‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ডিজিটাল জনশুমারির জন্য ৩ লাখ ৯৫ হাজার ট্যাব কিনতে চায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এজন্য তারা টেন্ডার আহ্বান করেছে। তবে এমন সব শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে মাত্র দুটি কোম্পানি টেন্ডারে অংশ নিতে পেরেছে। এ দুটির মধ্যেও আবার ট্যাব সরবরাহে যারা বেশি টাকা চেয়েছে, তাদেরকেই পছন্দ বিবিএসের!  

মূল প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর। অনুমোদিত প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হবে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে আসবে ১৮৩ কোটি ১১ লাখ টাকা।

প্রকল্পের আওতায় শুধু ডিজিটাল জনশুমারির জন্য প্রথম সংশোধনীতে ২ জিবি র‍্যাম এবং ৩২ জিবি রম সমৃদ্ধ ৩ লাখ ৯৫ হাজার ট্যাব কিনতে ৫৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যদিও এর চেয়ে কম বাজেটে এর চেয়ে উন্নত স্পেসিফিকেশনের ট্যাব কেনা সম্ভব। 

৩ লাখ ৯৫ হাজার ট্যাব কিনতে আহ্বান করা টেন্ডারে অংশ নিতে ৮টি প্রতিষ্ঠান শিডিউল ক্রয় করলেও বিবিএসের দেওয়া শর্তের কারণে মাত্র দুটি কোম্পানি টেন্ডারে অংশ নিতে পেরেছে। কোম্পানি দুটি হচ্ছে- ‘ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড’ এবং ‘ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’। 

ই-জিপিতে ‘ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড’ ৫৪৮ কোটি টাকা এবং ‘ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ ৪০২ কোটি টাকায় টেন্ডার সাবমিট করেছে। ই-জিপির নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে। কিন্তু টেন্ডারে অংশ নিতে না পারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ওয়ালটন কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, বিবিএস চাচ্ছে ১৪৬ কোটি টাকা বেশি দরদাতা ‘ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডকে’ কাজ দিতে।

এসব প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ, নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাওয়ানোর উদ্দেশ্যে ন্যূনতম পর্যায়ের স্পেসিফিকেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ফলে দেশের বড় বড় আইটি ফার্ম এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠান টেলিফোন শিল্প সংস্থাও টেন্ডারে অংশ নিতে পারেনি। 

দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড টেন্ডারে ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের চেয়ে উন্নত স্পেসিফিকেশন অর্থাৎ ২ জিবির পরিবর্তে ৪ জিবির র‍্যাম এবং ৩২ জিবির পরিবর্তে ৬৪ জিবি রম সমৃদ্ধ ট্যাব দেওয়ার কথা বলেছে, সেটিও ফেয়ারের চেয়ে ১৪৬ কোটি টাকা কমে। অর্থাৎ টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা হলো ওয়ালটন। কিন্তু বিবিএস ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডকেই কাজটা দিতে চাইছে বলে অভিযোগ ওয়ালটনের।

এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিবিএসের মূল্যায়ন কমিটি বেশি দরদাতা ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের পক্ষে তাদের মত দিয়ে দিয়েছে। এরপর এটি মন্ত্রণালয়ের পারচেজ (ক্রয়) কমিটিতে যাবে। সেখাানে অনুমোদন হলে কাজ পেয়ে যাবে ফেয়ার ইলৈকট্রনিক্স। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক কবির উদ্দিন আহাম্মদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। 

বিবিএসের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ফলে এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যদি একই কোয়ালিটির পণ্য হয়ে থাকে তাহলে অতিরিক্ত অর্থে ট্যাব কেনার বিষয়টি আমি নিজেও সমর্থন করব না। এজন্য বিবিএস কাগজে-কলমে কী করেছে সেটা দেখব। রাষ্ট্রীয় অর্থ বাঁচাতে পারলে সেটাই আমাদের সার্থকতা। আমার কাছে ফাইল এলেই বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখব।’

