‘অনুসন্ধানেই’ কি আটকে যাচ্ছে দুদকের কার্যক্রম
ক্যাসিনোকাণ্ড : তালিকার ৯০ শতাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে
২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে সারা দেশে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘শুদ্ধি’ অভিযান। পাশাপাশি ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী এবং বিদেশে অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত এমন প্রায় ২০০ রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সংস্থাটির এমন উদ্যোগ সর্বমহলে বেশ সমাদৃত হলেও কোনো এক অজানা কারণে শেষ পর্যন্ত এসব উদ্যোগ অনেকটাই যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২ বছরেও অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুরাহা হয়নি।
‘অনুসন্ধানে’ নেমেই যেন গতি হারাচ্ছে দুদক! ‘অভিযুক্তের’ তালিকায় নাম আসা প্রায় ৯০ ভাগের বিরুদ্ধে এখনো কার্যকর কোনা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূলে শপথ নেওয়া সংস্থাটি। কেন এই ব্যর্থতা? বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরাধী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে দুদকের সক্ষমতা ও কারিগরি দক্ষতার ঘাটতি এবং সদিচ্ছা ও সৎ সাহসের অভাব আছে। এছাড়া অপরাধীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলয়ে থাকাটাও একটা বাধা; তাদের ‘ধরতে গেলে হাত পুড়ে যাবে’— এমন ভয় আছে। তারপরও কিছু বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে দুদক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিজ্ঞাপন
ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীসহ মোট ২০০ জনের তালিকা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক পর্যায়ে দুই সংসদ সদস্য, যুবলীগের শীর্ষনেতা ও গণপূর্তের চার প্রকৌশলীসহ ৪৩ জনের তালিকা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা ২০০-তে দাঁড়ায়
দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় আছেন যারা
ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীসহ মোট ২০০ জনের তালিকা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী এবং সেই অর্থ বিদেশে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে সংস্থাটি।
প্রাথমিক পর্যায়ে দুই সংসদ সদস্য, যুবলীগের শীর্ষনেতা ও গণপূর্তের চার প্রকৌশলীসহ ৪৩ জনের তালিকা নিয়ে শুরু হয় দুদকের অনুসন্ধান। ধীরে ধীরে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। সর্বশেষ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এস এম শিবলী নোমানসহ ১৬ জনের একটি তালিকা সেখানে যুক্ত হয়। ফলে অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সংখ্যা ২০০ পার হয়ে যায়।
অভিযুক্তের তালিকায় নাম আসে প্রভাবশালী পাঁচ সংসদ সদস্যের। তারা হলেন, সুনামগঞ্জ– ১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ভোলা-৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সামশুল হক চৌধুরী, বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ এবং নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের নজরুল ইসলাম বাবু।
অভিযুক্তের তালিকায় আছেন প্রভাবশালী পাঁচ সংসদ সদস্য। তারা হলেন- মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সামশুল হক চৌধুরী, পঙ্কজ দেবনাথ ও নজরুল ইসলাম বাবু। এছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ বেশ কয়েকজন সাবেক নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, গণপূর্ত অধিদফতরের প্রকৌশলী, ঠিকাদার, কাস্টম ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে এ তালিকায়
এছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ বেশ কয়েকজন সাবেক নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, গণপূর্ত অধিদফতরের প্রকৌশলী, ঠিকাদার, কাস্টম ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে এ তালিকায়।
তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক্যাসিনো ব্যবসাসহ অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা, সরকারি কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালীদের ঘুষ দিয়ে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, পরে তা বিদেশে পাচার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে অনুসন্ধানে নামার পর প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও ওই তালিকার ৯০ ভাগের বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা বা চার্জশিটের মতো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেনি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন অনেকে। উল্টো দুদকের এক অফিস আদেশে গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীসহ শীর্ষ পদে থাকা ১৩ জনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি (দায়মুক্তি) দেওয়া হয়েছে!
