জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চলবে কি?
পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন নয়, এটি এখন বাস্তব ও দৃশ্যমান। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটি দেশের সবচেয়ে বড় সেতু হিসেবে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতলবিশিষ্ট সেতুর অবকাঠামোর ওপর দিয়ে চলবে সড়কযান, নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। আগামী বছরের (২০২২ সাল) জুনের মধ্যে সবধরনের যান চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে— সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এমন আশ্বাস দেওয়া হলেও আসলে এটি সম্ভব কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতুর ওপর রেলপথ তৈরির নির্দিষ্ট অংশে এখন চলছে গ্যাসলাইন স্থাপনের কাজ। পুরো রেলপথ বসাতে লাগবে অন্তত ছয় মাস। ইতোমধ্যে সেতুতে কংক্রিটের সর্বশেষ স্ল্যাব বসানোর মাধ্যমে সড়কপথ দিয়ে যুক্ত হয়েছে পদ্মার দুই পাড়। এখন বাকি পিচঢালাইয়ের কাজ। আগামী মার্চের মধ্যে সেতুর সড়কপথের সব কাজ শেষ করা সম্ভব বলে আশা করছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
এদিকে, পদ্মা সেতুর রেলপথের সব স্ল্যাব বসানো শেষ হয়েছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সেতুকে দুই হাজার ৯৫৯টি কংক্রিট স্ল্যাবের মাধ্যমে জোড়া দেওয়া হয়েছে। তবে মূল সেতু থেকে মাটি পর্যন্ত (ঢালু উড়ালপথ) পথের কাজ শেষ হয়নি। আগামী ডিসেম্বরে তা শেষ হওয়ার কথা আছে। এরপর রেললাইন বসানো হবে— বলছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
আগামী বছরের জুনের মধ্যে সবধরনের যান চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে— সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এমন আশ্বাস দেওয়া হলেও আসলে এটি সম্ভব কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়! কারণ সড়কপথ চালু করা গেলেও রেলপথ এ সময়ের মধ্যে বসানো সম্ভব হচ্ছে না— বলছেন সংশ্লিষ্টরা
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে যে, আগামী জুনের মধ্যে পদ্মা সেতুর সড়কপথের সঙ্গে সঙ্গে রেলপথে মাওয়া থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার অংশ চালু করা হবে। ওই সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতু দিয়ে একই সঙ্গে সড়কযান ও ট্রেন চলাচল সম্ভব কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি বাস্তবায়ন করতে হলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সেতুর রেলপথের অংশ রেল মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছে, ডিসেম্বর নয়, আগামী মার্চের মধ্যেও সেতুর রেলপথের অংশ রেলপথ মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দিতে পারবে না সেতু কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় আগামী জুনে সড়কপথে পরিবহন চলাচল শুরু হলেও কাঙ্ক্ষিত ট্রেন চলাচল নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে!
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলছে পদ্মার রেল সংযোগ প্রকল্প। প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে জানান, পদ্মা সেতুতে রেলপথ বসাতে ছয় মাসের মতো সময়ের প্রয়োজন। এজন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে সেতু কর্তৃপক্ষকে ডিসেম্বরের মধ্যে সেতুর রেলপথ অংশ হস্তান্তরের তাগাদা দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু পদ্মা সেতুর রেলপথের নির্দিষ্ট এলাকায় বর্তমানে গ্যাসলাইনসহ অন্যান্য কাজ চলছে। এ কারণে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সেতু কর্তৃপক্ষ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে রেলপথের অংশ হস্তান্তর করতে পারবে না জানান সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেন বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতুর রেলপথের অংশ বুঝে নিতে চাই। পুরো অংশ না পেলেও কিছু অংশ বুঝিয়ে দিলে রেলপথ স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে যে, আগামী মার্চে তারা বিষয়টি বুঝিয়ে দেবেন। এ অবস্থায় আমরা সংশয়ের মধ্যে আছি, আগামী জুনের মধ্যে এটি চালু করা যাবে কি না!
