সরকারি যানের পেটে বাইসাইকেল লেন!
উন্নত শহরের আদলে বাইসাইকেলের চালকদের জন্য রাজধানীর আগারগাঁও ও মানিক মিয়া এভিনিউতে আলাদা লেন তৈরি করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। কিন্তু বছর না যেতেই সুপ্রশস্ত সড়কের কালো পিচের ওপর সাদা, হলুদ, নীল রঙের প্রলেপে ঝকঝকে-তকতকে বাইসাইকেল চিহ্ন আঁকা লেন ভুলতে বসেছেন সাইক্লিস্টরা।
মূলত দখলের কারণে লেনে সাইকেল চালানোর কোনো সুযোগ নেই চালকদের। অথচ সাইকেলের লেন চালুর খবরে সাইক্লিস্টদের মধ্যে যেন খুশির অন্ত ছিল না।
বিজ্ঞাপন
ডিএনসিসির নিজস্ব অর্থায়নে আলাদা সাইকেলের লেন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই। ২০২০ সালের মার্চে আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উত্তরপ্রান্ত থেকে এলজিইডি সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পর্যন্ত চালু করা হয় আলাদা লেন...
ব্যক্তিগত গাড়ি, স্টাফ বাস, লেগুনা, অ্যাম্বুলেন্স, চায়ের দোকান, রিকশার গ্যারেজ আর সারিসারি সাজানো সরকারি সব দপ্তরের যানবাহনের নিচে চাপা পড়েছে সাইকেলের লেন। খালি চোখে বোঝার উপায় নেই কিছুদিন আগেও এখানে চালু করা হয় আলাদা লেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় বাইসাইকেল চলাচলকে উৎসাহিত করতে সাইকেলচালকদের জন্য আগারগাঁওয়ের অফিস পাড়ার প্রায় নয় কিলোমিটার সড়কে আলাদা সাইকেলের লেন তৈরি করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে আলাদা সাইকেলের লেন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই। ২০২০ সালের মার্চে আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উত্তরপ্রান্ত থেকে এলজিইডি সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পর্যন্ত চালু করা হয় আলাদা লেন।
যেভাবে নগরবাসীকে সাথে নিয়ে ফুটপাত থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। তবে মনে রাখা জরুরি, নগরবাসীর সচেতনতা ও সক্রিয় প্রতিরোধই এ সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান
আতিকুল ইসলাম, মেয়র, ডিএনসিসি
সেসময় ডিএনসিসি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, সাইকেলের জন্য ছয় ফুট প্রশস্ত আলাদা লেন চালুর মধ্য দিয়ে বদলে যাবে আগারগাঁও এলাকার চিত্র। মডেল সড়ক হিসেবে সাইকেলের লেন তৈরির পাশাপাশি ফুটপাত, অনস্ট্রিট পার্কিং ও সবুজায়নে আগারগাঁও হবে মডেল এলাকা। চালুর পর কিছুদিন সেটা বজায় থাকলেও সত্যি বদলে যেতে থাকে চিত্র। তবে সেটা শুধু দখলেরই চিত্র! চালু করা সাইকেলের লেন দখলে চলে যাওয়ায় আগের মতো ঝুঁকি নিয়ে মূল সড়কে চলাচল করতে হচ্ছে সাইকেলচালকদের।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁও এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনের সড়কের সাইকেলের লেন দখল করে পাকিং অবস্থায় আছে সরকারি স্টাফ বাস। আছে প্রাইভেটকার, কিছু কিছু স্থানে টি-স্টলও বসানো হয়েছে। নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের সামনের সড়কে বাইসাইকেলের লেনের অস্তিত্ব হারিয়েছে হাসপাতালের চিকিৎসক-রোগীর স্বজনদের ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে। সেখানেও চোখে পড়ে অ্যাম্বুলেন্স আর লেগুনার সারি।
