‘ঢাকা চাকা’র ভাড়া ভোগান্তিতে নাভিশ্বাস উঠেছে যাত্রীদের, তবুও যেতে হয়... | ছবি- ঢাকা পোস্ট

রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকাগুলোতে জনসাধারণের নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিতের জন্য রাস্তায় নামানো হয়েছিল ‘ঢাকা চাকা’ বাস সার্ভিস। উদ্যোগটি নিয়েছিলেন তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক। গুলশান- ২ থেকে জিএমজি পর্যন্ত রুটের যেকোনো স্থানে যাওয়ার জন্য ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ টাকা। নগরবাসী এ বাস সার্ভিসকে সানন্দে গ্রহণও করেছিল।

কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হয় চলতি বছর জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে। জিএমজি থেকে রুট বাড়ানো হয় নাবিস্কো পর্যন্ত। কার্যকর করা হয় নতুন ভাড়া। যাত্রীরা বলছেন, নতুন ভাড়া এখন তাদের জন্য ‘জুলুমে’ পরিণত হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকা এবং কম ভাড়ার জন্য এখন সার্ভিস বন্ধের উপক্রম হয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই ভাড়া বাড়াতে হয়েছে।

গতকাল বুধবার (২৭ জানুয়ারি) রাজধানীর গুলশান- ২, গুলশান- ১ ও পুলিশ প্লাজা বাস স্টপেজ ঘুরে দেখা যায়, প্রতি দুজনে অন্তত একজন নতুন ভাড়ার বিষয়ে জানেন না। কেউ কেউ ১৫ টাকা দিচ্ছেন কাউন্টারে, সেটা আবার কাউন্টার মাস্টার ফিরিয়েও দিচ্ছেন। নতুন ভাড়া নিয়ে যাত্রী ও কাউন্টার মাস্টারের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতেও দেখা গেছে। তবে একটি বিষয়ে তারা সবাই সম্মত হয়েছেন, নতুন ভাড়া ন্যায্য হয়নি।

গুলশান- ২ থেকে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত আগে ১৫ টাকা ভাড়া ছিল, সেটা মানা যায়। কিন্তু সেই একই দূরত্বের ভাড়া কোনো কারণ ছাড়াই এখন ২০ টাকা। এটা কী করে মানব

ভুক্তভোগী যাত্রী রেজাউল করিম

আক্ষেপ করে এনসিসি ব্যাংকের কর্মচারী মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাস কোম্পানি পাঁচ টাকার ভাড়া ২০ টাকা রাখছে, নিঃসন্দেহে এটা একটা জুলুম। গুলশান- ২ থেকে ১ এর দূরত্ব কতটুকুই-বা, সেখানে কী করে ২০ টাকা ভাড়া হতে পারে? এটা জুলুমই। দিনে আমাকে চার থেকে ছয়বার গুলশান- ২ থেকে ১-এ আসা-যাওয়া করতে হয়। এখানে তো দিনে আমার ভাড়া গুনতে হচ্ছে ২৪০ টাকা। অথচ ৬০ টাকা দিয়ে মতিঝিলে যাতায়াত করা যায়। গুলশান- ২ থেকে ১-এর সর্বোচ্চ ভাড়া ১০ টাকা করলে ভালো হয়।’

শিক্ষার্থী আরিফ খান বলেন, “শুরু থেকেই আমি ‘ঢাকা চাকা’র যাত্রী। প্রথমে এটি যে অবস্থায় ছিল, এখন আর সে অবস্থায় নেই। এর চেয়ে ‘গুলশান চাকা’ বাসের চেয়ার ও এসির কন্ডিশন অনেক ভালো। ‘ঢাকা চাকা’র এসি থেকে এখন দুর্গন্ধ বের হয়, চেয়ারগুলোও প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।”

আসন খারাপ, এসি নষ্ট, বের হয় দুর্গন্ধও- অভিযোগ ‘ঢাকা চাকা’র যাত্রীদের | ছবি- ঢাকা পোস্ট  

প্রাইভেট কোম্পানির সার্ভিস হোল্ডার রেজাউল করিম বলেন, ‘নতুন ভাড়া হয়রানিমূলক হয়ে গেছে। গুলশান- ২ থেকে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত আগে ১৫ টাকা ভাড়া ছিল, সেটা মানা যায়। কিন্তু সেই একই দূরত্বের ভাড়া কোনো কারণ ছাড়াই এখন ২০ টাকা। এটা কী করে মানব?’

