কম যায় না ‘সালমান শাহ’ গ্রুপও
কক্সবাজারে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ‘আল-ইয়াকিন’। রোহিঙ্গা এ সন্ত্রাসী গ্রুপের চেয়ে কম যায় না ‘সালমান শাহ’ গ্রুপও। ঢাকা পোস্টের সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজারে ডজনখানেকের অধিক রোহিঙ্গা সংগঠন বা গ্রুপ সক্রিয় আছে। ‘রোহিঙ্গাদের অধিকার’ আদায়ে কাজ করার কথা বললেও অপহরণ, ছিনতাই, রাহাজানি, মারামারি, গুম ও খুনের মতো ঘটনা ঘটছে তাদের হাতে। প্রতিনিয়ত এসব সংগঠনের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলেও প্রশাসন বলছে, ‘সন্ত্রাসী এসব সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব নেই’!
টেকনাফের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ‘সালমান শাহ’ গ্রুপের নাম। স্থানীয়রা বলছেন, টেকনাফের হোয়াইক্যং, লেদা, উনছিপ্রাং, নয়াপাড়া, মুসুনি এলাকার মানুষ সবসময় এ বাহিনীর ভয়ে তটস্থ থাকে। গত জুন মাসেও মুসুনি এলাকার দুজনকে অপহরণ করা হয়। পরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেয় সালমান শাহ গ্রুপের সদস্যরা
নিজ দেশের সেনাবাহিনীর হাতে বর্বর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ। রোহিঙ্গারা প্রথম যখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় তখন একপ্রকার কোণঠাসা ছিল তারা। আস্তে আস্তে বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) তত্ত্বাবধানে সংগঠিত হতে থাকে রোহিঙ্গারা। নিজেদের অধিকার আদায়ে গঠন করে বিভিন্ন সংগঠন বা গ্রুপ। একসময় তারা স্থানীয় বাংলাদেশিদের ওপরও প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়রা (বাংলাদেশি) বলছেন, কক্সবাজার ও টেকনাফের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন গ্রুপ। তাদের মধ্যে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে ‘আল-ইয়াকিন’ গ্রুপ। সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছেন, নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে তাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর হামলা। ওই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল আল-ইয়াকিন! এখন তারা বাংলাদেশেও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক বিক্রি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের মতো অপচেষ্টায় লিপ্ত তারা। ঠিক তাদেরই দেখানো পথ অনুসরণ করছে ‘সালমান শাহ’ গ্রুপ।
আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এ গ্রুপের কোনো অস্তিত্ব নেই। তারপরও কক্সবাজার ও টেকনাফের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ‘সালমান শাহ’ গ্রুপের নাম। স্থানীয়রা বলছেন, টেকনাফের হোয়াইক্যং, লেদা, উনছিপ্রাং, নয়াপাড়া, মুসুনি এলাকার মানুষ সবসময় এ বাহিনীর ভয়ে তটস্থ থাকে। গত জুন মাসেও মুসুনি এলাকার দুজনকে অপহরণ করা হয়। পরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেয় সালমান শাহ গ্রুপের সদস্যরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সালমান শাহ গ্রুপের একমাত্র উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন। এজন্য তারা কোনো অপরাধ করতে পিছপা হয় না। এসব কাজে তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে টেকনাফের স্থানীয় প্রশাসনসহ প্রভাবশালী কিছু নেতা!
