বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন | ছবি- ঢাকা পোস্ট

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকার প্রতি ডোজের দাম কত হবে তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, প্রতি ডোজ টিকার ক্রয়মূল্য চার ডলার। সব খরচ মিলিয়ে দাম পড়বে পাঁচ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে ৪২৫ টাকার মতো।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে ইতোমধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তি অনুযায়ী বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত টিকার ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’। ভারত থেকে টিকা এনে বাংলাদেশে সরবরাহ করবে দেশের ওষুধ খাতের শীর্ষ কোম্পানিটি। করোনাভাইরাসের এ টিকা সরকার কিনে তা বিনামূল্যে বিতরণ করবে বলে আগেই জানানো হয়েছে।

ভারত সরকারের নির্ধারিত মূল্যেই সেরামের কাছ থেকে টিকা কিনছে বাংলাদেশ। তবে এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে কত দাম পড়বে? তবে তিন থেকে চার ডলারের মধ্যে হবে। ভারত সরকার চার ডলার করে কিনলে বাংলাদেশও চার ডলারের বেশি দেবে না

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন

রোববার (২৪ জানুয়ারি) রাতে গুলশানে নিজ বাসভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে টিকার দামের বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার করেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন। তিনি বলেন, ‘ভারত সরকারের নির্ধারিত মূল্যেই সেরামের কাছ থেকে টিকা কিনছে বাংলাদেশ। তবে এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে কত দাম পড়বে? তবে তিন থেকে চার ডলারের মধ্যে হবে। ভারত সরকার চার ডলার করে কিনলে বাংলাদেশও চার ডলারের বেশি দেবে না।’

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশের বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি প্রতিনিধিদের জন্য আলাদা ১০ লাখ ডোজ টিকা আসবে বলেও জানান তিনি। বলেন, চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরতরাও ভয়াবহ করানো ঝুঁকিতে আছেন। অনেকেই কর্মক্ষেত্রে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু তারা সরকারের প্রথম সারির ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির তালিকার নেই। এটা দুঃখজনক।’

মন্ত্রণালয়ে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক | ছবি- ঢাকা পোস্ট

‘বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো আমাদের বারবার অনুরোধ করছে, তাদের জন্যও কিছু ভ্যাকসিন আনার জন্য। আমরা সেরামের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা আমাদের আরও ১০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার কথা বলেছে।’ কবে নাগাদ ১০ লাখ ডোজের এ টিকা আসবে— জানতে চাইলে পাপন বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছি। কবে আসবে সেটা এখনই বলতে পারছি না। শিগগিরই আপনাদের জানানো হবে।’

‘ভ্যাকসিন ওয়্যারহাউজ থেকে সরকারের নিদের্শ অনুযায়ী ৬৪ জেলার সিভিল সার্জনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। এর মধ্যে সবধরনের কোল্ড চেইন মানা হবে’— বলেন পাপন।

২৭ জানুয়ারি পরীক্ষামূলক প্রথম টিকা দেওয়া হবে। তবে এর পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪শ থেকে ৫শ জনের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হবে। তাদের এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখার পর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সারাদেশে একযোগে টিকা দেওয়া হবে…

এর আগে ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে উদয়াচল পার্কের উদ্বোধন এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বনাম ভারতীয় হাই কমিশনের প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাপন বলেন, সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে তিন কোটি ডোজ টিকা পেতে আমাদের যে চুক্তি রয়েছে এটি পর্যায়ক্রমে নিয়ে আসা হবে। দুই-একদিনের মধ্যে প্রথম চালানের ৫০ লাখ ডোজ আসছে।

দামের বিষয়ে সেরাম যা বলছে

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার বরাত দিয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এর আগে জানায়, তাদের টিকার প্রতি ডোজের দাম পড়তে পারে ৩ থেকে ৪ ডলার। অক্সফোর্ডের টিকা অলাভজনকভাবে বাজারজাত করা হবে এবং একই সঙ্গে বিশ্বের সব প্রান্তে প্রয়োজন অনুযায়ী পৌঁছে দেওয়া হবে এ টিকা। সেরামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদর পুনাওয়ালা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, টিকার দুই ডোজের দাম পড়বে সর্বোচ্চ এক হাজার রুপি।

ভারতের উপহারের ২০ লাখ টিকা ঢাকায় পৌঁছায় ২১ জানুয়ারি | ছবি- ঢাকা পোস্ট 

কোন ভ্যাকসিনের দাম কেমন
 
মডার্না : বিশ্বব্যাপী যেসব কোম্পানি করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজ করছে তার মধ্যে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের বায়োটেকনোলজি কোম্পানি মডার্না। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করে, তাদের ভ্যাকসিন প্রায় ৯৫ শতাংশ (৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ) কার্যকর। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তারা প্রতি ডোজ করোনা টিকার দাম ২৫ থেকে ৩৭ ডলার করে রাখছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দুই হাজার ১৮৮ টাকা থেকে তিন হাজার ১৩৫ টাকা দাঁড়ায়।

ফাইজার-বায়োএনটেক : ফাইজার দাবি, তাদের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর। এ টিকায় উল্লেখযোগ্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। ফাইজার বলছে, তাদের এই টিকা করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্ষেত্রে ৯৪ শতাংশ কার্যকর। তাদের তৈরি টিকার প্রতি ডোজের দাম পড়ছে ২০ ডলার করে।

