প্রতি মিটার কচুরিপানা অপসারণে ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় হাজার টাকা

খাল থেকে কচুরিপানা অপসারণের একটি কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকার আবদার করেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ১৫ কিলোমিটার কচুরিপানা পরিষ্কারে প্রতি মিটারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় হাজার টাকা। বাপাউবোর এমন আবদারের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনাও দিতে বলা হয়েছে।

সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগে ‘বরগুনা জেলার অধীনে পায়রা নদীর ভাঙন হতে আমতলী শহর এবং আরপাঙ্গাশিয়া ও ঘটখালি বাজার প্রতিরক্ষা এবং পোল্ডার ৪৩/১ ও ৪৪-বি অভ্যন্তরে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পের ওপর পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, পায়রা নদীর ভাঙনের হাত থেকে বরগুনার আমতলী শহর, আরপাঙ্গাশিয়া ও ঘটখালি বাজার রক্ষায় বাঁধ নির্মাণসহ বেশকিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সুবন্দি খালের ১৫ কিলোমিটার কচুরিপানা অপসারণ উল্লেখযোগ্য। এই কচুরিপানা পরিষ্কার করতে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকার আবদার করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তবে পরিকল্পনা কমিশন এমন বরাদ্দের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে বলেছে।

পায়রা নদীর ভাঙনের হাত থেকে বরগুনার আমতলী শহর, আরপাঙ্গাশিয়া ও ঘটখালি বাজার রক্ষায় বাঁধ নির্মাণসহ বেশকিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সুবন্দি খালের ১৫ কিলোমিটার কচুরিপানা অপসারণ উল্লেখযোগ্য। এই কচুরিপানা পরিষ্কার করতে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকার আবদার করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সুবন্দি খালের ১৫ কিলোমিটার কচুরিপানা অপসারণে অতিরিক্ত অর্থসংস্থানের ভিত্তি এবং পরিষ্কারের পর খালটির রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে তার কোনো তথ্য নেই। পাউবো যদি এ প্রকল্পের মাধ্যমে খালটি পরিষ্কারও করে তাহলে পরবর্তী সময়ে খালটি পরিষ্কার থাকবে কি না— সেই বিষয়েও কিছু উল্লেখ করেনি। কর্মসূচিটি রাখতে হলে বাপাউবোকে খালটি পরিষ্কার-পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের বিস্তারিত পরিকল্পনা দিতে বলা হয়েছে।

কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাস স্বাক্ষরিত পিইসি সভার কার্যবিবরণীতে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় সুবন্দি খালের ১৫ কিলোমিটার কচুরিপানা পরিষ্কার বাবদ দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। এই হিসাবে প্রতি মিটার (৩.২৮ ফুট) কচুরিপানা অপসারণে এক হাজার ৫০০ টাকা ব্যয় করা হবে। অর্থাৎ প্রতি ফুট পরিষ্কারে খরচ হবে ৪৫৭.৩১ টাকা।

কচুরিপানায় ভরা বরগুনার সুবন্দি খাল

সচিব রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাস পিইসি সভায় অস্বাভাবিক এ ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবোর প্রতিনিধি বলেন, হালনাগাদ রেট শিডিউল অনুযায়ী কচুরিপানার ব্যয় নির্ধারণ হয়েছে। হালনাগাদ রেট শিডিউলে উল্লেখিত ব্যয় নির্ধারণ আছে। বাপাউবোর প্রতিনিধির এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পিইসি কমিটি জানায়, কচুরিপানা পরিষ্কারে অতিরিক্ত সংস্থানের ভিত্তি ও পরিষ্কারের পর খালটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা কী হবে তার বিস্তারিত তথ্য পুনর্গঠিত ডিপিপিতে দিতে হবে।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব এস এম রেজাউল মোস্তফা কামাল এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের যে শিডিউল আছে, সেটি আমরা পরিকল্পনা কমিশনকে দেব। বাপাউবো অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই এই রেট শিডিউল করেছে। তারা আমাকেও বলেছে, রেট শিডিউল অনুযায়ীই এই ব্যয় দেওয়া। এখন পরিকল্পনা কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী পুনর্গঠিত ডিপিপিতে সবকিছু উল্লেখ করব।’

এক মিটার কচুরিপানা পরিষ্কারে দেড় হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। এটি কি বাস্তবসম্মত—  এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের যারা শিডিউল তৈরি করেছে, তারাই বলতে পারবেন। আমার জানা মতে, উনাদের একটি ব্যাখ্যা আছে। বাপাউবো পুনর্গঠিত ডিপিপি তৈরি করার পর আমি নিজে এটি ভালোভাবে দেখে দেব।’

পিইসি সভা সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটি গ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পাদন করা হয়নি। বিস্তারিত আলোচনায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার জন্য পাউবোর অভ্যন্তরীণ কমিটির সঙ্গে পানি সম্পদ সেক্টরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একাধিক বাইরের সদস্যের নেতৃত্বে (যেমন- বুয়েটের আইডব্লিউএফএম অথবা সিইজিআইএস, আইডব্লিউএম ও ওয়ারপো) হালনাগাদ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পাদন করতে হবে। এই সমীক্ষার রিপোর্ট সংশোধিত ডিপিপিতে যুক্ত করতে হবে।

ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন, বিস্তারিত পরিকল্পনা চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন

পরিকল্পনা কমিশন সবার সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা রিপোর্ট দিতে বললেও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, এ পর্যায়ে এসে সমীক্ষা করা সম্ভব নয়। সবার সমন্বয়ে একটি কমিটির মাধ্যমে তাদের মতামত সংশোধিত ডিপিপিতে যুক্ত করে দেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এস এম রেজাউল মোস্তফা কামাল সমীক্ষা প্রসঙ্গে বলেন, ‘মূলত চারটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করতে হয়। ওই চার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এটি করতে গেলে বছরখানেক সময় লাগে। আমরা দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি উচ্চপর্যায়ের টেকনিক্যাল কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকল্পটির ডিপিপি প্রণয়ন করেছি।’

‘যেহেতু পরিকল্পনা কমিশন সব প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির রিপোর্ট দিতে বলেছে, সেহেতু আমরা সবার মতামত সংশোধনী প্রস্তাবনায় যুক্ত করে দেব। ফিজিবিলিটি করতে গেলে এক বছর সময় লাগবে, যেটি এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এজন্য কমিটি করে তাদের মতামত দিয়ে দেব’— বলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব।

কচুরিপানা অপসারণে এমন ব্যয়ের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও অনেক অযৌক্তিক ব্যয় ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নির্দেশনা আমলে নেয় না, কারণ তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। যদি কোনো শাস্তি বা জবাবদিহিতা না থাকে তাহলে কেন তারা এসব নির্দেশনা আমলে নেবে? 

‘সরকারি কর্মকর্তাদের যেকোনো বিষয়ে দুটি চাপ থাকে। একটি ভেতর থেকে, আরেকটি বাইরে থেকে। এসব বিষয় আমলে নিতে হলে একটি অ্যাকাউন্টেবিলিটির (দায়িত্ব) ব্যবস্থা থাকতে হয়।’

রাজধানীর গ্রিন রোডে অবস্থিত পানি ভবন

তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজেও বুঝতে পারছি না, কচুরিপানা কি অনেক রকমের হয় নাকি? শুধু কচুরিপানা নয়, আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রেও কাজের তুলনায় ব্যয় কয়েকগুণ বেশি ধরা হয়। এটি অনেক পুরোনো সমস্যা। আগের হাজার হাজার উদাহরণের সঙ্গে নতুন করে বিষয়টি যুক্ত হলো।’

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিষয়গুলো পরিকল্পনা কমিশনে আসার আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন হয়ে আসে। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটা যদি নিয়ম মানার জন্য হয় তাহলে আর স্বচ্ছতা থাকে না। কারণ, পরিকল্পনা কমিশনে এই প্রস্তাব আসার আগে এমন ব্যয় কেউ না কেউ অনুমোদন করেছেন। আমার প্রশ্ন হলো, এই প্রক্রিয়াগুলো পার হচ্ছে কীভাবে। সামান্য কচুরিপানা পরিষ্কার করতে প্রয়োজন দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা? এখানে এত টাকা আবদারে দুর্নীতির বিষয় চলে আসে। এর বাইরে আমি আর কোনো ব্যাখ্যা দেখি না। কারণ, এ কাজ করতে কোনো দক্ষতার প্রয়োজন হয় না।’

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রকল্পটির বিষয়ে আমি এখনও কিছু জানি না। কারণ, এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি সচিবের দফতরে আছে। তারপরও আমি খোঁজ নেব। এমন অনেক প্রকল্প এর আগে আমি ফেরত পাঠিয়েছি। পিইসি সভায় চূড়ান্ত হয়ে আসলে বোঝা যাবে ব্যয়ের যৌক্তিকতা কতটুকু। আমার হাত দিয়ে কোনো অযৌক্তিক ব্যয়ের প্রকল্প যাবে না।’

রাজধানীর শেরে বাংলানগরে অবস্থিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

প্রকল্প প্রস্তাবনায় দেখা গেছে, এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫৩ কোটি টাকা। পুরো টাকা সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হবে। প্রকল্পটি অনুমোদনের পর চলতি বছরের জুন থেকে জুন ২০২৫ সালে বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।

প্রকল্পের কার্যক্রমগুলো হলো- পাঁচ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ, সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার বাঁধের ঢাল সংরক্ষণ, সংরক্ষণ কাজের মেরামত, সাড়ে আট কিলোমিটার বাঁধ মেরামত/পুনরাকৃতিকরণ, সাড়ে ৬১ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন, খালের ১৫ কিলোমিটার কচুরিপানা পরিষ্কার, ১২টি রেগুলেটর নির্মাণ/পুনর্নির্মাণ, ছয়টি রেগুলেটর মেরামত, পাঁচটি ব্রিজ নির্মাণ, একটি সাইট অফিস নির্মাণ ও বনায়ন।

এসআর/এমএআর