করোনা বিষাদে বিষাক্ত কোমল প্রাণ
রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় গেলে দেখা মেলে ছিন্নমূল শিশুদের। তাদের একটি অংশকে প্রায়ই ড্যান্ডির (জুতার পেস্টিংয়ের আঠা) নেশায় বুঁদ থাকতে দেখা যায়। এটা নতুন কিছু নয়! ক্ষুধার তীব্র তাড়না মেটাতে ড্যান্ডির মতো ভয়ঙ্কর নেশায় আসক্ত হচ্ছে পথশিশুরা। সম্প্রতি তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নতুন একটি দল। পোশাকে-আশাকে ছিন্নমূল না হলেও তারাও ‘ড্যান্ডি’ গ্রহণ করছে। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
সম্প্রতি কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে এমন এক শিশুর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। নাম মো. মামুন হোসেন (ছদ্ম নাম), বয়স ১২। পাঁচ/ছয় মাস আগে সে এ মরণনেশায় আসক্ত হয়েছে বলে জানায়। কেন এবং কীভাবে তার এ পথে আসা— জানতে চাইলে মামুন বলে, ২০২০ সালে রাজধানীর বসিলার একটি বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পাশের বাসার এক বড় আপুর কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করি। বাইরে বের হতে দিত না বাবা-মা। বাসার মধ্যেই খেলাধুলা আর পড়াশোনা চলছিল। ভালোই পার হচ্ছিল সময়গুলো।
বিজ্ঞাপন
হঠাৎ মামুনদের ছোট সংসারে নেমে আসে অঘোর অমাবস্যা। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে মহামারি করোনার প্রথম আঘাত আসে তাদের ঘরে। সরকার ঘোষিত ধারাবাহিক লকডাউনের কারণে বন্ধ হয়ে যায় মামুনের বাবার ব্যবসা। ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করতেন তিনি। যা আয় হতো তা দিয়ে ভালোই চলছিল। লকডাউনের কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ধার-দেনা করে চলছিল সংসার। তারপরও আশা ছিল, একসময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, লকডাউন উঠে যাবে। কিন্তু সেটি আর হলো না।
দেনার ভারে ন্যুব্জ মামুনের বাবার সংসার টিকিয়ে রাখাই যেন দায়! বন্ধ হয়ে যায় মামুনের প্রাইভেট পড়া। সংসার বাঁচাতে রিকশা নিয়ে বের হন বাবা। কিন্তু সেভাবে আয়-রোজগার হতো না। বাধ্য হয়ে মা অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন। মামুনের মনও আর ঘরে থাকতে চাইল না। বাবা-মাকে সাহায্য করতে বেরিয়ে পড়ে সেও
দেনার ভারে ন্যুব্জ মামুনের বাবার সংসার টিকিয়ে রাখাই যেন দায়! বন্ধ হয়ে যায় মামুনের প্রাইভেট পড়া। সংসার বাঁচাতে রিকশা নিয়ে বের হন বাবা। কিন্তু সেভাবে আয়-রোজগার হতো না। বাধ্য হয়ে মা অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন। মামুনের মনও আর ঘরে থাকতে চাইল না। বাবা-মাকে সাহায্য করতে বেরিয়ে পড়ে সেও।