সরকারি সিদ্ধান্তে বাস্তবায়িত এ লেনের অধিকাংশ স্থান দখল করে আছে সরকারি দপ্তরের যানবাহন। এসব দেখার জন্য তো নিশ্চয়ই পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্ব রয়েছে
এম এ মতিন, সাধারণ সম্পাদক, বাপা
একই অবস্থা পরিবেশ অধিদপ্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, নির্বাচন কমিশন ভবন, এনজিও ব্যুরো, পিকেএসএফ কার্যালয়ের সামনের সড়কেও।
নির্বাচন কমিশন ভবন থেকে এলজিআরডি ভবন, পাসপোর্ট অফিসের সামনের সড়কের চিত্র আরও ভয়াবহ। এ এলাকায় বাইসাইকেলের জন্য আলাদা যে লেন চালু হয়েছে তা ভুলতে বসেছেন সবাই। একেকটা সড়ক যেন একেকটা সরকারি দপ্তর আর বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ির পার্কিং জোন। সারিসারি সাজানো যানবাহনের অবৈধ পার্কিংয়ে ঢাকা পড়েছে সাইকেলের লেন।
নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের সামনে বাইসাইকেলের লেনে অবৈধ পার্কিং করার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. আব্দুল জলিল নামে এক প্রাইভেটকারের চালক ঢাকা পোস্টকে জানান, এখানে পার্কিং সুবিধা নেই। দূরে গিয়ে রাখতে হচ্ছে। হাসপাতালের গ্যারেজে বাইরের গাড়ি ঢুকতে দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে এখানেই রাখা।
একই অবস্থা মানিক মিয়া এভিনিউতে চালু হওয়া এক কিলোমিটার সাইকেলের লেনেও। গতকাল বুধবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, লেনের ওপর পার্কিং করা সরকারি-বেসরকারি সব প্রাইভেটকার, রয়েছে বাস, ভ্যান-রিকশাও।
সব সড়ক থেকে চাইলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন- হাসপাতালের সামনের এলাকায়। এছাড়া আগারগাঁও এলাকায় সাইকেলের লেন চালুর বিষয়ে আমরা অফিসিয়ালি কিছু জানি না
ডিসি সাহেদ আল মাসুদ, তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগ
সড়কের সর্বডানে সাইকেলের লেন চালুর দাবি ছিল সাইক্লিস্টদের। তবে সে দাবি না মেনে সড়কের সর্ববাঁয়ের অংশটি বেছে নেওয়ায় লেনের জায়গা দখলে গেছে বলে মনে করেন সাইক্লিস্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিডি সাইক্লিস্টের অ্যাডমিন নাজমুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফুচকা, চটপটি ও চা-বিক্রেতা সাইকেল চালুর আগে থেকেই ছিল। তাছাড়া বামের লেনে চলে মোটরসাইকেল, গাড়ির পার্কিং তো আছেই। প্রশ্ন হচ্ছে, যে উদ্দেশ্যে সাইকেলের লেন চালু করা সেটার ফল শূন্য। আগারগাঁওয়ে সাইকেলের লেনের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না। সরকারি সব দপ্তরের গাড়ির নিচে চাপা পড়েছে পরিবেশবান্ধব এ উদ্যোগ। আমরা মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করেছি। দাবি জানিয়েছি, লেন থেকে সবকিছু উচ্ছেদ করার জন্য। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সাইকেল লেন এখন কথার কথা!
