বায়ুদূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের উদাসীনতায় বাড়ছে এ দূষণ I ছবি- সংগৃহীত

বায়ুদূষণ পরিবেশ ও জনজীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি। নিয়মিত কম-বেশি হচ্ছে এ দূষণ। দূষণের শুরুটা বায়ু থেকে হলেও শেষ হচ্ছে জনজীবন ও প্রকৃতি বিনষ্টের মধ্য দিয়ে। যা পুরো পৃথিবীর জন্যই মারাত্মক হুমকি। প্রতিনিয়ত দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বায়ুদূষণ রোধে সরকারের মাইন্ডসেটের (মানসিকতা) পরিবর্তন প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘যতটুকু প্রতিকারের দরকার, আমরা চেষ্টা করছি।’

গত ১০ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় বায়ুর মানের সূচক ছিল ৫০২। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এমন মান ‘বিপদজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। এর আগে ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ বায়ুর মানের সূচকে উঠেছিল ৩১০-এ।

বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুর মান সূচকে শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ‘ভালো’। ৫১ থেকে ১০০ হলো ‘পরিমিত’, ১০১ থেকে ১৫০ ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’, ১৫১ থেকে ২০০ ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০০ থেকে ৩০০ ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১ ছাড়িয়ে গেলে সেটা ‘বিপদজনক’ বলা হয়।

গত ১০ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় বায়ুর মানের সূচক ছিল ৫০২। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এমন মান ‘বিপদজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। এর আগে ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ বায়ুর মানের সূচকে উঠেছিল ৩১০-এ...

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুর মান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর সর্বশেষ (২৬ জানুয়ারি) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে বায়ুদূষণের তালিকায় গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। বায়ুর মান ২২৩, অর্থাৎ ঢাকার সার্বিক অবস্থা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। প্রথম স্থানে আছে কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেক। সেখানে বায়ুর মান ৩০২, অর্থাৎ ‘বিপদজনক’ অবস্থা। দ্বিতীয় স্থানে আছে চীনের সেনইয়াং শহর। বায়ুর মান ২৬৮, অর্থাৎ সেখানে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থা বিরাজ করছে।

বায়ুদূষণ একটি বড় সমস্যা। এটা প্রতিরোধে সরকারকে প্রথমে মাইন্ডসেট করতে হবে। সমস্যাটা সরকারের, এটা মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে

বাপা সদস্য সচিব শরীফ জামিল

বায়ুদূষণের ফলে মানুষের ফুসফুস, লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা। নারীদের গর্ভপাতেও জটিলতা তৈরি হয়। অন্যদিকে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়। বায়ুদূষণ রোধে যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যক্তি, সমাজ ও সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তবে কোনোভাবেই এটি নিবারণ করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তবে কতটুকু পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বায়ুদূষণ প্রতিরোধে কাজ করা সংগঠনগুলো।

বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া। এদিকে যেন খেয়াল নেই কারও | ছবি- সংগৃহীত 

বায়ুদূষণের কারণ

বায়ুদূষণ বাড়ার পেছনে দুটি কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তার একটি হচ্ছে ‘উৎস’, আরেকটি হচ্ছে ‘কারণ’। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে— প্রাকৃতিক কিছু বিষয় (আবহাওয়া ও জলবায়ু), নগর পরিকল্পনার ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা, আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং অধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব। অন্যদিকে উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে— সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তায় চলাচলরত গাড়ির কালো ধোঁয়া, ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, ইটের ভাটা ও শিল্প কারখানা, উন্মুক্তভাবে আবর্জনা পোড়ানো, বস্তি এলাকার বর্জ্য পুড়ানো এবং আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ।

১০ জানুয়ারি কেন রেকর্ড গড়ল ঢাকা?