শুধু করোনাকালীনই আমাদের ৪০টি বাসে ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ২৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আমরা আমাদের কর্মী কমিয়েছি, তাদের বেতনও কমিয়েছি। তারপরও পেরে উঠছি না

সুভাষ বিশ্বাস, ম্যানেজার, ঢাকা চাকা

‘ভাড়া বাড়ার বিষয়টি সত্যিই যাত্রীদের জন্য জুলুম হয়েছে’ বলে স্বীকার করেছেন কাউন্টার মাস্টাররা। তবে তারাও নিরুপায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কাউন্টার মাস্টার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন ভাড়া সত্যিই অযৌক্তিক। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। আমরা তো শুধুমাত্র চাকরি করি। কোম্পানি আজ থেকে পাঁচ টাকা ভাড়া নেওয়ার ঘোষণা দিলে তা-ই নেব।

আরেক কাউন্টার মাস্টার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মিটিংয়ে উত্থাপন করেছিলাম, গুলশান- ২ থেকে জিএমজি পর্যন্ত ভাড়া ১৫ টাকাই থাকুক। আর শান্তা টাওয়ার ও নাবিস্কো পর্যন্ত ২৫ টাকা করলে জনগণের খুব একটা অসুবিধা হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ‘গুলশান চাকা’ ও ‘ঢাকা চাকা’ যৌথভাবে কাজ শুরু করেছে। তাই প্রথমে জিএমজি পর্যন্ত পাঁচ টাকা ভাড়া বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০ টাকা। শান্তা টাওয়ার ও নাবিস্কো পর্যন্ত করা হয়েছে ৩০ টাকা। শুধু তা-ই নয়, আমাদের বেতনও কমিয়ে দিয়েছে দুই-তিন হাজার টাকা।

অতিরিক্ত ভাড়া যাত্রীদের জন্য জুলুম, স্বীকার করলেও করার কিছু নেই- ‘ঢাকা চাকা’ কর্তৃপক্ষ | ঢাকা পোস্ট

ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ‘ঢাকা চাকা’র ম্যানেজার (অ্যাকাউন্টস) সুভাষ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিআরটিএ’র তালিকা অনুযায়ী এসি বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। কিন্তু যাত্রীদের সুবিধার্থে আমরা আগে থেকেই ১৫ টাকা ভাড়া নিতাম। কিন্তু এখন আর সে সুযোগ নাই। আমাদের বাঁচতে এবং কোম্পানিকে বাঁচাতে ভাড়া বৃদ্ধি করতেই হয়েছে। শুধু করোনাকালীনই আমাদের ৪০টি বাসে ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ২৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আমরা আমাদের কর্মী কমিয়েছি, তাদের বেতনও কমিয়েছি। তারপরও পেরে উঠছি না।

‘স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় আগের মতো যাত্রীও নেই। পাঁচ টাকা ভাড়া বৃদ্ধি যাত্রীদের জন্য জুলুম হতে পারে, কিন্তু আমাদের দিকটাও তো দেখতে হবে। না হলে এখন কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।’

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর একই বছরের ১০ আগস্ট রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান-বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকার নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সার্কুলার বাস সার্ভিস চালু করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘ঢাকা চাকা’। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক বিশেষ এ বাস নামানোর পরিকল্পনা করেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে, ডিএমপি’র সহায়তায় এবং গুলশান-বারিধারা-বনানী-নিকেতন সোসাইটি’র উদ্যোগে এটি চলছে।

এইচএন/এমএআর/