নদীতে ড্রেজিং

• দুই বছরের প্রকল্প শেষ হয়নি ১০ বছরেও
• অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৩০৯ কোটি টাকা
• ১০ বছরে আর্থিক অগ্রগতি ৫৩ শতাংশ
• রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়: জাহিদ হোসেন 

নদী ড্রেজিংয়ের জন্য মেশিন ক্রয়ে ২০১০ সালে হাতে নেয়া হয় একটি প্রকল্প। বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)। প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল মাত্র দুই বছর। কিন্তু ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি কাজ। উল্টো ১০ বছরে প্রকল্পটির সংশোধন আনা হয়েছে পাঁচবার। ক্রয় হয়েছে মাত্র চারটি ড্রেজিং মেশিন। এমন অবস্থায় প্রকল্পটি শেষ করতে চায় বাস্তবায়নকারী সংস্থা। পরিকল্পনা কমিশনে এ বিষয়ে প্রস্তাবও পাঠিয়েছে তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নাব্যতা রক্ষায় যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনাসহ দেশের সব নদ-নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার। এজন্য নিজস্ব ড্রেজার ক্রয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আরও শক্তিশালী করতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে ‘বাংলাদেশের নদী ড্রেজিংয়ের জন্য ড্রেজার ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয়’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১০ সাল থেকে দুই বছর মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় আনুষঙ্গিক জলযানসহ নয়টি ড্রেজার কেনার কথা ছিল বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের। মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল এক হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটি গত ১০ বছরে পাঁচবার মেয়াদ বাড়িয়ে সংশোধন করা হয়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৯৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। যা মোট ব্যয়ের ৫৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি অনুমোদনের পর ১০ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত কেনা হয়েছে মাত্র চারটি ড্রেজার। বর্তমানে কাজ অসমাপ্ত রেখেই প্রকল্প শেষ করতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।

প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পের আওতায় বেশকিছু যন্ত্রপাতি কেনা সম্ভব নয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি বরাদ্দও চাওয়া হয়েছে। এজন্য কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্প শেষ করতে বিশেষ সংশোধন জরুরি।’

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়নে কেন সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে— তা জানতে চাওয়া হবে। দেশের ১৮টি মাঝারি আকারের নদীতে স্বল্পমেয়াদী (পাঁচ বছর), মধ্যমেয়াদী (১০ বছর) এবং যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনাসহ সব বড় নদ-নদীগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী (১৫ বছর) ধরে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল সরকার। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে দেশে সমন্বিত নদীপ্রবাহ পুনরুদ্ধার এবং সচল রাখা সম্ভব হবে বলে মনে করা হয়েছিল। এজন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়। কিন্তু চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৬৯৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পের কাজ অসমাপ্ত রেখেই এটি শেষ করতে বিশেষ সংশোধন প্রয়োজন। প্রকল্পের আওতায় কেনা চারটি ২৬০ মিলিমিটার ড্রেজারের কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখতে জরুরিভিত্তিতে স্পেয়ার ও পাইপলাইন সংগ্রহ করতে হবে।’

‘এছাড়া ইতোপূর্বে সংগৃহীত ড্রেজারের বকেয়া ও পরিচালন ব্যয় পরিশোধ করা হয়নি, যা করতে হবে। অন্যদিকে, প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে ১০টি ২৫০ মিলিমিটার কাটার সাকশন ড্রেজার সংগ্রহ করা সম্ভব নয়’ বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, বিষয়টি দুঃখজনক। সময়ক্ষেপণ করে প্রকল্প কেন অসমাপ্ত রাখা হবে? এতে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।

প্রকল্পটির বিষয়ে রোববার (১৩ ডিসেম্বর) প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বাস্তবায়নকারী সংস্থার কাছে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণসহ ক্রয় করা সরঞ্জামাদির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এভাবে যেনতেনভাবে বহু প্রকল্প হাতে নিয়ে আর কাজ করা হচ্ছে না। এতে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় হচ্ছে। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর হওয়া দরকার।’

প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘প্রকল্পটির বিষয়ে আমাদের কাছে চিঠি আসবে। চিঠি পেলে প্রকল্পটি পরিদর্শনে যাব। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে সুপারিশ দেওয়া হবে।’

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য মো. জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘প্রকল্পটির ওপর আজ পিইসির সভায় ব্যাপকভাবে আলোচনা হয়েছে। ১০ বছরেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে না পারা দুঃখজনক। অনেক কারণও আছে। তবে বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে বাকি কাজগুলো সমাপ্ত করা সম্ভব হবে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সব কম্পোনেন্টের কাজ হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, দেশীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া। যদি মাল্টিন্যাশনাল কোনো কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হতো তাহলে প্রকল্পের কাজ অনেক আগেই সমাপ্ত হতো।’

এসআর/এফআর/এমএআর