এ বিষয়ে আমরা আগামী মাসে (সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসব— জানান পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক।
পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় মাওয়া থেকে রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭০০ মিটার রেলপথ স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা অংশে রেলপথ বসানোর প্রস্তুতি চলছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ দুই প্রান্ত থেকে রেলপথ স্থাপন ও আনুষঙ্গিক কাজ দ্রুত শেষ হয়ে যাবে— বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সেতুর রেলপথের অংশ রেলপথ মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব কি না— জানতে চাইলে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেতুর রেলপথ অংশে এখন গ্যাসলাইন স্থাপনের কাজ চলছে। আগামী জুন পর্যন্ত এটি চলবে। ফলে ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো, আগামী মার্চে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে পদ্মা সেতুর রেলপথের অংশ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এ অবস্থায় রেলপথ স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্টরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী ছয় মাস সময় পাচ্ছেন না। ফলে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে একই সঙ্গে সড়কযান ও ট্রেন চলাচলের বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, যদি মার্চ মাসে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাহলে নির্দিষ্ট সময়ে (জুনের মধ্যে) সেতুর ওপর রেলপথ স্থাপনের কাজ শেষ করতে পারব কি না, তা নিয়ে সত্যিই সংশয়ের মধ্যে আছি।
তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের একটি পক্ষের দাবি, নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী অর্থাৎ আগামী জুনের মধ্যে পদ্মা সেতুর সড়ক ও রেলপথ দিয়ে একই সঙ্গে পরিবহন ও ট্রেন চলাচল সম্ভব। আগামী ডিসেম্বর থেকে সেতুর রেলপথের অংশ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরের পরও সেখানে গ্যাসলাইন বসানোসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা যায়। এজন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কাজের সমন্বয় প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের একটি পক্ষের দাবি, নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী অর্থাৎ আগামী জুনের মধ্যে পদ্মা সেতুর সড়ক ও রেলপথ দিয়ে একই সঙ্গে পরিবহন ও ট্রেন চলাচল সম্ভব। আগামী ডিসেম্বর থেকে সেতুর রেলপথের অংশ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরের পরও সেখানে গ্যাসলাইন বসানোসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা যায়। এজন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কাজের সমন্বয় প্রয়োজন
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাই পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৭.২৫ শতাংশ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রসঙ্গে এর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) মো. আব্দুল কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেতুতে গ্যাসলাইনের কাজ শেষ করার পর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে সংশ্লিষ্ট অংশ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। আগামী জুনে পদ্মা সেতু দিয়ে যাতে সবধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারে, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। গত ২৩ আগস্ট সেতুর সড়কপথের সবগুলো স্ল্যাব বসানো হয়েছে। অক্টোবর থেকে সড়কপথের পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু হবে। মার্চের মধ্যে তা শেষ করা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প এটি। প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে। পুরো প্রকল্পের কাজ তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ঢাকা থেকে মাওয়া, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ। এর মধ্যে সেতু উদ্বোধনের দিন মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালুর অগ্রাধিকার ঠিক করেছে রেলওয়ে। ভাঙ্গা-যশোর অংশের অগ্রগতি ৩১ শতাংশ। এখন পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৪৩ শতাংশ। প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি)।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) ২০১৮ সালের ২২ মে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে চীন। বাকি অর্থ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হচ্ছে।
২০২৪ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা, নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ হবে এ প্রকল্পের আওতায়। থাকবে মোট ১৭টি রেলস্টেশন। এর মধ্যে ১৪টি রেলস্টেশন নতুন করে নির্মাণ করতে হবে।
পদ্মা সেতুর ৪১তম স্প্যান বসানো হয় গত বছরের ১০ ডিসেম্বর। এর ফলে যুক্ত হয় প্রমত্তা পদ্মার দুই পাড়। ২০২২ সালের শুরুতেই সেতু দিয়ে যান চলাচলের কথা ছিল। এখন বলা হচ্ছে, আগামী জুন নাগাদ সেতু দিয়ে যান চলাচল সম্ভব হবে।
পিএসডি/এমএআর/