ব্র্যাকেটবন্দী দলের কাহিনি- ২
সবচেয়ে বেশি ব্র্যাকেট জাতীয় পার্টিতে
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৩৯টি। এর মধ্যে ২৪টি দল ভেঙে ৩৯ টুকরা হয়ে ‘ব্র্যাকেটবন্দী’ হয়েছে। আর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই এমন দল আছে অন্তত শতাধিক। এসব দলের মধ্যে বেশ কয়েকটি আবার গঠনের পর একাধিকবার ভাঙনের মুখে পড়েছে। কেন ভাঙছে, কেন ব্র্যাকেটবন্দী হচ্ছে— এ নিয়ে ঢাকা পোস্টের বিশেষ আয়োজন ‘ব্র্যাকেটবন্দী দলের কাহিনি’। নিজস্ব প্রতিবেদক আদিত্য রিমনের অনুসন্ধানে চার পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি।
ব্র্যাকেটবন্দী জাপার অংশগুলো হলো- জাতীয় পার্টি (জাপা), চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের; নতুন জাপা, এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ ও সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক; জাতীয় পার্টি (জেপি), সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু; বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ; জাতীয় পার্টি, চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, সভাপতি ডা. এম এ মুকিত
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একই নামে সবচেয়ে বেশি ব্র্যাকেটবন্দী হয়েছে সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় পার্টি। বর্তমানে ‘জাতীয় পার্টি’ নামে ছয়টি দলের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে দুটি অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন এরশাদের ভাই ও স্ত্রীরা।
বিজ্ঞাপন
এরশাদের জীবদ্দশায় ‘জাতীয় পার্টি’ নামে পাঁচটি দল ছিল। মৃত্যুর পর (১৪ জুলাই, ২০১৯) তার সাবেক স্ত্রী বিদিশার ইচ্ছায় ‘নতুন জাপা’ নামের আরেকটি দল হয়। ব্র্যাকেটবন্দী জাপার অংশগুলো হলো- জাতীয় পার্টি (জাপা), চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের; নতুন জাপা, এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ ও সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক; জাতীয় পার্টি (জেপি), সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু; বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ; জাতীয় পার্টি, চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, সভাপতি ডা. এম এ মুকিত।
ব্র্যাকেটবন্দী জাতীয় পার্টির মূল অংশের নেতৃত্বে আছেন গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের)। বর্তমান সংসদে (একাদশ) এ অংশের ২৪ সদস্য প্রতিনিধিত্ব করছেন। সারাদেশে তাদের ৭৭টি সাংগঠনিক ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে ৫০টির মতো জেলার কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ।
জাপার এ অংশের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি সংসদে এখন দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। একই সঙ্গে বাইরে সরকারের জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। মহামারি করোনার মধ্যেও বিভিন্ন জেলার কমিটি গঠিত হয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে এলে মাঠপর্যায়ে সফরেরও পরিকল্পনা রয়েছে।’
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার মৃত্যুর পর ছোট ভাই ও দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে পদ-পদবি নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। দল ভাঙার উপক্রম হলেও শেষপর্যন্ত সমঝোতার মাধ্যমে রক্ষা পায়। কিন্তু এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকের প্ররোচনায় তার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলে এরিক এরশাদ ‘জাতীয় পার্টি’ নামে আরেকটি কমিটি ঘোষণা করেন। গত ১৪ জুলাই পিতার মৃত্যুবার্ষিকীতে এরিক ঘোষিত ‘নতুন জাপা’র কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় রওশন এরশাদকে। মা বিদিশা ও সৎ ভাই সাদ এরশাদকে করা হয় কো-চেয়ারম্যান। যদিও জি এম কাদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেন, এরিক এরশাদের ঘোষিত জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদ থাকবেন না বলে তাকে জানিয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত সরাসরি কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সাদ এরশাদও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এরিক এরশাদ ‘জাতীয় পার্টি’ নামে আরেকটি কমিটি ঘোষণা করেন। গত ১৪ জুলাই পিতার মৃত্যুবার্ষিকীতে এরিক ঘোষিত ‘নতুন জাপা’র কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় রওশন এরশাদকে। মা বিদিশা ও সৎ ভাই সাদ এরশাদকে করা হয় কো-চেয়ারম্যান
