‘মৃত’ শ্বশুরের ৫ কোটি দান, দুদকের ফাঁদে পুলিশের সাবেক কর্তা
ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বৈধ করতে কত পন্থাই অবলম্বন করেন দুর্নীতিবাজরা। আইনের চোখ ফাঁকি দিতে তারা হরহামেশাই অভিনব কৌশল নেন। কেউ কেউ পার পেয়ে যান, আবার কেউ ধরাও পড়েন। পুলিশের এমন এক সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যাংকে এককালীন স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) টাকা বৈধ করতে অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। টানা ১৮ বছর অনুসন্ধান আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তার আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি উন্মোচন করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
কমিশনের জালে ধরা পড়া ওই ব্যক্তির নাম আবদুল মাবুদ। তিনি অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক। অবৈধ উপায়ে অর্জিত প্রায় পাঁচ কোটি টাকা বৈধ করতে আবদুল মাবুদ জাল কাগজপত্র সৃজন করেন। জালিয়াতির এ কাজে তাকে সহায়তা করেন স্ত্রী নাসিমা খান ও শাশুড়ি সাহানারা খান।
বিজ্ঞাপন
অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবদুল মাবুদ অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়াভাবে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও হলফনামা সৃষ্টি করে আয়ের উৎসের মিথ্যা তথ্য ও দান দেখিয়ে পাঁচ কোটি তিন লাখ তিন হাজার টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াসহ তার অবৈধ আয়কে বৈধ করার পূর্বপরিকল্পনা করেন মাবুদ। যা দুদক আইন- ২০১৪ এর ২৭ (১) ধারাসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও দণ্ডবিধির ৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ...
এ বিষয়ে দুদকের বক্তব্য হলো, প্রায় ১৪ বছরের নিখুঁত শ্রম, শাশুড়ি ও স্ত্রীর সহায়তায় জাল কাগজ তৈরির মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্জিত পাঁচ কোটি টাকা ঠিকই নিজের করে নেন আবদুল মাবুদ। যা ইতোমধ্যে নিজ আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন তিনি।
দুদক সূত্র জানায়, ঘটনার সূত্রপাত ২০০৯ সালে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আবদুল মাবুদ সাত থেকে আটটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে বিভিন্ন ধাপে ৪৩টি এফডিআরে গচ্ছিত রাখেন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। অবৈধভাবে অর্জিত ওই টাকা বৈধ করতে নাটক সাজান মাবুদ। সেই নাটকের নানা কানাগলির রহস্য উন্মোচনে দুদকের লেগে যায় ১৮ বছর। ২০০২ সালে শুরু হওয়া অনুসন্ধানের সমাপ্তি সহসাই করতে যাচ্ছে তদন্ত সংস্থা দুদক।
আবদুল মাবুদের বক্তব্য ও আয়কর নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৩ সালে শাশুড়ি সাহানারা খানের কাছ থেকে দান হিসেবে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ দেখান দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। ওই অর্থ বৈধ করতে জাল হলফনামা ও স্ট্যাম্প দিয়ে তৈরি করেন দানপত্র। সেখানে মাবুদ দেখিয়েছেন, সাহানারা খান তার মেয়ে অর্থাৎ আবদুল মাবুদের স্ত্রী নাসিমা খানকে ওই টাকা দান করেছেন। যা পরবর্তীতে সুদ ও আসলসহ প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা স্ত্রীর কাছ থেকে দানসূত্রে গ্রহণ করেন আবদুল মাবুদ। এক্ষেত্রে যে হলফনামা ও স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়েছে তা জাল বলে ইতোমধ্যে দুদকের কাছে প্রমাণিত হয়েছে।
জাল দানপত্রের বিষয়টি নিশ্চিতে আবদুল মাবুদের শাশুড়িকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। জিজ্ঞাসাবাদে সাহানারা খান দাবি করেন, তার স্বামী ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। স্বামীর রেখে যাওয়া অর্থ থেকে দুই কোটি ৫০ লাখ কোটি টাকা মেয়েকে দান করেন। অথচ তার স্বামী আকরাম খান (মাবুদের শ্বশুর) ১৯৮৩ সালে মারা যান। কিন্তু কাগজপত্রে আবদুল মাবুদ দেখিয়েছেন, ২০০৩ সালে সাহানারা খান (শাশুড়ি) ওই অর্থ দান করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে গত ২০ বছর ধরে ওই টাকা কোথায় ছিল, কীভাবে ওই টাকা আসল— এমন প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি সাহানারা খান।
যেহেতু অনুসন্ধান চলছে এবং আপনার দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী মামলার অনুমোদন হয়নি। তাই এ পর্যায়ে দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে পারে না
প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য, দুদক পরিচালক (জনসংযোগ)
দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, জাল হলফনামা ও জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহার করে আবদুল মাবুদ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে করা এফডিআর বৈধ করতেই এমন মিথ্যা নাটকের আশ্রয় নেন। এ প্রক্রিয়ায় ২০১৬ ও ২০১৭ সালে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা দানসূত্রে মালিক হয়েছেন দেখিয়ে আয়কর রিটার্নেও প্রদর্শন করেন তিনি।
দুর্নীতির এমন ঘটনায় অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক শাহীন আরা মমতাজ দুদক আইনের ২৭ (১) ধারায় মামলার সুপারিশ করেছেন। এছাড়া পুলিশের সাবেক এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নামে আরও সম্পদের তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। যে কারণে শিগগিরই তার বিরুদ্ধে সম্পদের নোটিশ ইস্যু করা হতে পারেও বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে উপ-পরিচালক শাহীন আরা মমতাজের কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুসন্ধানপর্যায়ে কোনো তথ্য দিতে অস্বীকার করেন। একই সঙ্গে এ বিষয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন।
দুদক পরিচালক (জনসংযোগ) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যেহেতু অনুসন্ধান চলছে এবং আপনার দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী মামলার অনুমোদন হয়নি। তাই এ পর্যায়ে দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে পারে না।’
অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবদুল মাবুদ একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বৈধ করার উদ্দেশ্যে তার স্ত্রী নাসিমা খানের সঙ্গে পারস্পরিক যোগসাজশে অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ওই উদ্দেশ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়াভাবে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও হলফনামা সৃষ্টি করে আয়ের উৎসের মিথ্যা তথ্য ও দান দেখিয়ে পাঁচ কোটি তিন লাখ তিন হাজার টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াসহ তার অবৈধ আয়কে বৈধ করার পূর্বপরিকল্পনা করেন মাবুদ। যা দুদক আইন- ২০১৪ এর ২৭ (১) ধারাসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও দণ্ডবিধির ৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগের বিষয়ে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবদুল মাবুদের বক্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
এর আগে একই অভিযোগের বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা নুর ইসলাম সরকার, উপ-পরিচালক গোলাম মোস্তফা ও সহকারী পরিচালক খন্দকার আখেরুজ্জামান অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন বলে দুদক সূত্রে জানা যায়।
আরএম/এমএআর/