বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসির তদন্ত কমিটি

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে উত্থাপিত ১০৮টি অভিযোগের তদন্তে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। রোববার (১৭ জানুয়ারি) বিকেলে রংপুরে বেরোবি ক্যাম্পাস ও প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছে ইউজিসির তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। 

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তদন্ত কমিটির সদস্যরা অবস্থান করলেও দেখা মেলেনি উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর। তিনি এ দিন রংপুরে উপস্থিত থেকেও তদন্ত কমিটিকে দেখা দেননি। 

তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া, সদস্য ড. ফেরদৌস জামান ও দুর্গা রাণী দাস বিকেলে বেরোবি ক্যাম্পাসে আসেন। সেখানে তারা প্রথমে অভিযোগ ওঠা ড. এম এ ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, শেখ হাসিনা হল ও স্বাধীনতা স্মারক প্রকল্প পরিদর্শন করেন। এ সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী তার সার্বক্ষণিক উপস্থিতির বিষয়টি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেমন চান, তেমনি ইউজিসিও চায়। আমরা তদন্তে যা পেয়েছি, দেখছি এবং শুনেছি তা আমাদের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরবো

তদন্ত কমিটির প্রধান আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া

পরিদর্শনকালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট)  সাবেক উপচার্য ও তদন্ত কমিটির প্রধান আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, প্রকল্পগুলোর ডিপিতে যেভাবে উল্লেখ ছিল, কার্যাদেশ দেয়ার পর তার ব্যত্যয় ঘটেছে বলে বিভিন্নভাবে জানতে পেরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসিকে সরেজমিনে দেখতে বলেছে। আমরা দেখলাম কী হওয়ার কথা ছিল আর কী ঘটেছে। আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরবো।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ

বেগম রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা দেখে হতাশা প্রকাশ করে একে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন কমিটির সদস্য ড. ফেরদৌস জামান।

তিনি উপাচার্যের অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে বলেন, নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী তার (কলিমুল্লাহ) সার্বক্ষণিক উপস্থিতির বিষয়টি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেমন চান, তেমনি ইউজিসিও চায়। আমরা তদন্তে যা পেয়েছি, দেখছি এবং শুনেছি তা আমাদের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরবো।

এক বছরের বেশি সময় পর গত ১৬ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে এসেছিলেন উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। কিন্তু কাউকে দেখা না দিয়ে গোপনে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান বলে অভিযোগ উঠেছে

এদিকে ইউজিসির তদন্ত কমিটি আসলেও উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ রোববার ক্যাম্পাসে আসেননি। তার সঙ্গে কথা না বলেই তদন্ত কমিটি সন্ধ্যা ৬টার দিকে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন অধিকার সুরক্ষা পরিষদের নেতারা উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা ১০৮টি অভিযোগ এবং এর প্রমাণে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তদন্ত কমিটির কাছে হস্তান্তর করে। এদিন তারা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে ক্যাম্পাসে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করেন। 

এ ব্যাপারে অধিকার সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ড. মতিউর রহমান বলেন, উপাচার্য রংপুরে অবস্থান করছেন এটা আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আমাদের একজন সদস্যের সঙ্গে তার দেখাও হয়েছে। তিনি তার বাংলোয় দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি ক্যাম্পাসে আসেননি। এমনকি ইউজিসির তদন্ত কমিটির সঙ্গেও দেখা করেননি।

তিনি আরও বলেন, অভিযোগের ব্যাপারে আমরাও তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলেছি। উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা ১০৮টি অভিযোগ ও এর প্রমাণ তাদের কাছে হস্তান্তর করেছি। সাধারণ শিক্ষার্থী, কর্মচারী ও কর্মকর্তারাও তাদের অভিমত তদন্ত কমিটির কাছে তুলে ধরেছে। এছাড়া আমরা নিজেরাই আগামী সপ্তাহের মধ্যে উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের সব ফিরিস্তি শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করবো।

উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা ১০৮টি অভিযোগ ও এর প্রমাণ তদন্ত কমিটির কাছে হস্তান্তর করেছি। সাধারণ শিক্ষার্থী, কর্মচারী ও কর্মকর্তারাও তাদের অভিমত কমিটির কাছে তুলে ধরেছে। এছাড়া আমরা আগামী সপ্তাহের মধ্যে উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের সব ফিরিস্তি শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করবো

