটাকে বলা হতো, ‘ম্যালথাসিয়ান পোভার্টি’। তার মানে, এভাবে যদি জনসংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে দেশ দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ে থাকবে। ১৯৮০ সাল থেকে আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ব্যাপকভাবে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে— বলেন ড. জাহিদ হোসেন।

কমেছে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি

দেশের এত অর্জন টেকসই করার জন্য আমাদের করণীয় কী— এমন প্রশ্নের জবাবে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনে জোর দিতে হবে। ২০১০ সালের পর থেকে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে, কিন্তু গতিটা কমে গেছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে ১.৮ শতাংশ। ২০১০ সালের পর থেকে এ হার প্রায় ১.২ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে। এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা আমরা শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসব। সেটা অর্জন করতে হলে দারিদ্র্যের হার কমানোর গতি বাড়াতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনের হার ধরে রাখতে হবে। সেই ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

চ্যালেঞ্জ আছে আরও

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে মডার্ন ইকোনমি ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। ঢাকা এখন বসবাস অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ হচ্ছে, নগরায়ণের বিস্তার ঘটছে না। সুতরাং নগরায়ণের ব্যবস্থাপনাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব উপশহর গড়ে উঠছে সেগুলোয় যেন একই পরিণতি না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এজন্য পরিকল্পিত নগর উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ করা বিশাল চ্যালেঞ্জ।’

তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে প্রবেশের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে যেতে হলে প্রযুক্তির উন্নয়ন, ব্যক্তি ও সরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রয়োজন। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এসবের সঙ্গে দক্ষ শ্রমশক্তির প্রয়োজন হবে। প্রযুক্তির সঙ্গে মিলতে হলে বিজ্ঞানের চর্চা বাড়াতে হবে। বিজ্ঞানচর্চা না করলে পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তির সঙ্গে চলা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের শিক্ষার প্রসার ঠিকই হয়েছে কিন্তু মানের দিক থেকে এখনও আমরা পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশে যে শিক্ষা আমাদের সাড়ে ছয় বছরে পাওয়ার কথা, সেই শিক্ষা পেতে সময় লাগে ১১ বছর। কাজেই এখানে সাড়ে চার বছরের ঘাটতি আছে। ঘাটতি থাকা মানে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। শিক্ষা-ব্যবস্থার মান উন্নয়নই এখন বড় চ্যালেঞ্জ— মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

তার মতে, ‘উন্নয়ন টেকসই করতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি বা বেসরকারি খাত এখনও ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। সরকারি বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি হলেও জনগণের প্রাপ্য সার্ভিসটা নিশ্চিত করতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও দেশ এগিয়ে যাবে।’

এসআর/এমএআর/