রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে কেনাকাটা ও অবকাঠামো নির্মাণে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তদন্তে নেমে এর সত্যতাও পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি। গত পাঁচ বছরে কয়েক কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ)।

গত পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সদস্য, অধ্যক্ষ ও শিক্ষক-কর্মচারীরা সম্মানী হিসেবে নিয়েছেন ২১ কোটি ৮৭ লাখ ৩৮ হাজার ২৩২ টাকা। যা রীতিমতো বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে দুদিন ডিআইএ’র শিক্ষা পরিদর্শক মোহাম্মদ মনকিউল হাসনাত, সহ-শিক্ষা পরিদর্শক সোহেল আহমেদ ও রাকিবুল হাসান, অডিট অফিসার সুলতান আহম্মদ তদন্ত করেন। তদন্তকালে ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব সংক্রান্ত কোনো রেকর্ড দাখিল করা হয়নি। যে কারণে তারা ওই অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব যাচাই করতে পারেননি।

২০১৫-১৬ থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সদস্য, অধ্যক্ষসহ সব শিক্ষক-কর্মচারী মোট ২১ কোটি ৮৭ লাখ ৩৮ হাজার ২৩২ টাকা সম্মানী হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু এ টাকার উৎসে কর পরিশোধ করা হয়নি। যা সরকারি রাজস্ব ফাঁকি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দরপত্র অনুযায়ী ঠিকাদার আসবাবপত্র সরবরাহ না করলেও তাদের বিল দেওয়া হয়েছে। আবার দরপত্র ছাড়াই কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারকে। সে কাজের বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষিত নেই প্রতিষ্ঠানটিতে। 

এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটি, শিক্ষক-কর্মচারীরা মিলেমিশে সম্মানীর নামে গত পাঁচ বছরে ২১ কোটির বেশি টাকা তুলে নিলেও উৎসে কর জমা দেননি। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন স্থাপনাবাবদ আদায় করা ভাড়ার টাকা থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার রাজস্ব জমা দেওয়া হয়নি।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

শিক্ষকদের পুরস্কার দেওয়ার নামে ‘পুকুর চুরির’ ঘটনাও ঘটেছে। নিয়ম অনুযায়ী বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন না করে অধ্যক্ষ নিজেই ইচ্ছামতো প্রতিষ্ঠানের টাকা খরচ করেছেন। ডিআইএ’র তদন্ত প্রতিবেদনে অবৈধভাবে খরচ করা অর্থ ও ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা টিউশন ফিসহ নানা বিষয় উঠে আসেনি তদন্ত প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় হিসাব সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র যাচাই করে বিভিন্ন খাতে খরচ করা অর্থ থেকে ভ্যাট আদায় করা হয়নি। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত ভ্যাট বাবদ সরকারি কোষাগারে জমাযোগ্য টাকার পরিমাণ এক কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৬২ টাকা। এর মধ্যে এক কোটি ৭১ হাজার ৬১৫ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩৯ লাখ ২২ হাজার ৫৪৭ টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে চালানের কপি মন্ত্রণালয়ে দাখিল করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত ভ্যাট বাবদ সরকারি কোষাগারে জমাযোগ্য টাকার পরিমাণ এক কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৬২ টাকা। এর মধ্যে এক কোটি ৭১ হাজার ৬১৫ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩৯ লাখ ২২ হাজার ৫৪৭ টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে চালানের কপি মন্ত্রণালয়ে দাখিল করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি

২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সদস্য, অধ্যক্ষসহ সকল শিক্ষক-কর্মচারী মোট ২১ কোটি ৮৭ লাখ ৩৮ হাজার ২৩২ টাকা সম্মানী হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু এ টাকার উৎস কর পরিশোধ করা হয়নি। যা সরকারি রাজস্ব ফাঁকি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। উৎস কর আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ফৌজিয়া

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আদায় করা ভাড়ার টাকা হতে রাজস্ব ভ্যাট কর্তন করে সরকারি তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত ৪৫ লাখ ২৮ হাজার ৩১৮ টাকা রাজস্ব ভ্যাট আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিষ্ঠানের জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আদায় করা ভাড়ার টাকা হতে রাজস্ব ভ্যাট কর্তন করে সরকারি তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত ৪৫ লাখ ২৮ হাজার ৩১৮ টাকা রাজস্ব ভ্যাট আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে

বসুন্ধরা শাখার ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার নির্মাণকাজে এক কোটি ৫৯ লাখ ১১ হাজার ৩৬৯ টাকা অনিয়মিত খরচ করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ভবন নির্মাণ, স্যানিটারি ও বৈদ্যুতিক কাজে এ টাকা খরচ করা হয়েছে। বার্ষিক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত না করেই এ কাজ করা হয়েছে। টেন্ডারের কোনো কাগজপত্র নেই। সিডিউল ও ঠিকাদারের দাখিল করা দরের কোনো কাগজপত্র নেই। ঠিকাদার দুই দফা রানিং ও চূড়ান্ত বিল তুলে নিলেও তাদের নিজস্ব প্যাডে জমা দেওয়া বিল নেই। এক কোটি ৫৯ লাখ ১১ হাজার ৩৬৯ টাকার কাজের মধ্যে সিডিউল ছাড়া খরচ করা হয়েছে এক লাখ ৮৭ হাজার ৭৪৯ টাকা। কাজের বিস্তারিত তথ্যযুক্ত বিল ও পরিমাপ বই (এমবি) না থাকায় বাস্তবে কতটুকু কাজ হয়েছে তা অস্পষ্ট। সঠিকভাবে কাজ করা হয়েছে কি না, তার সনদ নেই। ভবন নির্মাণে বুয়েট কর্তৃক রড ও সিমেন্টের গুণগত মানের পরীক্ষার রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়নি।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার

প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র ক্রয়ের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরপত্র অনুযায়ী আসবাবপত্র বুঝে না পেয়েও জুটো ফাইবার গ্লাস নামক প্রতিষ্ঠানকে তিন লাখ ৬৬ হাজার টাকা বাড়তি পরিশোধ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ১ জুন ও ১৯ জুন দাখিল করা দুই দফা চালানের মাধ্যমে মোট ১৩০ জোড়া হাইবেঞ্চ সরবরাহ করে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে প্রতিষ্ঠানটি একই বছরের ১৯ জুন লিখিতভাবে জানিয়েছে তারা ১২০টি জোড়বেঞ্চ সরবরাহ করেছে। স্কুলে জমা দেওয়া বিল-ভাউচার ও ঠিকাদারের তথ্যে গড়মিল রয়েছে। প্রতিষ্ঠানে জমা দেওয়া বিল-ভাউচার অনুযায়ী ১৩০টি জোড় বেঞ্চ সরবরাহ করা হলেও ৬০টি না দিয়েই ঠিকাদারকে বাড়তি তিন লাখ ৬৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বিধায় সমুদয় টাকা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। আসবাবপত্র ক্রয়বাবদ ১২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা অনিয়মিত খরচ করা হয়েছে। এ টাকাও আদায়ের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

এক কোটি ৫৯ লাখ ১১ হাজার ৩৬৯ টাকার কাজের মধ্যে সিডিউল ছাড়া খরচ করা হয়েছে এক লাখ ৮৭ হাজার ৭৪৯ টাকা। কাজের বিস্তারিত তথ্যযুক্ত বিল ও পরিমাপ বই (এমবি) না থাকায় বাস্তবে কতটুকু কাজ হয়েছে তা অস্পষ্ট

বেইলি রোডের স্কুল শাখার সীমানা প্রাচীর সংস্কার, মেরামত ও রঙের কাজে মেসার্স আদিবা কনস্ট্রাকশনকে চার লাখ ৬৫ হাজার ৬৭৮ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। টেন্ডার ছাড়াই ঠিকাদার দুই হাজার বর্গমিটার বাড়তি কাজের জন্য বিল দাবি করেন। ঠিকাদারের চাহিদা সংশোধন করে টেন্ডার ছাড়া এক লাখ ৭১ হাজার ৭২৭ টাকা পরিশোধ করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ টাকা পরিশোধ করা হলেও ঠিকাদারের বিল-ভাউচার স্কুলে পায়নি তদন্ত দল। এ কাজে প্রতি বর্গমিটার ৩০ টাকা দরে সিডিউল দাখিল করেন ঠিকাদার। কিন্তু বিল দেওয়া হয়েছে ২২৮ টাকা দরে। অতিরিক্ত বিলবাবদ অর্থ আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

২০১৯ সালে বার্ষিক খেলার সামগ্রী বহু দোকান থেকে কেনার ভাউচার জমা দেওয়া হলেও একটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে বিল দেওয়া হয়েছে। আদৌ খেলার সামগ্রী ক্রয় করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন

খেলার সামগ্রী কিনতে দুই লাখ ৫৬ হাজার ৩২৬ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে এক লাখ পাঁচ হাজার ৮৩০ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষকদের পুরস্কার বিতরণের নামে ৩২ হাজার ৯০০ টাকা অপচয় করা হয়েছে— মন্তব্য তদন্ত কমিটির।

২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন করেনি। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের ওপর ভিত্তি করে বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন করা হয় না, বলছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

তদন্তকালীন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন প্রফেসর ফৌজিয়া। তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি সাত মাস আগে চলে এসেছি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, ডিআইএসহ বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে। তদন্ত চলাকালীন আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। তবে আমার সময়ে বসুন্ধরা শাখায় ভবন নির্মাণের কোনো কাজ হয়নি।’

প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অধ্যক্ষ কামরুন নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার কাছে যা যা তথ্য চাওয়া হয়েছে সবই তাদের (তদন্ত দল) দিয়েছি।’ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বাজেট কেন প্রণয়ন করা হয় না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্থায়ী হিসাবরক্ষক নেই। একজন মাস্টার রোলে কাজ করেন। তিনি দুই দফা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যে কারণে বাজেট তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে বাজেট তৈরির কাজ চলছে।’

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

জানতে চাইলে ডিআইএ’র পরিচালক প্রফেসর অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর বলেন, ‘আমাদের অডিট টিম ক্রয়ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম পেয়েছে। রাজস্ব ফাঁকির অঙ্কও অনেক বড়। খাতভিত্তিক অর্থ আদায়সহ রাজস্ব জমা দেওয়ার সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’

শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্রীদের টিউশন ফিসহ অন্যান্য খাতের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিষয়ে অনেক তদন্ত হয়েছে। এবার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমার শুধু আর্থিক বিষয়ে অডিট করেছি। কর্তৃপক্ষ আর্থিক খাতের আয়-ব্যয়ের ওপর অডিট করেছে। করোনার কারণে ছাত্রীদের না পাওয়ায় অন্যান্য বিষয়ে অডিট করা সম্ভব হয়নি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন গত বুধবার (২৫ আগস্ট) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভিকারুননিসার তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। তা এখন যাচাই-বাছাই করছি। যেসব জায়গায় আর্থিক অনিয়ম হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এনএম/এমএআর/