বসে নেই দুদক, সফলতাও আছে
যদিও দুদক থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত ক্যাসিনোকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও জি কে শামীমসহ শীর্ষ ২৪ জনের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা দায়ের করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ১২ মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ২৪ আসামির প্রায় ৫৮২ কোটি টাকার সম্পদও জব্দ করেছে দুদক। তবে, তালিকায় থাকা প্রভাবশালী পাঁচ সংসদ সদস্যের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি কমিশন।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে অনুসন্ধানে নামার পর প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও ওই তালিকার ৯০ ভাগের বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা বা চার্জশিটের মতো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেনি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন অনেকে
সার্বিক বিষয়ে জানতে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ক্যাসিনোকাণ্ডে ইতোমধ্যে ২৩টির মতো মামলা হয়েছে। ১০টির বেশি মামলার চার্জশিট দাখিল হয়েছে। এসব মামলায় সম্পৃক্তদের অবৈধ সম্পদও জব্দ হয়েছে। বেশকিছু আসামি গ্রেফতার হয়েছে। কাউকে কাউকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে আইনের নিখুঁত প্রয়োগ চলছে।
‘আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন, কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। তবে, নিরপরাধ কাউকে জোর করে যেন আসামি করা না হয়, সেদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। পাশাপাশি কোনো অপরাধী যাতে ছাড় না পায়, সে বিষয়েও আমরা সচেষ্ট। অপরাধ ও অপরাধী শনাক্তে আমরা শতভাগ নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন করছি। রাগ-অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না, করবও না।
১৩ প্রকৌশলীকে অব্যাহতি
‘শতভাগ নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালনের’ কথা বলা হলেও দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানটির এক অফিস আদেশ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি এক অফিস আদেশে গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীসহ শীর্ষপদে থাকা ১৩ জনকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় সংস্থাটি।
তারা হলেন- গণপূর্ত অধিদফতরের (আজিমপুর) নির্বাহী প্রকৌশলী ইলিয়াস আহমেদ, ঢাকা গণপূর্ত জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ, নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ, গণপূর্ত অধিদফতরের তদন্ত কোষ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল হক, মহাখালী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দিন, ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-১ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা গণপূর্ত বিভাগ- ৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুল মোমেন চৌধুরী, ঢাকা সার্কেল- ১ এর অবসরপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল কাদের চৌধুরী, ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল- ৩ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মাফেন, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মইনুল ইসলাম, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মুনিফ আহমেদ এবং একই প্রতিষ্ঠানের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া আশরাফুজ্জামান।
দুদক সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার স্বাক্ষরিত ওই অফিস আদেশে অভিযোগ থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। আদেশে বলা হয়, ‘তাদের বিরুদ্ধে ঠিকাদার জি কে শামীমসহ প্রভাবশালীদের শত শত কোটি টাকা ঘুষের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ দিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনো ব্যবসা ও অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল। ওই সব অভিযোগ দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত না হওয়ায় তা পরিসমাপ্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
মামলা ও চার্জশিট দেওয়া হয়েছে যাদের বিরুদ্ধে
ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট : ক্যাসিনোকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর দায়ের করা মামলায় দুই কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু পরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিসতৃত হয় এবং চার্জশিটে তার বিরুদ্ধে প্রায় ২২৩ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। দুদক জানায়, সম্রাটের বিচারকাজ শুরু হয়েছে।
জি কে শামীম : অবৈধভাবে ২৯৭ কোটি আট লাখ ৯৯ হাজার ৫৫১ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীমের (এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম) বিরুদ্ধে মামলা হয়। দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তদন্ত শেষে এ বছরের ১৭ জানুয়ারি আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়।
চার্জশিটে ২৯৭ কোটি ৩৯ লাখ ১২ হাজার ৭৮৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। চার্জশিটে জি কে শামীমের সঙ্গে তার মা আয়েশা আক্তারকেও আসামি করা হয়েছে। এর বিচারকাজও শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
ক্যাসিনোকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও জি কে শামীমসহ শীর্ষ ২৪ জনের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা দায়ের করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ১২ মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ২৪ আসামির প্রায় ৫৮২ কোটি টাকার সম্পদও জব্দ করেছে দুদক
সেলিম প্রধান : অবৈধভাবে ১২ কোটি ২৭ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫৪ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনোর মূলহোতা মো. সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তদন্ত শেষে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। এটিরও বিচার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া : পাঁচ কোটি ৫৮ লাখ ১৫ হাজার ৮৫৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর দুদকের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম মামলার বাদী হন। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর চার্জশিট দেওয়া হয়। চার্জশিটে ৪২ কোটি ৭৫ লাখ ৭০ হাজার ৭৫৬ টাকার সম্পদের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া তার বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে পৃথক তিনটি ব্যাংকে মোট আট কোটি ৭৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬ টাকা পাচারেরও অভিযোগ আনা হয়েছে।