জনসন অ্যান্ড জনসন : মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসনের তৈরি টিকা স্বাভাবিক পদ্ধতিতে রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা যাবে। প্রতি ডোজের দাম পড়বে ১০ ডলার করে। 

স্পুতনিক ফাইভ : রাশিয়ার তৈরি স্পুতনিক ফাইভ টিকা ৯২ শতাংশ কার্যকর। তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সন্দিহান। স্পুতনিক ফাইভ টিকার অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে বলা হয়েছে, মার্কিন ওষুধ কোম্পানি ফাইজার ও মডার্নার চেয়ে রাশিয়ার করোনা টিকার প্রতি ডোজের দাম অনেক কম পড়বে।

সোমবার আসছে আরও ৫০ লাখ টিকা

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের ৫০ লাখ টিকা সোমবার (২৫ জানুয়ারি) বাংলাদেশে আসছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। রোববার (২৪ জানুয়ারি) সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘২০ লাখ ভ্যাকসিন আমরা পেয়েছি। আগামীকাল (সোমবার) আমাদের আরও ৫০ লাখ ভ্যাকসিন আসবে আশা করছি।’

৮ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের ৬৪ জেলাতেই প্রথম ধাপে পর্যায়ক্রমে টিকা দেওয়া হবে। তবে ঢাকা জেলার জন্য রাখা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ জেলায় বরাদ্দ রয়েছে ১২ লাখ ৫৪ হাজার ২০০ ডোজ। সবচেয়ে কম বরাদ্দ বান্দরবন জেলায়। জেলাটিতে ৪০ হাজার ৪৩৯ ডোজ টিকা দেওয়া হবে…

এ জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে জানিয়ে জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমাদের যে জাতীয় কমিটি আছে সে কমিটিও প্রস্তুতি মোটামুটি শেষ করেছে।’ ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় চালান আসবে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, ‘ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহীদের নিবন্ধনের জন্য তৈরি অ্যাপ সোমবার হস্তান্তর করবে আইসিটি বিভাগ। বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সেটির উদ্বোধন করা হবে।’

এছাড়া ভ্যাকসিনের প্রয়োগ নিয়ে যেন কোনো অনিয়ম না হয় সেজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করেছে বলেও জানান মন্ত্রী। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বেসরকারিভাবে ভ্যাকসিন আনার অনুমতি এখনও দেয়া হয়নি।‘’
কিট দিয়ে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলেও এ সময় জানান তিনি। জাহিদ মালেক বলেন, ‘অনেক দিনের দাবি ছিল অ্যান্টিবডি পরীক্ষার বিষয়টি। আমরা এখন থেকে অ্যান্টিবডি টেস্ট করার অনুমতি দিচ্ছি। এটা অনেকেরই দাবি ছিল।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য ৪২ হাজার কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এর মধ্যে টেকনোলজিস্ট, নার্স, মিডওয়াইফ, ভলান্টিয়ার রয়েছে। সবমিলিয়ে ৪২ হাজার জনকে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, যারা ভ্যাকসিন দেবে।’

ঢাকার ৫ হাসপাতালে টিকা দেওয়া হবে ২৮ জানুয়ারি

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশে প্রথম করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু হবে আগামী ২৭ জানুয়ারি (বুধবার)। একজন নার্সকে দিয়ে এদিন টিকা কার্যক্রম শুরু হলেও পরদিন ২৮ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) রাজধানী ঢাকার ৫টি হাসপাতালে টিকা দেওয়া হবে। রোববার (২৪ জানুয়ারি) টিকা নিয়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠক শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম এ তথ্য জানান।

তিনি জানান, ২৭ জানুয়ারি পরীক্ষামূলক প্রথম টিকা দেওয়া হবে। তবে এর পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪শ থেকে ৫শ জনের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হবে। তাদের এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখার পর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সারাদেশে একযোগে টিকা দেওয়া হবে।

সারাদেশে ৮ ফেব্রুয়ারি টিকা দেওয়া শুরু

২৭ জানুয়ারি ঢাকায় টিকা প্রয়োগ শুরু হলেও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে সারাদেশে একযোগে টিকাদান। সংক্রমণের হার ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় সারাদেশের কোন জেলায় কত সংখ্যক ভ্যাকসিন যাবে তা নির্দিষ্ট করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তারা জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে সারাদেশে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হবে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেছেন, ৫০ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়া হবে।

জানা গেছে, দেশের ৬৪ জেলাতেই প্রথম ধাপে পর্যায়ক্রমে টিকা দেওয়া হবে। তবে ঢাকা জেলার জন্য রাখা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ জেলায় বরাদ্দ রয়েছে ১২ লাখ ৫৪ হাজার ২০০ ডোজ। সবচেয়ে কম বরাদ্দ বান্দরবন জেলায়। জেলাটিতে ৪০ হাজার ৪৩৯ ডোজ টিকা দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যানে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে টিকা দেওয়া হবে ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪৫ জনকে। চট্টগ্রাম বিভাগে দেওয়া হবে ২৯ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৩ জনকে, রাজশাহী বিভাগে ১৯ লাখ ২৪ হাজার ৯২২ জনকে, রংপুর বিভাগে ১৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯ জনকে, খুলনা বিভাগে দেওয়া হবে ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬৪৬ জনকে, সিলেট বিভাগে দেওয়া হবে ১০ লাখ ৩২ হাজার জনকে এবং বরিশাল বিভাগে আট লাখ ৬৬ হাজার ৯৯৪ জনকে টিকা দেওয়া হবে। তিন রাউন্ডে এ জনগোষ্ঠী টিকা পাবেন।

টিআই/এমএআর