হতে পারে নিবন্ধন বাতিল, তারপরও ‘প্রবাস কমিটি’ বিএনপির!
নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী দলের নিবন্ধন বাতিলের শঙ্কা রয়েছে। এরপরও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো বিদেশে দলের শাখা কমিটি (প্রবাস সংগঠন) করছে বিএনপি। বর্তমান করোনা মহামারিতে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার ঘোষণা দিলেও বিদেশে কমিটি গঠনে সেটা মানা হচ্ছে না। গত সপ্তাহে দুটি দেশে বিএনপির প্রবাস সংগঠনের কমিটি গঠন হয়েছে। ফলে দলটির ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কার স্বার্থে বিদেশে কমিটি দিচ্ছে বিএনপি?
নির্বাচন কমিশনের ‘রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন- ২০২০’ অনুযায়ী, কোনো দলের গঠনতন্ত্রে দেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে কোনো দফতর, শাখা বা কমিটি গঠন এবং পরিচালনার বিধান থাকে; তাহলে নির্বাচন কমিশনের ধারা ১১ অনুসারে সেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হবে।
বিজ্ঞাপন
নির্বাচন কমিশনের ‘রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন- ২০২০’ অনুযায়ী, কোনো দলের গঠনতন্ত্রে দেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে কোনো দফতর, শাখা বা কমিটি গঠন এবং পরিচালনার বিধান থাকে; তাহলে নির্বাচন কমিশনের ধারা ১১ অনুসারে সেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হবে
বিএনপির গঠনতন্ত্রে ‘সাংগঠনিক নীতিমালা ও কাঠামোতে’ ১৫টি সাংগঠনিক কমিটির কথা বলা আছে। সেখানে ১৫ নম্বরে আছে ‘প্রবাস সংগঠন’। এতে বলা হয়েছে, ‘প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিগণের মধ্যে যারা বিএনপির নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিতে বিশ্বাস করেন, তারা যেসব দেশে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন, সেসব দেশের প্রচলিত আইনে সংগঠন প্রতিষ্ঠা/পরিচালনা করতে পারবেন।’
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ভারত, মিয়ানমার ছাড়া প্রায় সব দেশেই বিএনপির প্রবাস কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, জাপান, সৌদি আরব, ইতালি, লেবানন, আরব আমিরাত, কুয়েতের কমিটি উল্লেখযোগ্য। সাধারণত দলের জাতীয় সম্মেলনে এসব দেশের কমিটিগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষিত হয়। কাউন্সিলর হিসেবে তারা সম্মেলনে ভোট বা মতামত দিতে পারেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, “আমাদের গঠনতন্ত্রে ‘প্রবাস সংগঠন’ নামের একটি ধারা আছে। এটি (গঠনতন্ত্র) নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত। সুতরাং ধারাটিও ইসি কর্তৃক অনুমোদিত।”
কিন্তু নির্বাচন কমিশনের আইনে বলা আছে, এ ধরনের কিছুই (সংগঠন) রাখা যাবে না। রাখলে দলের নিবন্ধন বাতিল হবে। এ প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন আমাদের গঠনতন্ত্রের ধারাগুলো দেখেই অনুমোদন দিয়েছে। এটা শুধু আমাদের নয়, আওয়ামী লীগেরও আছে। তারা (আওয়ামী লীগ) নিজেরা বিদেশে গিয়ে প্রবাস কমিটির উদ্বোধন করে আসেন।’
তবে, বিএনপির গঠনতন্ত্রে বিদেশ বা প্রবাস শাখার কোনো বিধান নেই বলে দাবি করেন দলটির কেন্দ্রীয় দফতরের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স৷ তিনি বলেন, ‘বিএনপির গঠনতন্ত্রে বলা আছে, প্রবাসীরা যে দেশে থাকেন, সেই দেশের আইন-কানুন মেনে যদি বিএনপির আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কোনো সংগঠন করতে চান, করতে পারবেন৷’
এদিকে বিএনপির নেতারা বলছেন, বিদেশে কমিটি করে সাংগঠনিকভাবে বিএনপির কোনো লাভ হয় না। যারা এসব কমিটিতে থাকেন, তারা মাঝেমধ্যে দলীয় ফান্ডে আর্থিক কিছু সহযোগিতা করেন। এর বাইরে দেশে ক্ষমতাসীন দলের হুকুমে বিএনপির ওপর দমন-নিপীড়ন বা নির্যাতন হলে তারা সেসব দেশের আইন-কানুন মেনে প্রতিবাদ করেন। এতে সেসব দেশের সরকার বা কূটনীতিকরা বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতিবিদদের ওপর সরকারের যে দমন-নিপীড়ন, সে বিষয়ে কিছুটা ধারণা পান। অন্যদিকে যারা প্রবাসে বিএনপির কমিটিতে থাকেন, তাদের উদ্দেশ্য থাকে যে, জীবনের কোনো একসময় দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচন করার। এছাড়া প্রবাসে বাঙালিদের মধ্যে নিজেকে বিএনপির নেতা বলে পরিচয় দিতে তারা কিছুটা সম্মান বোধ করেন। এ সুযোগে অনেকে সেখানে নেতাগিরিরও সুযোগ পান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আসলে প্রবাসে কমিটি দিয়ে বিএনপির কোনো লাভ হয় না। যারা কমিটিতে থাকেন তারা সেখানে স্থানীয় প্রবাসীদের কাছে নিজেকে বিএনপির নেতা বলে পরিচয় দেওয়ার সুযোগ পান। এটাই তাদের লাভ। এর বাইরে আর কিছু নয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, দেশের বাইরের কমিটিগুলোতে যারা নেতা নির্বাচিত হন, তারা সবাই আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান। অনেক সময় তারাই দলীয় ফান্ডে আর্থিক সহযোগিতা করেন। এর বাইরে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতারা তাদের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে মূল্যবান জিনিসপত্র উপহার হিসেবে পান। এছাড়া প্রবাস কমিটিতে যারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাদের পরিবারের অনেকে দেশে অবস্থান করেন। সেক্ষেত্রে তাদের মাধ্যমে পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রভাবিত করা যায়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় মালয়েশিয়া বিএনপির সভাপতি বদরুল রহমানের। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে মালয়েশিয়া বিএনপির প্রবাস শাখা কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে প্রবাস সংগঠনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বিধিনিষেধ আরোপিত হওয়ায় কমিটিগুলোকে ‘সহযোগী সংগঠন’ হিসেবে ধরা হয়।
প্রবাসে রাজনীতি করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বদরুল রহমান বলেন, মালয়েশিয়ায় প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাঙালি থাকেন। তাদের মধ্যে দলীয় আদর্শ প্রচারের একটা সুযোগ থাকে। এছাড়া তারা সবাই তো বাংলাদেশের ভোটার। ভোটেরও একটা ব্যাপার আছে। নিজ এলাকায় নির্বাচন করার, এমপি-মন্ত্রী হওয়ার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যও থাকে। তবে সেই সংখ্যাটা খুব বেশি নয়।
অভিযোগ আছে, বর্তমান করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে সবধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু নিজেদের নির্দেশনা নিজেরাই অমান্য করে গত ২ জুলাই লেবনান শাখা বিএনপির ৯৯ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি এবং ৩ জুলাই সৌদি আরব শাখা বিএনপির ৬১ সদস্যের কমিটির অনুমোদন দেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিদেশে সংগঠন করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বিধিনিষেধ থাকায় কমিটিগুলোর অনুমোদন দিলেও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়নি বিএনপি।
এএইচআর/এমএআর/