মামুনের ভাষায়, ‘রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করা শুরু করি। দিনশেষে যে টাকা আয় হতো তা মায়ের হাতে তুলে দিতাম। বোতল কুড়াতে গিয়ে প্রায়ই আসা হতো কমলাপুর রেলস্টেশনে। একপর্যায়ে ড্যান্ডি খাওয়া গ্রুপের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের সঙ্গে মিশতে মিশতে ড্যান্ডি খাওয়া শুরু করি। এখন ভালোই লাগে।’
সে আরও জানায়, প্লাস্টিকের বোতল কুড়াতে কুড়াতে কোনো কোনো দিন ধানমন্ডি, মালিবাগ, শাহবাগে যাওয়া পড়ে। যখন খুব ক্ষুধা লাগে তখন ড্যান্ডি খায়। এতে ক্ষুধা কমে যায়। অন্যরকম একটা ফিলিংস কাজ করে।
স্কুলে থাকাবস্থায় কখনও এমন নেশাজাতীয় জিনিস গ্রহণ করেছ কি না— এমন প্রশ্ন রাখা হয় মামুনের কাছে। উত্তরে সে জানায়, এমন জিনিস আগে কখনও দেখেনি সে। তার মতো আর কেউ ড্যান্ডি গ্রহণ করে কি না— উত্তরে মামুন বলে, ‘শুধু আমি নই। আমার মতো আরও অনেকে আছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গ্রুপ আছে। মেয়েরাও আছে। ফিলিংসের জন্য তারা ড্যান্ডি খায়।’
এটা তো শরীরের জন্য খারাপ। তাহলে খাও (গ্রহণ) কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলে, সারাদিন ঘোরাঘুরি করা লাগে। কাছে টাকাও থাকে না। দুই বন্ধু মিলে মুচির (জুতা মেরামতকারী) কাছ থেকে ২০-৩০ টাকার ড্যান্ডি কিনি। তাতে ভালো চলে যায়। আর ভাত খাওয়া লাগে না।
স্কুল খুললে ফের পড়াশোনা শুরু করবে কি না— জানতে চাইলে মামুন বলে, ‘হুম..., স্কুল খুব মিস করি। বিশেষ করে বন্ধুদের। ফের পড়াশোনা করতে চাই। কিন্তু...,’ একটু ভেবে সে আবার বলে, বাবার ব্যবসাটা ভালো মতো শুরু হলে সব ছেড়ে দেব। অনেক দেনা হয়েছে বাবার। করোনা আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে।
ড্যান্ডি কী, কেন তা গ্রহণ করছে শিশুরা
ড্যান্ডি হলো একপ্রকার গ্লু গাম বা আঠা জাতীয় উদ্বায়ী পদার্থ বা সাধারণ তাপমাত্রায় সহজেই বাষ্পে বা ধূম্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন প্রকার রাবার ও চামড়া জাতীয় পদার্থ যেমন- জুতা, চাকার রাবার-টিউব প্রভৃতির মেরামতকল্পে সংযোজক হিসেবে এর বহুল ব্যবহার বিদ্যমান। এটি বাষ্প বা ধূম্রাকারে শ্বাসতন্ত্র হয়ে রক্তের মাধ্যমে মানব মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। প্রথমে এটি আনন্দের শিহরণ আর অনিয়ন্ত্রিত উন্মাদনা তৈরি করে, পরবর্তীতে তা দেহে আনে শিথিলতার ভাব। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যা ‘গ্লু স্নিফিং’ বা বাংলায় ‘গ্লু গাম শুকা’ নামেও এটি পরিচিত।
মামুন শুধু একা নয়, করোনা মহামারির ছোবলে শত শত মামুন তৈরি হয়েছে। যারা আজ বই-খাতা-কলম ফেলে সংসারের হাল ধরেছে!