জাকির হোসেন : যুবলীগ নেতা সম্রাটের কথিত ডানহাত জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি ৪৯ লাখ তিন হাজার ৯৩৮ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়। ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তদন্ত শেষে এ বছরের ১৮ জানুয়ারি আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় চার্জশিট দাখিল করা হয়। চার্জশিটে পাঁচ কোটি ৮৬ লাখ সাত হাজার ৬৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।
কাজী আনিছুর রহমান ও সুমি রহমান : ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর দায়ের করা মামলায় যুবলীগের বহিষ্কৃত দফতর সম্পাদক কাজী আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে ১২ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার ৯২০ টাকা এবং তার স্ত্রী সুমি রহমানের বিরুদ্ধে এক কোটি ৩১ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রায় ১৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ১২৩ কোটি ৫৪ টাকা পাচারের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক চার্জশিট দাখিল করে সংস্থাটি।
এনামুল হক এনু : গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি এনামুল হক এনুর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর ২১ কোটি ৮৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী।
চলতি বছরের ১০ জুন এনুর বিরুদ্ধে দাখিল করা চার্জশিটে সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৭৮ টাকা। চার্জশিটে তার দুই সহযোগী হারুনুর রশিদ ও আবুল কালাম আজাদকেও আসামি করা হয়। শিগগিরই আদালতে বিচারকাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে।
রুপন ভূঁইয়া : গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সম্পাদক রুপন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ১৪ কোটি ১২ লাখ ৯৫ হাজার ৮৮২ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তবে চার্জশিটে রুপম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ৩৭ কোটি ৫৭ লাখ ১৬ হাজার ৯৮৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।
শফিকুল আলম ফিরোজ : দুই কোটি ৬৮ লাখ দুই হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালতে চার্জশিট দেয় দুদক।
এখনো তদন্তাধীন যেসব মামলা
লোকমান হোসেন ভূঁইয়া : বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে চার কোটি ৩৪ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৮ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর মামলা হয়। মামলাটি তদন্তের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই আদালতে এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
ক্যাসিনো সাঈদ : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বরখাস্ত হওয়া কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ ওরফে ক্যাসিনো সাঈদের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর চার কোটি ৪৭ লাখ ৬৬ হাজার ২৬১ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আতাউর রহমান বাদী হয়ে মামলা করেন। তদন্ত এখনো চলমান। এছাড়া সাঈদের স্ত্রী ফারহানা আহম্মেদ বৈশাখীর বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পৃথক অনুসন্ধান চলছে।
তারেকুজ্জামান রাজীব : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. তারেকুজ্জামান রাজীবের বিরুদ্ধে ২৬ কোটি ১৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী বাদী হয়ে মামলাটি করেন। বর্তমানে এটিও তদন্তাধীন রয়েছে।
পাগলা মিজান : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর ৩০ কোটি ১৬ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়। এর তদন্তকাজ এখনো শেষ হয়নি।
এনামুল হক আরমান : সম্রাটের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি এনামুল হক আরমানের বিরুদ্ধে দুই কোটি পাঁচ লাখ ৪০ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর মামলা করে দুদক। মামলাটির তদন্ত এখনো চলছে।
প্রশান্ত কুমার হালদার : ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেড ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) বিরুদ্ধে মামলা হয়। যা এখনো তদন্তাধীন।
প্রকৌশলী উৎপল : প্রায় আট কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে ও তার স্ত্রী গোপা দের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ৫ আগস্ট পৃথক দুটি মামলা করে দুদক। মামলায় উৎপলের বিরুদ্ধে এক কোটি ১৮ লাখ ১৭ হাজার ৯০৩ টাকা এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ছয় কোটি ৬২ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫৪ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। যার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
মুমিতুর রহমান : প্রায় সোয়া পাঁচ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ঠিকাদার জি কে শামীমের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র সহকারী প্রধান মুমিতুর রহমান ও তার স্ত্রী জেসমিন আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর মামলা হলেও এখনো চার্জশিট দেওয়া হয়নি।
অনুসন্ধানেই কেন আটকে যাচ্ছে দুদকের কার্যক্রম
অনুসন্ধানে নেমেই কেন আটকে যাচ্ছে দুর্নীতিবিরোধী সার্বিক কার্যক্রম? ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে এ প্রশ্ন রাখা হয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের কাছে। তিনি বলেন, ‘দুদকের হাতে বিপুলসংখ্যক অভিযোগ রয়েছে। সেটার চাপে এমনিতেই দুদকের লেজেগোবরে অবস্থা। তবে এর মধ্যে বড় বড় বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে দুদকের যে কাজ করার কথা ছিল, সেটা কতটুকু করতে পেরেছে তা আমার জানা নেই। যে কারণে ক্যাসিনো ও অর্থপাচার সংক্রান্ত আলোচিত ঘটনার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।’
তাহলে দুদকের দুর্বলতা কোথায়— জবাবে তিনি বলেন, ‘এ সংক্রান্ত অপরাধে অপরাধী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে দুদকের সক্ষমতা ও কারিগরি দক্ষতার ঘাটতি থাকতে পারে। সার্বিকভাবে আমি মনে করি একধরনের সদিচ্ছা ও সৎ সাহসের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া, এ ধরনের বড় অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তারা ক্ষমতার বলয়ে থাকেন। তাদের ধরতে গেলে হাত পুড়ে যাবে— এমন ভয় দুদকের মধ্যেও থাকতে পারে। তবে, চাইলে কিছু বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে দুদক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত।’
দুদকের অনুসন্ধান দলে যারা আছেন
ক্যাসিনোসহ নানা অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান পরিচালনা করেন কমিশনের পরিচালক সৈয়দ ইকবালের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি দল। বাকি সদস্যরা হলেন- উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. সালাহউদ্দিন, গুলশান আনোয়ার প্রধান, সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, আতাউর রহমান ও মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী।
আরএম/এমএআর/জেএস