প্রথম প্রথম বাংলাদেশিরা তাদের ভাড়াটে খুনি হিসেবে ব্যবহার করত। টাকা দিয়ে শত্রুকে খুন করাত। তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয় স্থানীয় প্রভাবশালী বাংলাদেশিরা। এখন বাংলাদেশিরাই তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে
রোহিঙ্গারা বলছেন, টেকনাফের নয়াপাড়া, শালবন ও লেদা ক্যাম্পে আতঙ্কের নাম সালমান শাহ গ্রুপ। প্রথম প্রথম বাংলাদেশিরা তাদের ভাড়াটে খুনি হিসেবে ব্যবহার করত। টাকা দিয়ে শত্রুকে খুন করাত। তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয় স্থানীয় প্রভাবশালী বাংলাদেশিরা। এখন বাংলাদেশিরাই তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
সালমান শাহ গ্রুপের সদস্য যারা
রোহিঙ্গাদের মতে, বর্তমানে সালমান শাহ গ্রুপের চার শতাধিক সদস্য রয়েছে। তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে। বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। অস্ত্র হিসেবে তারা রামদা ও পিস্তল ব্যবহার করে। স্থানীয়রা এ গ্রুপকে ‘রোহিঙ্গা ডাকাত দল’ হিসেবেও চেনে।
পুলিশের কাছে প্রায় ৫০টি অপহরণের ঘটনার তথ্য রয়েছে সালমান শাহ গ্রুপের বিরুদ্ধে। অনেকে ভয়ে অভিযোগ করেন না থানায়। গোপনে মুক্তিপণের অর্থ দিয়ে ছাড়িয়ে আনেন প্রিয়জনকে। তাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হত্যা মামলারও অভিযোগ আছে।
সম্প্রতি সালমান শাহ গ্রুপের হাতে অপহরণের শিকার হন স্থানীয় এক বাংলাদেশি। পরে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান। নাম প্রকাশ না করে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিংড়ির রেণু সংগ্রহ করতে প্রতিদিন সাগরে যাই। ওইদিনও লেদা ক্যাম্পের সামনে দিয়ে কক্সবাজারে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ছয়/সাতজন আমাকে ঘিরে ধরে। তাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর হবে। তারা আমার লুঙ্গির পেছনের দিকটা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তাদের তিনজনের মাজায় ছিল পিস্তল।
‘ক্যাম্পের ভেতরে আমাকে একটি ঝুপড়ি ঘরে রাখা হয়। মুখ বেঁধে ফেলা হয়। সেখানে নিয়ে কাঠ দিয়ে পেটাতে থাকে তারা। একশর বেশি চড়-থাপ্পড় মারে। এরপর আমাকে বাড়িতে ফোন দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দিতে বলে। অনেককে ফোন করি। কিন্তু পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। আমার ওপর চলতে থাকে অমানবিক নির্যাতন। পরে এক লাখ ৮৩ হাজার টাকা দিয়ে তাদের হাত থেকে মুক্তি পাই।’
ইয়াবা পাচার ও ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করে তারা
স্থানীয় বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, টেকনাফ ও কক্সবাজারে ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়েছে এ গ্রুপের সদস্যরা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, ভাড়াটে খুনি হিসেবেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। গত মার্চে নয়াপাড়া-১ ক্যাম্পের সি ব্লকের বাসিন্দা জলিলকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। সালমান শাহ গ্রুপের সদস্যরা টাকার বিনিময়ে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করে বলে জানা যায়।
ওই হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন টেকনাফের ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক তারিকুল ইসলাম। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে তিনি সালমান শাহ গ্রুপের হাতে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
নয়াপাড়া-২ ক্যাম্পের চার/পাঁচজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা জানান, ক্যাম্পে ‘পুতিয়া গ্রুপ’ নামে আরও একটি সন্ত্রাসী সংগঠন আছে। দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পুতিয়া ও সালমান শাহ গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলছিল। সর্বশেষ সালমান শাহ গ্রুপ পুতিয়া গ্রুপের মো. জলিলকে কুপিয়ে জখম করে। অনেক বাংলাদেশি সালমান শাহ গ্রুপের সদস্যদের আশ্রয় দেয়। পুলিশও তাদের কিছু বলে না।
রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, অনেকেই (রোহিঙ্গা) এ গ্রুপের ভয়ে ক্যাম্পছাড়া হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় সালমান শাহ বাহিনীর তাণ্ডব