নতুন জাপার মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ম্যাডাম রওশন এরশাদ অসুস্থ থাকায় সারাদেশের সাংগঠনিক কার্যক্রম ধীরগতিতে চলছে। ঢাকা মহানগরের কমিটি গঠনেরও কাজ চলছে।’
নতুন জাপার কো-চেয়ারম্যান বিদিশা সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা কমিটির প্রস্তাব করেছি। সারাদেশে কাজ চলছে।’ কমিটিতে রওশন এরশাদ থাকবেন না— জি এম কাদেরের এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদিশা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বক্তব্য দেব। একটু অপেক্ষা করেন, সবকিছু জানতে পারবেন।’
এরশাদের জীবদ্দশায় বিভক্ত জাতীয় পার্টি
২০০১ সালে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে বেরিয়ে জাতীয় পার্টি (জেপি) নামে নতুন দল গঠন করেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। দলটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক। এ অংশের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পিরোজপুর- ২ আসনের সংসদ সদস্য।
২০২০ সালে জেপির সর্বশেষ সম্মেলন হয়। বর্তমানে দলটির ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি রয়েছে। এ অংশের দফতর সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের ৫১টি জেলায় আমাদের কার্যক্রম রয়েছে। তবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কতজন নারী সদস্য রয়েছেন, তা জানাতে পারেননি তিনি।
আরও পড়ুন: ব্র্যাকেটবন্দী দলগুলোতে ‘ব্র্যাকেট’ বাড়ছে
কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক। বিএনপির কর্মসূচির ওপর নির্ভর এ দলের কার্যক্রম। জোট ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। এর বাইরে দলটির নিজস্ব কার্যক্রম বলতে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো। নিয়মিত সম্মেলনও হয় না তাদের।
জাতীয় পার্টির এ অংশের চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, তিন/চার বছর আগে দলের সম্মেলন হয়েছে। জাতীয় কমিটি ৪০ সদস্যবিশিষ্ট। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হোসনে আরাসহ তিন/চারজন নারীনেত্রী রয়েছেন। কতটি জেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে— এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
১৯৯৯ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট মিলে গঠিত হয় ‘চারদলীয় ঐক্যজোট’। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও সাবেক মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে জোটে থেকে যায় জাতীয় পার্টির একটি অংশ। পরবর্তীতে এ অংশের নাম হয় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। পরে জোট সম্প্রসারিত হয়ে ‘২০ দলীয় জোটে’ রূপ নেয়। পিতার মৃত্যুতে জাপার এ অংশের চেয়ারম্যান হন আন্দালিব রহমান পার্থ।
একরোনার কারণে শুধু আমাদের নয়, কোনো দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। দেশের ১৫টির মতো জেলায় আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম আছে। নির্বাচিত একজন কাউন্সিলরও আছেন আমাদের
বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ
জোটের অধীনে নবম সংসদ নির্বাচনে ভোলা- ১ আসন থেকে নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু একাদশ সংসদে নির্বাচিত বিএনপির সদস্যদের শপথ নেওয়ার প্রতিবাদে ২০ দলীয় জোট ছাড়ে পার্থের বিজেপি। এরপর থেকে দলটির দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। মূলত দলটির কর্মকাণ্ড পার্থনির্ভর।
২০০৯ সালের পর পার্থের বিজেপির কোনো সম্মেলন হয়নি। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ভোলায় দলটির কিছুটা সাংগঠনিক কার্যক্রম রয়েছে। বর্তমানে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সাউদ মতিন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে শুধু আমাদের নয়, কোনো দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। দেশের ১৫টির মতো জেলায় আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম আছে। নির্বাচিত একজন কাউন্সিলরও আছেন আমাদের।
নির্বাচন কমিশনের ২৮ নম্বর নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক মন্ত্রী এম এ মতিন। প্রথমে বিএনপি এবং পরে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে অংশ নেন তিনি। একাধিকবার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন এম এ মতিন। ২০১২ সালে তার মৃত্যুর পর দলের চেয়ারম্যান হন ছেলে ডা. এম এ মুকিত। বর্তমানে দলটির ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে কিছু কার্যক্রম রয়েছে।
দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. এম এ মুকিত ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনাকালে এসব বিষয়ে বলার কী আছে? আমার কিছু বলার নেই।’
তৃতীয় পর্ব : আদর্শের কারণে ‘ব্র্যাকেটবন্দী’ বামদলগুলো
এএইচআর/এমএআর/