‘জেনে, না বুঝে’ সাইবার অপরাধে কিশোর-তরুণরা
গত চার বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করেন আঞ্জুমান (ছদ্মনাম)। নিত্যদিনের নানা ঘটনা ও ছবি নিয়মিত আপলোড করা ছিল তার নেশা। হঠাৎ অপরিচিত একজন তার ছবি ও অন্যান্য তথ্য ব্যবহার করে একটি ফেক (নকল) অ্যাকাউন্ট খোলেন। ওই অ্যাকাউন্ট থেকে আঞ্জুমানের পরিচিতদের কাছে প্রথমে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট (বন্ধুত্বের অনুরোধ) পাঠানো হয়। রিকোয়েস্ট গ্রহণের পর তাদের কাছে টাকা চাওয়াসহ নানা ধরনের খারাপ প্রস্তাবও পাঠানো হয়। ফলে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন আঞ্জুমান।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় ভুক্তভোগী এ তরুণীর (২০)। বলেন, আমার নাম ও ছবি ব্যবহার করে ফেক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। ওই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আমার আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের কাছে টাকা চাওয়া শুরু করে ওই ব্যক্তি। বিভিন্ন ধরনের খারাপ প্রস্তাবও দেওয়া হয়। তারা আমাকে ভুল বুঝতে শুরু করেন। পরিবার থেকে শুরু হয় বকাঝকা। আমিই এসব করছি— এমন ধারণা পোষণ করেন তারা। কারণ, সেখানে ব্যবহৃত নাম আমার, ছবিও আমার। ফ্রেন্ড লিস্টে (বন্ধুদের তালিকা) যারা আছেন, তারাও আমার পরিচিতজন। কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই যে, এটা আমার আইডি নয়।
বিজ্ঞাপন
‘একপর্যায়ে পরিচিত এক আইটি এক্সপার্টের (তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ) সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তার পরামর্শে প্রথমে রিপোর্ট করে সেই ফেক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করি। এরপর থানায় মামলা করি।’ সাইবার অপরাধের শিকার আঞ্জুমান বলেন, ‘এটি যে কারও সঙ্গেই ঘটতে পারে। অত্যন্ত অমার্জনীয় অপরাধ। শাস্তি না হলে এ ধরনের অপরাধ বাড়তেই থাকবে।’
ফেসবুকে বা কোনো গণমাধ্যমে কাউকে নিয়ে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারও নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দিলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে কিংবা শেয়ার বা লাইক দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে
সাইবার অপরাধ দমন ও মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে সাইবার অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে জুয়া, পর্নোগ্রাফি ও মানবপাচারের মতো ঘটনাও ঘটছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, কখনও জেনে আবার কখনও না জেনে এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন দেশের কিশোর-তরুণরা।
সাইবার অপরাধ কী
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮ অনুযায়ী, ফেসবুকে বা কোনো গণমাধ্যমে কাউকে নিয়ে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারও নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দিলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে কিংবা শেয়ার বা লাইক দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে।
কাউকে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হুমকি দিলে, অশালীন কোনো কিছু পাঠালে কিংবা দেশবিরোধী কোনো কিছু করলে তা সাইবার অপরাধ বলে গণ্য হবে। আবার ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে কিংবা কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করলে সাইবার অপরাধ হতে পারে। এছাড়া অনলাইনে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তা-ও সাইবার অপরাধ হবে।
২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাইবার অপরাধের ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় তিন হাজার ৬৫৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৫৭৫টি মামলা সাইবার ট্রাইব্যুনালে গেছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২২টির। ২৫ মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্টারনেট ব্যবহারে সাবধান বা সচেতন থাকার কোনো বিকল্প নেই। একটু অসচেতন হলেই ফেঁসে যেতে পারেন সাইবার অপরাধের জালে। জেনে হোক বা না জেনে, অনলাইনে কোনো অপরাধ করলে দিতে হয় কঠিন মাশুল।
পুলিশের ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাইবার অপরাধের ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় তিন হাজার ৬৫৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৫৭৫টি মামলা সাইবার ট্রাইব্যুনালে গেছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২২টির। ২৫ মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে।
সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট দুই হাজার ৬৪২টি মামলা আসে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২৫৬টি, ২০১৯ সালে ৭২১টি, ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি এবং ২০১৩ সালে আসে তিনটি মামলা।
২০১৩ থেকে ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২৪টি মামলার রায় ঘোষণা করেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৩৫টি মামলার আসামিদের সাজা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৮৯টি মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এছাড়া অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন ২০০টিরও বেশি মামলার আসামিরা
সরাসরি ট্রাইব্যুনালে দায়ের হয়েছে এক হাজার ৮২টি মামলা। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ২৪৯টি, ২০১৯ সালে ৬৬৮টি এবং চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৬৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। দেখা গেছে, মামলাগুলোর মধ্যে ৪৪৭টি বিভিন্ন সংস্থাকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। বাকি ৬৩৫টি মামলায় প্রয়োজনীয় উপাদান না থাকায় আদালত খারিজ করে দেন। তদন্তাধীন ৪৪৭টি মামলার মধ্যে ১৫০টির তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে আদালতে জমা হয়েছে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত সাইবার অপরাধে মামলা হয়েছে ৫৯৮টি। মোট আসামি এক হাজার ১৪৭ জন। এসব মামলায় গ্রেফতার হন ৪০৮ জন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সাইবার অপরাধে মামলা হয়েছে ২০০টি, ২০২০ সালে ২৬২টি, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (মে পর্যন্ত) মামলা হয়েছে ১৩৬টি।
মামলা বেশি সাজা কম
সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২৪টি মামলার রায় ঘোষণা করেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৩৫টি মামলার আসামিদের সাজা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৮৯টি মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এছাড়া অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন ২০০টিরও বেশি মামলার আসামিরা।
শুধু ব্যক্তি-পর্যায়ে নয়, প্রাতিষ্ঠানিক-পর্যায়েও হয়রানি ও প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে। সম্প্রতি উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্সের (উই) প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশার নাম-পরিচয় ও ছবি ব্যবহার করে ফেক আইডি ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনেক উদ্যোক্তাকে মিথ্যা মেসেজ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১২ লাখ নারী সদস্যের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করা হয়
অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতারণা, যৌন হয়রানিসহ আরও অনেক ধরনের অপরাধ বাংলাদেশে আগে থেকেই সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু নতুন ধরনের সাইবার অপরাধ শঙ্কার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব অপরাধের জন্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে যোগাযোগ রক্ষা করেন অপরাধীরা।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সম্প্রতি এক বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই ঘটনায় ভিডিওতে থাকা অভিযুক্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করে ভারতের ব্যাঙ্গালুরু পুলিশ। ভিডিও দেখে এক তরুণের পরিচয় শনাক্ত করেন ভুক্তভোগীর বাবা। তার নাম রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, বাসা ঢাকার মগবাজারে।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ জানায়, টিকটক অ্যাপে কাজ করার প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পাচার করে আসছিলেন হৃদয়। ভাইরাল হওয়া ভিডিওর তরুণীকেও ভারতে পাচার করে নির্যাতন করা হয়। মূলত টিকটক ভিডিও তৈরির আড়ালে হৃদয়ের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ চক্রটি দেশ থেকে ভারতে নারীপাচার করত।