মানিক মিয়া এভিনিউতে নিয়মিত সাইকেল চালান ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাই স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও সাইক্লিস্ট অগ্র। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই যে দেখুন সাইকেলের লেন, দখল হয়ে গেছে। যে কারণে আমাকে বাধ্য হয়ে মূল সড়কে চলাচল করতে হচ্ছে। অন্য যানবাহনের ধাক্কায় পড়ে যেতে পারি, সে ঝুঁকি আছে জেনেও চলতে হচ্ছে। সবকিছু উচ্ছেদ করে আমাদের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করা উচিত।’
রাস্তার হকারদের জন্য নয়, সাইকেল লেন সাইক্লিস্টদের অগ্রাধিকার। সেটা নিশ্চিত করতে মানিক মিয়া এভিনিউতে অভিযান পরিচালিত হয়েছে, আগারগাঁওয়েও অভিযান চালানো হবে
এ এস এম মামুন, জনসংযোগ কর্মকর্তা, ডিএনসিসি
একটি প্রাইভেট কোম্পানির সিকিউরিটি ইনচার্জ মফিজ উদ্দিন। সাইকেল চালিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘সরকার এত এত টাকা খরচ করে সাইকেলের লেন বানাল, লাভ কী হলো? সবকিছু দখল হয়ে গেছে। সাইকেলের লেনের কোনো সুবিধা পাচ্ছি না। সুবিধা পাচ্ছে অবৈধভাবে পার্ক করে রাখা যানবাহনের মালিকরা।’
সাইকেলের লেন দখল হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক এম এ মতিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জনদাবির কারণে পরিবেশবান্ধব নগরী গড়তে রাজধানীতে সাইকেলের লেন হয়েছে। কিন্তু সেটার ফল শূন্য। লেনের ওপর সাইকেল চলতে পারে না। সরকারি সিদ্ধান্তে বাস্তবায়িত এ লেনের অধিকাংশ স্থান দখল করে আছে সরকারি দপ্তরের যানবাহন। এসব দেখার জন্য তো নিশ্চয়ই পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের দাবি, সাইকেলের লেনে চলুক সাইকেল। সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (অঞ্চল- ৫) মো. মাসুদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মানুষকে স্বাস্থ্যসচেতন করতেই রাজধানীতে পৃথক সাইকেলের লেনের উদ্যোগ। কিন্তু প্রায়শই আমরা অভিযোগ পাচ্ছি লেন দখলের। অভিযোগের ভিত্তিতে মানিক মিয়া এভিনিউতে লেন দখল করে রাখা স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। খুব শিগগিরই আগারগাঁওয়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
‘সরকারি দপ্তরের যানবাহনই বেশি অবৈধ পার্কিং করে থাকে। ফলে সাইক্লিস্টরা লেন ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারি দপ্তরগুলোতে চিঠি দিয়ে যানবাহন সড়কে পার্কিং না করার জন্য অনুরোধ করা হবে।’
ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এস এম মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাইকেল লেনের দাবি সাইক্লিস্টদের বহু পুরোনো। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক সাইকেলের পৃথক লেন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেটি বাস্তবায়িত হয় বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলামের হাত ধরে। কিন্তু সেই লেন দখলের অভিযোগ আসছে। রাস্তার হকারদের জন্য নয়, সাইকেল লেন সাইক্লিস্টদের অগ্রাধিকার। সেটা নিশ্চিত করতে মানিক মিয়া এভিনিউতে অভিযান পরিচালিত হয়েছে, আগারগাঁওতেও অভিযান চালানো হবে।
অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদে ট্রাফিক বিভাগের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁওয়ের উপ-কমিশনার (ডিসি) সাহেদ আল মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সব সড়ক থেকে চাইলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন- হাসপাতালের সামনের এলাকা। সেখানে রোগীর গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিগত গাড়ি থাকে। এসব রাখতে হাসপাতালগুলোতে স্থান সংকুলান হয় না।’
‘এছাড়া আগারগাঁও এলাকায় সাইকেলের লেন চালুর বিষয়ে আমরা অফিসিয়ালি কিছু জানি না। সেখানে যদি অবৈধ স্থাপনা থাকে সে দায় সিটি করপোরেশনের। তবে অবৈধ পার্কিং থাকলে আমরা অবশ্যই নির্বাচন কমিশন এলাকায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
বাইসাইকেলের লেনের ওপর পুলিশবক্স, অস্থায়ী দোকানপাট ও গাড়ি পার্কিং গড়ে ওঠার অভিযোগের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। গত মাসের ২৫ ডিসেম্বর নিজ ফেসবুক পেজে ক্ষোভ প্রকাশ করে মেয়র আতিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘যানজটের নগরীতে সাইকেল আরোহীদের আরও উৎসাহিত করতে তৈরি করা হয়েছে আলাদা সাইকেলের লেন। অথচ পুলিশবক্স স্থাপন, অবৈধ পার্কিং এবং নানাভাবে বেদখলের কারণে লেনের সুফল পাচ্ছেন না আরোহীরা। এ অবস্থা চলতে দেয়া হবে না।’
‘যেভাবে নগরবাসীকে সাথে নিয়ে ফুটপাত থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। তবে মনে রাখা জরুরি, নগরবাসীর সচেতনতা ও সক্রিয় প্রতিরোধই এ সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান।’
জেইউ/এমএআর