পিপিআরসি ও বিআইজিডি’র গবেষণায় যা বলছে
গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (বিআইজিডি)-এর যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকপর্যায়ে যথাক্রমে ১৯ ও ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে। অথচ মহামারির আগে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪ ও ২১ শতাংশ।
ওই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, করোনার কারণে ৩৩ শতাংশ দরিদ্র শিক্ষার্থীর স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যাপক মানসিক চাপে আছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই স্কুলগামী ছেলেশিশুর ৮ এবং মেয়েশিশুর ৩ শতাংশ কোনো না কোনো উপার্জন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে।
সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে এপ্রিল থেকে বন্ধ থাকায় বিশ্বের প্রায় ১৬০ কোটি গরিব শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফিরে যেতে পারবে না, যা বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৯০ শতাংশ। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবার চালু হলেও অন্তত ৯৭ লাখ শিশুর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
করোনায় মানসিকভাবেও বিধ্বস্ত শিশুরা
২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনার প্রথম আঘাত আসে দেশে। এরপর থেকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যেতে থাকে। যা এখনও স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। করোনার শুরু থেকে দেশের সব সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিশুদের বিনোদনের অধিকাংশ মাধ্যম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গত প্রায় ১৭-১৮ মাস ধরে ঘরবন্দী জীবন-যাপন করছে শিশুরা। এতে একদিকে তারা যেমন মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তদের সুস্থ হয়ে বেড়ে ওঠা।
ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে আসক্ত হচ্ছে শিশুরা
করোনার শুরু থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরীক্ষাব্যবস্থা বন্ধ থাকায় শিশুদের পড়ার চাপ নেই বলেই চলে। অন্যদিকে, করোনার বিধি-নিষেধের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বাসা থেকে বের হতে না পারায় ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের প্রতি আসক্তি বেড়েছে শিশুদের। বিশেষ করে শহরের শিশুদের। এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে বেশ কয়েকজন অভিভাবকের কথা হয়। তারা জানান, পড়ার বইয়ের সঙ্গে শিশুদের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। পুরো সময় কাটছে টিভি দেখে অথবা স্মার্ট ডিভাইসে৷ দিন-রাতের রুটিনও বদলে গেছে তাদের। আচরণেও এসেছে পরিবর্তন। এমন পরিস্থিতিতে সন্তানকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা।
করোনার কারণে ৩৩ শতাংশ দরিদ্র শিক্ষার্থীর স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যাপক মানসিক চাপে আছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই স্কুলগামী ছেলেশিশুর ৮ এবং মেয়েশিশুর ৩ শতাংশ কোনো না কোনো উপার্জন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে
রাজধানীর রামপুরা এলাকার অভিভাবক খাদিজা খাতুন বলেন, আমার আট ও ১২ বছরের দুই সন্তান। করোনা শুরুর পর তাদের মোবাইলে গেম খেলার আসক্তি বেড়ে যায়। বাইরে যেতে পারছে না, স্কুলও বন্ধ; তাই আমরা খুব বেশি বাধা দিইনি। এখন দেখছি, এটা তাদের আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। দিন নেই, রাত নেই, মোবাইল ছাড়া তাদের এখন চলেই না। দুজনের চোখের নিচে কালো কালি পড়েছে। কী করব— ভেবে পাচ্ছি না।
করোনাকালে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব— এ বিষয়ে কথা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলমান সঙ্কট সবার জন্য প্রযোজ্য হলেও কমবয়সিদের মানসিক অবস্থা মাথায় রেখে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ, বিশেষ করে বাবা-মাকে এ সময় সন্তানের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতি জোর দিতে হবে। সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ, পারিবারিক কাজ বা কায়িক পরিশ্রমে অংশ নিলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর করোনার ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব।
ড্যান্ডির আসক্ত থেকে শিশুদের দূরে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, এমন নেশার ফলে শিশুরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। এর ঘ্রাণ শরীরের যেসব জায়গায় পৌঁছায়, সেসব জায়গার কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। কোষ নষ্ট হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের কাজে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। তাদের এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনসহ সবাইকে কাজ করতে হবে। শিশুরা কেন নেশায় আসক্ত হবে— বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও গভীর মনোযোগ দিতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার পেছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও খেলাধুলার অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে এসব ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঘরে বসে থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে অবসাদের সৃষ্টি হচ্ছে।
‘অবসাদ থেকে শিশুদের মধ্যে মাদক গ্রহণের বিষয়টি আসে। এক্ষেত্রে শিশুদের খেলাধুলাসহ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে এখন থেকেই সব অভিভাবক তথা আমাদের সবাইকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার মতো পরিবেশও তৈরি করতে হবে। সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
এমএসি/এমএআর