অধিকার সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ড. মতিউর রহমান

এদিকে এক বছরের বেশি সময় পর গত ১৬ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে এসেছিলেন উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। কিন্তু কাউকে দেখা না দিয়ে গোপনে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান উপাচার্য।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

সেদিনও তার আগমনের খবর পেয়ে ক্যাম্পাসে সুরক্ষা অধিকার পরিষদ অবস্থান নিয়ে তিন ঘণ্টা ধরে তার বাংলো, দপ্তরেও তাকে খুঁজে পায়নি। আন্দোলনকারী শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবস্থানের কথা জানতে পেরে গোপনে উপাচার্য সেদিন তার ভবনের পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে ঢাকায় চলে যান।

আন্দোলনকারীরা জানান, দীর্ঘ টানা এক বছর ক্যাম্পাসে আসেন না উপাচার্য। হঠাৎ করে শুক্রবার (১৬ জানুয়ারি) সকাল ৯টার দিকে গোপনে ক্যাম্পাসে তার বাংলোর পেছনের মূল পথ দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় তার বাংলোর সামনে অবস্থান নেন সুরক্ষা অধিকার পরিষদের নেতারা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য তারা সাক্ষাৎ চেয়ে খবর পাঠান। কিন্তু তাদের ডাকে সাড়া দেননি উপাচার্য। দেখা করতে সম্মতি না দেওয়ায় আন্দোলনকারীরা তার বাংলো ঘেরাও করেন।

উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন না। ১৩০০ দিনের মধ্যে ১১০০ দিনই তিনি অনুপস্থিত। শুক্রবার হঠাৎ তার আগমনের খবর পেয়ে আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে তার বাসভবনে গিয়েছিলাম। তবে কখন যে তিনি চলে গেলেন তা কেউ টেরও পেলাম না

শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ড. তুহিন ওয়াদুদ

সকাল ৯টা থেকেই তারা অবস্থান গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি সাক্ষাতে সম্মতি না দেওয়ায় বেলা ১১টা থেকে তাকে তার বাংলোয় অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা। জুমার নামাজের সময় আন্দোলনকারীদের বেশিরভাগ নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে গেলে সুযোগ বুঝে দুপুর ২টার কিছু পরে বাংলোর পেছনের ছোট দরজা দিয়ে উপাচার্য বেরিয়ে যান। উপাচার্যের পালিয়ে যাবার ঘটনা জানার পর আন্দোলনকারীরা আবার বাংলোর সামনে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ করেন। পরে তার বাসভবনে গিয়ে তল্লাশি করেন অনেকেই। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। 
     
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, উপাচার্য কলিমুল্লাহ দিনের পর দিন ক্যাম্পাসে আসেন না। এমনকি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস স্বাধীনতা দিবস, রোকেয়া দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারিতেও না। তার দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ধ্বংস হয়ে গেছে। তার ওপর দুর্নীতি-লুটপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেই চলেছেন উপাচার্য ও তার সহযোগীরা। 

আন্দোলনকারীদের একজন বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান। তিনি আন্দোলনকারীরা উপাচার্যকে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি উল্লেখ করে বলেন, উনি এমন কি ক্ষমতাধর হয়েছেন যে তার কর্মস্থলে আসবেন না। তারপরেও এই পদে তিনি কীভাবে থাকেন? বিষয়টি সরকারের নীতি নির্ধারকদের দেখা উচিত। যদি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে ধরে নিতে হবে এখন দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি আমাদের উপাচার্য।  

শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন না। ১৩০০ দিনের মধ্যে ১১০০ দিনই তিনি অনুপস্থিত। শুক্রবার হঠাৎ তার আগমনের খবর পেয়ে আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে তার বাসভবনে গিয়েছিলাম। তবে কখন যে তিনি চলে গেলেন তা কেউ টেরও পেলাম না। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এভাবে তার কর্মস্থলে না আসলে বিশ্ববিদ্যালয়টা চলে কীভাবে, প্রশ্ন রাখেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে উপাচার্য প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। 

আরএআর