নয়াপাড়া-১নং ক্যাম্পের সামনে বসবাস করেন আজাদ আবুল কালাম (ছদ্মনাম)। স্থানীয় এ বাংলাদেশি প্রায়ই সালমান শাহ বাহিনীর নৃশংসতা ও তাণ্ডব সরাসরি দেখেছেন।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘তারা তো সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ। অপহরণই তাদের প্রধান কাজ। এটা এখন তাদের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আজ একে, তো কাল আরেকজনকে…। তাদের টার্গেট এখন স্থানীয়রা (বাংলাদেশি)। কারণ, অপহরণ করতে পারলে মেলে লাখ লাখ টাকা। রোহিঙ্গাদের ওপরও নির্যাতন চালায় তারা।
কাদের প্রশ্রয়ে চলে তারা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই তাদের প্রশ্রয় দেয়। বিশেষ করে ক্যাম্প পুলিশ, টেকনাফ থানা পুলিশ। র্যাব ও বিজিবির সঙ্গেও তাদের সখ্যতা দেখা যায়। এ কারণে ক্যাম্পের ভেতরে প্রকাশ্যে নির্যাতন চালালেও ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস দেখান না।’
‘কয়েক দিন আগেও মুসুনি গ্রামের মুনতাজের ছেলে সাইফুলকে অপহরণ করে দুই লাখ টাকা আদায় করে এ গ্রুপের সদস্যরা। ইলিয়াস নামের স্থানীয় এক গাড়ির ব্যবসায়ীকেও অপহরণ করে। নির্মম নির্যাতন চালায় তার ওপর। পরে দেড় লাখ টাকা দিয়ে মুক্তি মেলে তার। কেউ তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করে না। কারণ, কথা বললেই ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়। মাজায় অস্ত্র নিয়ে ঘুরলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কিছু বলে না।’
সালমান শাহ বাহিনীর নেপথ্যে যারা
রোহিঙ্গা এ সন্ত্রাসী গ্রুপের নেপথ্যে রয়েছেন সালমান শাহ ওরফে শহীদুল ইসলাম। নাশকতা ও তাণ্ডবের অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে তাকে রামদা ও ইয়াবাসহ আটক করে এপিবিএন। এখন নেতা হিসেবে একেকজনের নাম আসছে। যে যার মতো করে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে সালমান শাহ গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন কামাল নামের এক রোহিঙ্গা। তাকে সবাই ‘ডাকাত কামাল’ বা ‘মাস্টার কামাল’ নামেও চেনেন। তিনি সন্ত্রাসী সংগঠন আল-ইয়াকিনের সক্রিয় সদস্য ডাকাত নুরুলের ভাই। এছাড়া রোহিঙ্গা বুলু ও আব্দুন্নবী রয়েছেন এ গ্রুপের নেতৃত্বে। তাদের নির্দেশেই কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অপহরণ, নির্যাতন ও ইয়াবার ব্যবসা চলে।
ভয়ে ক্যাম্প ছেড়েছেন অনেকে
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় টেকনাফের মুসুনি ক্যাম্পের দুই রোহিঙ্গা কিশোরের সঙ্গে। সালমান শাহ বাহিনীর ভয়ে তারা ক্যাম্প ছেড়ে বর্তমানে টেকনাফে অবস্থান করছেন। একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন তারা। ঢাকা পোস্টকে তারা বলেন, আগে ক্যাম্পে থাকতাম। এখন টেকনাফের যে হোটেলে কাজ করি সেখানেই থাকি। সালমান শাহ গ্রুপের সবাই আমাদের মতো পোলাপান (কিশোর)। ওরা খুবই খারাপ। ক্যাম্পে সবসময় মারামারি-কাটাকাটি হয়। তারা প্রায়ই আমাদের মারধর করত। খারাপ কাজ করাত। না করলে শাস্তি দিত। তাই সেখান থেকে পালিয়ে চলে আসি।
তাদের একজন বলেন, রোহিঙ্গা হিসেবেও আমাকে ছাড় দেয়নি তারা। টাকার জন্য আমাকে আটকে রাখে। পরে মা তাদের ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনে। ওরা টাকার জন্য কাউকে ছাড় দেয় না।
যা বললেন সালমান শাহ গ্রুপের সদস্য
টেকনাফের নয়াপাড়া-১নং ক্যাম্পে সালমান শাহ গ্রুপের এক সদস্যের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। নাম শাওকাত মোহাম্মদ। গ্রুপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একসময় এটি খুব শক্তিশালী ছিল। টাকা নিয়ে মানুষকে খুন করত, অপহরণও করত। ২০২০ সালে সালমান শাহকে গ্রেফতারের পর এ গ্রুপের কোনো সদস্য এখন ক্যাম্পে নেই।
আপনিও এ গ্রুপের সদস্য— এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। ‘না’, সালমান শাহ গ্রুপের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই— সাফ জানিয়ে দেন শাওকাত মোহাম্মদ। তবে, ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা এবং ক্যাম্প-সংলগ্ন বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে তিনি সালমান শাহ গ্রুপের সক্রিয় সদস্য।
সালমান শাহ গ্রুপের কোনো অস্তিত্ব নেই, দাবি পুলিশের
বিভিন্ন অপরাধে সালমান শাহ গ্রুপের সদস্যদের নিয়মিত গ্রেফতার করা হলেও সংগঠনটির অস্তিত্ব অস্বীকার করেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এমন কোনো সংগঠন নেই। তারপরও আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’
এআর/জেইউ/এমএআর/ওএফ