শুধু উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী নয়, সাইবার অপরাধের শিকার হন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। একদল প্রতারক ডিএমপি কমিশনারের অব্যবহৃত সরকারি মোবাইল নম্বর, র্যাবের পরিচালক, আইজিপির স্টাফ অফিসারসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের নম্বর স্পুফ করে। বেশকিছু দিন ধরে ওই চক্রটি এসব নম্বর থেকে দেশের বিভিন্ন সরকারি অফিসে কল দিয়ে প্রতারণা করে আসছিল
অন্যদিকে, ‘স্ট্রিমকার’ নামে জুয়ার অ্যাপ ব্যবহার করে দেশের বাইরে টাকা পাচারের অভিযোগে সম্প্রতি আটজনকে গ্রেফতার করে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট ও সিআইডি। পৃথক অভিযানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে নিষিদ্ধ হলেও ভিপিএন ব্যবহার করে জুয়ার বিভিন্ন অ্যাপ পরিচালনা করছেন অপরাধীরা। নিজেদের স্বার্থে তারা এসব অ্যাপ ব্যবহার করলেও না বুঝে এগুলো ব্যবহার করছেন লক্ষাধিক কিশোর-তরুণ। স্ট্রিমকারে জুয়া খেলতে লাগে ডিজিটাল কারেন্সি বিন্স ও জেমস। এগুলো কেনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে পাচার হচ্ছে শত কোটি টাকা।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে বেরিয়ে আসে ভয়ংকর মাদক এলএসডির তথ্য। অনলাইনে চলছিল এ মাদকের বেচা-কেনা। ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে মাদকসেবী ও সরবরাহকারীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
গত বছর অক্টোবরে অনলাইন পর্নোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নানা প্রলোভন আর বন্ধুত্বের আড়ালে তারা পর্নোগ্রাফি তৈরি করতেন বলে জানান গোয়েন্দারা।
সাইবার অপরাধ শুধু ব্যক্তি-পর্যায়ে নয়, প্রাতিষ্ঠানিক-পর্যায়েও হয়রানি ও প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে। সম্প্রতি উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্সের (উই) প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশার নাম-পরিচয় ও ছবি ব্যবহার করে ফেক আইডি ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনেক উদ্যোক্তাকে মিথ্যা মেসেজ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১২ লাখ নারী সদস্যের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনায় আহমানুল ইসলাম রাহাত নামের এক যুবককে গাজীপুর থেকে আটক করে সিটিটিসির সাইবার ইনভেস্টিগেশন টিম।
কিছুদিন আগে নিজের আইডিতে প্রবেশ করতে পারছিলেন না জারা হক (ছদ্মনাম)। রাজধানীর এ কলেজছাত্রী ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে আইডি উদ্ধারের সহযোগিতা চান। নিজেকে র্যাবের সাইবার টিমের সদস্য পরিচয় দিয়ে একজন তার আইডি উদ্ধারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকাও দেন জারা, উদ্ধার হয় আইডি। কিন্তু আইডি উদ্ধার হলেও নতুন বিপত্তি দেখা দেয়। আইডিতে থাকা ব্যক্তিগত ছবি দিয়ে ব্ল্যাক মেইল করে লাখ টাকা দাবি করেন এক প্রতারক। একপর্যায়ে ওই কলেজছাত্রী সিটিটিসির কাছে অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ জুন মিনহাজ আবেদীন ইফতি নামে এক তরুণকে ঢাকার বারিধারা থেকে আটক করে সাইবার ইনভেস্টিগেশন দল।
শুধু উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী নয়, সাইবার অপরাধের শিকার হন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। একদল প্রতারক ডিএমপি কমিশনারের অব্যবহৃত সরকারি মোবাইল নম্বর, র্যাবের পরিচালক, আইজিপির স্টাফ অফিসারসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের নম্বর স্পুফ করে। বেশকিছু দিন ধরে ওই চক্রটি এসব নম্বর থেকে দেশের বিভিন্ন সরকারি অফিসে কল দিয়ে প্রতারণা করে আসছিল। অভিযোগ পেয়ে সাইবার ইনভেস্টিগেশন টিম রংপুর জেলার কোতোয়ালি থানাধীন আলমনগর এলাকা থেকে রফিকুল ইসলাম ওরফে বাপ্পী নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে।
সাইবার অপরাধ দমনে তৎপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
দেশে সাইবার অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গঠন করা হয় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাংগঠনিক কাঠামোতে যোগ করা হয় ‘সাইবার পুলিশ সেন্টার’ নামের ইউনিটটি। এ প্রসঙ্গে সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইন্টেলিজেন্স) মো. রেজাউল মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে আমাদের তিনটি উইং কাজ করছে। সাইবার মনিটরিং ও সাইবার ইন্টেলিজেন্স, সাইবার ইনভেস্টিগেশন ও সাইবার সাপোর্ট সেন্টার। সাইবার মনিটরিং ও ইন্টেলিজেন্স এবং সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ২৪ ঘণ্টা কাজ করে। প্রতি মাসে কমপক্ষে তিন হাজার অভিযোগ আসে। প্রতারণা, হুমকি, হ্যাকিং, পর্নোগ্রাফি, আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগই বেশি। এসব অপরাধের অধিকাংশ ভুক্তভোগী হলেন নারী। তারা সাইবার পুলিশ সেন্টারের ই-মেইল, ফেসবুক অথবা ইমোতে ফোন করে অভিযোগগুলো দেন।
তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের অপরাধ তদন্তে সাইবার পুলিশ সেন্টারের সক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি। আমাদের ফরেনসিক ডিজিটাল ল্যাব আছে। পুলিশ সদরদফতরের কিছু ইনকোয়ারি আসে। ইন্টারনেট ও মোবাইল সহজলভ্য হওয়ায় অনলাইনভিত্তিক অপরাধও সহজ হয়ে গেছে। টেকনিক্যাল (প্রযুক্তিগত) হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ তদন্ত করাও বেশ কঠিন।’
সাইবার অপরাধে কিশোর-তরুণদের সংখ্যা কেন বাড়ছে— জানতে চাইলে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সাইবার ইন্টেলিজেন্স) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) সাঈদ নাসিরুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাইবার অপরাধে জড়িতদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই কিশোর-তরুণ। ফেসবুক হ্যাকিং, কারও সম্মানহানি, ব্ল্যাক মেইল, পর্নোগ্রাফিসহ নানা অপরাধে বয়স্কদের জড়িত থাকার পরিমাণ কম। প্রায় দেড় বছর ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ। এ সময় বেড়েছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোর-তরুণরা ঘরবন্দি সময় পার করছেন। পড়াশোনা না থাকায় সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছেন তারা।
এসব অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় সাইবার বুলিং। সাইবার বুলিংয়ের শিকার বেশি হচ্ছেন নারীরা— যোগ করেন তিনি।
ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিনিয়ত সাইবার অপরাধের ধরন বদলাচ্ছে। সেই অনুযায়ী আমাদের তদন্ত ও অনুসন্ধান করতে হচ্ছে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে হচ্ছে আমাদের।
তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটেছে। এর যেমন সুবিধা আছে, অসুবিধাও রয়েছে অনেক। অসুবিধাগুলো এড়িয়ে চলতে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিশোর-তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সত্যিকার অর্থে আমাদের মানবিক উন্নতির বিকল্প নেই। কোনো অ্যাপ বা অনলাইন প্লাটফর্ম ঢালাওভাবে বন্ধ করে দিলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।’
একই অভিমত ব্যক্ত করেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অ্যাপ, গ্রুপ বা ওয়েব বন্ধ করা বা নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। একটা বন্ধ করলে বিকল্প হাজির হবে। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া উচিত।
প্রথমত, ল্যাপটপ বা মোবাইল ব্যবহারে দরকার প্যারেন্টাল গাইডেন্স (অভিভাবকের নির্দেশনা)। সন্তান কী করছে, কী দেখছে, কী ব্যবহার করছে, কার সঙ্গে তার ডিজিটাল প্লাটফর্মে সখ্য গড়ে উঠছে, এগুলো খেয়াল করা। প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করা। অভিভাবকদের এমন কিছু করে রাখা যাতে সন্তান খারাপ সাইটে বা গ্রুপে তৎপর হলে সঙ্গে সঙ্গে নোটিফিকেশন পান বা জানতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, সচেতনতার বিকল্প নেই। অনেক সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তাও সাইবার সিকিউরিটি, সাইবার ল সম্পর্কে জানেন না। সেখানে সাধারণদের জন্য তো জানা আরও সীমাবদ্ধ। এখানে সচেতনতা বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
তৃতীয়ত, আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশের প্রাযুক্তিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। মামলা তো বটেই, জিডিও গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা গেলে অনেকাংশে কমে আসবে সাইবার অপরাধ।
সাইবার অপরাধের শিকার হলে কী করবেন
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাইবার ইনভেস্টিগেশন বিভাগ বলছে, কোনো কারণে আপনি যদি সাইবার অপরাধের শিকার হন, তাহলে আপনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বিষয়টি জানিয়ে রাখতে পারেন। প্রয়োজনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে পারেন। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনেও (বিটিআরসি) লিখিতভাবে বিষয়টি জানিয়ে রাখতে পারেন। এতে কেউ ফাঁসানোর চেষ্টা করলে আপনি কিছুটা সুরক্ষা পেতে পারেন।
জেইউ/এসকেডি/এমএআর/