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বেশি দরদাতার কাছ থেকে ট্যাব কেনা হচ্ছে কি না আমার জানা নেই। তবে আমি বিবিএসের সচিব ও ডিজির কাছে এর সত্যতার বিষয়ে জানতে চাইব। আমার ধারণা, প্রকিউরমেন্ট রুলস ভায়োলেট করে কিছুই করা সম্ভব নয়।’

এদিকে বিবিএসের আহ্বান করা দরপত্র সংশোধনের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানকে চিঠি দিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। দরপত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো প্রস্তাবনা অনুযায়ী সংশোধনের বিষয়টি বিবেচনার জন্য পরিকল্পনামন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন দুই মন্ত্রী।

চিঠিতে বলা হয়েছে, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে এ খাতের দেশীয় শিল্পের প্রসার ও আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রহণযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। আপনি (পরিকল্পনামন্ত্রী) জানেন যে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিবিএস বিগত ২৩ জুন ৩ লাখ ৯৫ হাজার ট্যাবলেট ও ৭২টি এসি কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্রে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বেশকিছু শর্ত সহজ করা একান্ত আবশ্যক। টেন্ডারে (দরপত্র) শুধুমাত্র একটি সিঙ্গেল লটের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার শর্তা আরোপ করা হয়েছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য ৪টি লটে এগুলো সংগ্রহ করা যৌক্তিক হবে। পূর্ব অভিজ্ঞতা হিসেবে বিগত ৩ বছরে একাধিক কার্যাদেশ/ চুক্তির মাধ্যমে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার আইটি পণ্য (যেমন- মোবাইল, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ এবং আইটি একসেসরিজ) সরবরাহের বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ রইল। 

এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দরপত্র শুধুমাত্র একটি লটে ভুক্ত না করে কমপক্ষে ৪টি লটে বিভক্ত করে প্রতিযোগিতামূলক লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার সুপারিশও করেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং আইসিটি বিভাগ।

এরপর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে কিছু শর্ত সহজ করার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিবিএসকে চিঠি দিয়েছে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিবিএস মহাপরিচালক (ডিজি) মো. তাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তথ্য সংগ্রহের কাজে ট্যাবগুলো ব্যবহার করা হবে। একটি নির্দিষ্ট সফটওয়্যার যাতে সব ট্যাবে সাপোর্ট করে সেজন্য আমরা একই ধরনের ট্যাব কিনতে চাই। ট্যাব কেনার আগে সিপিটিইউয়ের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হয়েছে। সিপিটিইউ এই টেন্ডারটা এক লটে দেওয়ার জন্য বলেছে। এই টেন্ডারে সিপিটিইউয়ের মতামত আছে।’ 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এমনটি হলে তা হবে সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার, যার অপর নাম দুর্নীতি। এটা অবৈধ এবং অনৈতিক হবে। এটা কেন করা হচ্ছে এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবিএসের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত।’

‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১’ শীর্ষক প্রকল্পটি শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হোঁচট খেয়েছে। এতে সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।  

প্রকল্প বাস্তবায়নে সফলতার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিবিএস কর্মকর্তারা। তারা জানান, একনেকে অনুমোদনের পর সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু সাবেক সচিবের অবসরোত্তর ছুটি ও করোনা মহামারির কারণে কাজে বিঘ্ন ঘটে। এদিকে, বর্তমানে যিনি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আছেন জনশুমারির অভিজ্ঞতা তার নেই। যার প্রভাব পড়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে। ইতোমধ্যেই দফায় দফায় প্রকল্পের কাজ পেছানোসহ একবার সংশোধনও করতে হয়েছে ডিপিপি। যেই সংশোধনীতে মাঠ পর্যায়ে গণনার চিত্র পরিবর্তন হয়ে গেছে। 

এসআর/এইচকে/এনএফ/জেএস