ঢাকা শহরের প্রায় ১০০টি স্থানে এখনও রাস্তা খোঁড়া অবস্থায় আছে। এছাড়া বড় বড় প্রকল্পের কাজ চলছে (মেট্রোরেল)। ফলে রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা হয়েছে। এছাড়া রাতে রাজধানীতে দূরপাল্লার বাস ও নির্মাণসামগ্রী বহনকারী ট্রাক চলাচল করে। ফলে ধুলা ওড়ে। যখন এসব উৎসগুলো থেকে দূষণ সৃষ্টি হয় তখন ধুলাবালি দূরে চলে না গিয়ে আমাদের ঢাকার আকাশে অবস্থান করে।

২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম ১১ দিনে সর্বোচ্চ বায়ুর মানসূচক ছিল ১৯০। ২০১৭ সালে ছিল ১৮৮, ২০১৮ সালে ছিল ২১৮, ২০১৯ সালে ১৮৮, ২০২০ সালে ছিল ২২৯ এবং ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল ২৫১। অর্থাৎ পেছনের পাঁচ বছরের তুলনায় ২০২১ সালে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে ২০-২১ শতাংশ...

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের মেট্রলজিক্যাল ডাটার হিসাব মতে, ঢাকার বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় দুই কিলোমিটারের নিচে। যেটি স্বাভাবিকভাবে আট কিলোমিটার পর্যন্ত থাকার কথা। ফলে দূষিত যে বায়ুর চলে যাওয়ার কথা সেটা যেতে পারেনি। কুয়াশার কারণে ভারী হয়ে নিচের দিকে চলে এসেছে। এছাড়া ওপর থেকে বায়ুর চাপ বেড়েছে, তার ওপর শীতকাল। এ কারণে জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখ বায়ুদূষণের মান ৫০২ পর্যন্ত ওঠে।

ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। রাজধানী ঘিরে এমন অসংখ্য ইটভাটা লক্ষ্য করা যায়  

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে দেখেছেন, দূষিত বায়ুগুলো ঢাকার রাস্তা থেকে মোটামুটি এক কিলোমিটার ওপরে গিয়ে অবস্থান করা শুরু করেছে। দুই কিলোমিটার ওপরে ভালো মানের বায়ু আছে। মূলত গ্রাউন্ড লেভেল থেকে এক-দেড় কিলোমিটার ভেতরের বায়ুটুকু হচ্ছে খারাপ।

বায়ুর মান বছরে কতদিন খারাপ থাকে

বায়ুদূষণ কম বা বেশি সবসময়ই হতে পারে। তাই বায়ুর মানসূচক কম বা বেশি হওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি— এই চার মাস বায়ুর মানসূচকে অন্তত চারবার বিপদজনক অবস্থানে চলে যায়। গত নভেম্বরে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু ডিসেম্বরের ৬ তারিখে ঢাকার বায়ুর মান ৩১০ পর্যন্ত উঠেছিল। সাধারণত যদি বায়ুর মান খারাপ হয় সেটা চার থেকে পাঁচদিন একটানা থাকে। একটা ধোঁয়াশা অবস্থা তৈরি হয়। এমন ঘটনা বছরের পর বছর চলে আসছে। অর্থাৎ সারা বছরে ২০ থেকে ২৫ দিন এটা হয়ে থাকে। ওই সময় বায়ুর মান খারাপ হয়— বলেন বিশেষজ্ঞরা। এ বছর বায়ূর মানসূচক জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখ থেকে বৃদ্ধি পায়। ১০ জানুয়ারি তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে (৫০২) ওঠে।

৫ বছরে বায়ুদূষণ বেড়েছে ২১ শতাংশ

উদ্বেগের বিষয় হলেও গত পাঁচ বছরে বায়ুদূষণের পরিমাণ একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে। বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শুধু জানুয়ারি মাসগুলো ধরে যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম ১১ দিনে সর্বোচ্চ বায়ুর মানসূচক ছিল ১৯০। ২০১৭ সালে ছিল ১৮৮, ২০১৮ সালে ছিল ২১৮, ২০১৯ সালে ১৮৮, ২০২০ সালে ছিল ২২৯ এবং ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল ২৫১। অর্থাৎ পেছনের পাঁচ বছরের তুলনায় ২০২১ সালে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে ২০-২১ শতাংশ।

সরকারের মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল। এটি নির্মাণেও ভারী হচ্ছে ঢাকার হাওয়া | ছবি- সংগৃহীত  
করোনাকালীন বায়ুদূষণের মাত্রা কিছুটা কমেছিল বটে, তবে সেটা বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পরে দূষণের মাত্রা বেড়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে এসে তা অন্য বছরগুলোর তুলনায় মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে

বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার

তিনি বলেন, করোনাকালীন বায়ুদূষণের মাত্রা কিছুটা কমেছিল বটে, তবে সেটা বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পরে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে এসে তা অন্য বছরগুলোর তুলনায় মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একবার ‘অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থা তৈরি হলে টানা চার থেকে পাঁচদিন থাকার কথা। কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখে শুরু হওয়া বায়ুমান সারামাসই খারাপ থাকে। দীর্ঘ সময় একটা ধোঁয়াশাপূর্ণ অবস্থা তৈরি হয় ঢাকার আকাশে। ধুলা আর কুয়াশা মিলে এ খারাপ অবস্থার তৈরি হয়। দিনের বেলা আপনি সূর্য দেখছেন না চার-পাঁচ-ছয়দিন ধরে। অল্প সময়ের জন্য হয়তো সূর্য দেখছেন। মূলত বাতাস ভেদ করে সূর্যের আলো আমাদের গ্রাউন্ড লেভেলে পৌঁছাতে পারছে না।

বায়ুদূষণ জনজীবনে কোন ধরনের প্রভাব ফেলে— জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ বাতাস গ্রহণ করি অক্সিজেন নেওয়ার জন্য। অক্সিজেন আমাদের শরীরে শক্তি কোষগুলোতে খাদ্য সরবরাহ করে। আমরা অক্সিজেন নেওয়ার জন্য যে বাতাস গ্রহণ করি, সেটি যদি দূষিত হয় তা হলে দূষিত পদার্থ শরীরে ঢোকে। এতে আমাদের ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলো বেড়ে যায়। কারও শ্বাসতন্ত্রে অ্যালার্জি দেখা যায়, কাশি হয় এবং দীর্ঘ সময় দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকলে ফুসফুসের ক্যান্সারও হয়। 

‘দূষিত বায়ুর সঙ্গে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে যক্ষ্মা পর্যন্তও হয়, নিউমোনিয়া হয়। এগুলো হচ্ছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। দীর্ঘকাল ধরে যে অসুবিধাগুলো হয় সেগুলো হচ্ছে- ফুসফুসে ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের ক্ষত তৈরি হয়ে এর কাজের ক্ষমতা কমে যাওয়া। একটা সময় গিয়ে সেটা আর যথাযথভাবে কাজ করতে পারে না। তখন শ্বাসতন্ত্র ফেইলর হয়।’

বায়ুদূষণের ফলে মানুষের ফুসফুস, লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা। নারীদের গর্ভপাতেও জটিলতা তৈরি হয়। অন্যদিকে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়। বায়ুদূষণ রোধে যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যক্তি, সমাজ ও সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তবে কোনোভাবেই এটি নিবারণ করা সম্ভব নয়...

তিনি বলেন, যখন শরীরে অক্সিজেন কমে যায় তখন প্রত্যেকটা কোষ দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে শারীরিক দুর্বলতা, ঝিমঝিমভাব, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, মাথা ঘুরানো, বমি বমিভাব, ঘুম না হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। ঘুম না হলে ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়। ফলে হার্টের রোগ তৈরি হয়। এছাড়া দূষিত বাতাসের সঙ্গে পার্টিকুলার ম্যাটার (পিএম) অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্রকণা শরীরে ঢুকে পড়ে। এটি ফুসফুস থেকে শরীরের রক্তস্রোতে চলে যেতে পারে। গেলে ফুসফুসের সাথে সাথে কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্য দিয়ে অঙ্গগুলোর কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে কিডনি ও লিভারের রোগ তৈরি হয়। দূষিত বাতাসের সঙ্গে কিছু গ্যাস থাকে। যা নারী ও পুরুষের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

দূষিত বায়ুর সঙ্গে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে যক্ষ্মা পর্যন্তও হয়, নিউমোনিয়া হয়। এগুলো হচ্ছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। দীর্ঘকাল ধরে যে অসুবিধাগুলো হয় সেগুলো হচ্ছে- ফুসফুসে ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের ক্ষত তৈরি হয়ে এর কাজের ক্ষমতা কমে যাওয়া। একটা সময় গিয়ে সেটা আর যথাযথভাবে কাজ করতে পারে না। তখন শ্বাসতন্ত্র ফেইলর হয়

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী

‘এর বাইরে আরও একটি বিষয় ঘটে। দূষিত বায়ু গাছপালার পাতার ওপর একটি প্রলেপ ফেলে দেয়। ফলে গাছগুলোর সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এতে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থাৎ অক্সিজেন কমে যায়, কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে যায়। ফলে মানুষের পাশাপাশি অন্য সব প্রাণীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়ুদূষণ প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে সমস্ত জীবন ও প্রকৃতি বিনষ্টের মধ্য দিয়ে।

বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে যা করণীয়

বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে ব্যক্তিগত আচরণ ও সমষ্টিগত আচরণের পরিবর্তন প্রয়োজন। ব্যক্তিগত আচরণের মধ্যে পড়ে আমাদের দোকানপাট, বাসাবাড়ি বা অন্যান্য বর্জ্য যেকোনো জায়গায় না ফেলা, গাড়িগুলোর ফিটনেস ঠিক রাখা যেন কালো ধোঁয়া বের না হয়, নির্মাণ কর্মকাণ্ডের সামগ্রীগুলো ঢেকে রাখা এবং নির্মাণকাজ হওয়া এলাকায় নিয়মিত পানি ছিটানো। সমষ্টিগত আচরণের মধ্যে পড়ে যেমন- ইটের ভাটা বা জনবসতির আশেপাশে কোনো কারখানা থেকে যদি বায়ুদূষণ ঘটে, সেটি সকলে মিলে বন্ধ করার ব্যবস্থা করা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যদি তা না মানে, তা হলে কর্তৃপক্ষকে জানানো। এভাবে ব্যক্তি বা সমষ্টিগত ও সরকারি উদ্যোগে বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব।

ঢাকার আবহাওয়া, এই শীতে আরও বেশি ভারী হয়েছে ঢাকার আকাশ সঙ্গে দূষণও | ছবি-সংগৃহীত   

এছাড়া বায়ুদূষণের মান যখন বেড়ে যায় তখন যেন বৃদ্ধ, শিশু ও গর্ভবতী নারীরা যেন মাস্ক ব্যবহার করেন, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। বায়ুদূষণ থেকে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতো সতর্কতা সঙ্কেত চালু করারও পরামর্শ দেন।

বায়ুদূষণ রোধে সরকারের মাইন্ডসেট পরিবর্তন প্রয়োজন

বায়ুদূষণ রোধে সরকারের মাইন্ডসেট পরিবর্তনের প্রয়োজন— এমন মন্তব্য করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সদস্য সচিব শরীফ জামিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য মূলত তিনটি বিষয় অন্যতম। ইটভাটা, যানজট ও ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট (বর্জ্য ব্যবস্থাপনা)। এগুলো সমাধানের জন্য আমাদের কম্প্রিহেনসিভ গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণের জন্য একধরনের ইমপ্রুভমেন্ট আছে, যানজট নিরসনের জন্য আরেক ধরনের ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন এবং ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য আরেক ধরনের ব্যবস্থাপন।

তিনি আরও বলেন, বায়ুদূষণ একটি বড় সমস্যা। এটা প্রতিরোধে সরকারকে প্রথমে মাইন্ডসেট করতে হবে। সমস্যাটা সরকারের, এটা মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য সবাইকে নিয়ে সরকারের যে ব্যবস্থাপানা, সেটা তারা করছেন না। সরকারকে বলতে চাই, এ বিষয়ে তাদের প্রথমে মাইন্ডসেট ঠিক করে একটি পলিসি তৈরি করতে হবে।

বায়ুদূষণ নিরসনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটার জন্য আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। সিটি করপোরেশনকে আমরা বারবার চিঠি দিয়েছি, তারা এখন রাস্তায় পানি দিচ্ছে। ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টসহ বায়ুদূষণের আরও অনেক কারণ আছে। এগুলোর জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্পগুলোকে আমরা চিঠি দিয়েছি, যেন তারা সবসময় পানির ব্যবহার করে। এটাই করণীয়।

‘নির্মাণকাজ হলে তো ধুলাবালি উড়বেই। যতটুকু প্রতিকারের দরকার, আমরা চেষ্টা করছি সেই ব্যবস্থা করার। একদিনে তো সব সম্ভব নয়। ঢাকার বায়ুর মান একদিন হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। এখন কন্ট্রোলে চলে এসেছে।

এইচএন/এমএআর/