‘অদৃশ্য কারণে’ আটকে আছে ড্যাপ
রাজধানী ঢাকার সমস্যাগুলো কমিয়ে পরিকল্পিত শহর গড়ার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) তৈরির কাজ হাতে নেয়। গত জুন মাসে সংশোধিত ড্যাপের গেজেট প্রকাশের কথা থাকলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে তা আটকে আছে।
জানা গেছে, রাজউক ড্যাপের উন্নয়নের নানা প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। নতুন ড্যাপের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০ বছর। এটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমবে এবং নাগরিক সেবার মান বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
রাজউকের উদ্যোগে প্রণীত নতুন ড্যাপে থাকছে ভূমি পুনর্বিন্যাস, উন্নয়নস্বত্ব, প্রতিস্থাপন পন্থা, ভূমি পুনঃউন্নয়ন, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, উন্নতিসাধন ফি, স্কুল জোনিং ও ডেনসিটি জোনিং। ওয়ার্ডভিত্তিক জনঘনত্বের বিষয়ে দিকনির্দেশনাও থাকবে সংশোধিত ড্যাপে। এছাড়া সড়ক, উন্মুক্ত স্থান এবং পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্যুয়ারেজসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা সরবরাহের সামর্থ্য বিবেচনায় নতুন ভবনের উচ্চতা নির্ধারণে কাজ করছে রাজউক।
রাজউকের উদ্যোগে প্রণীত নতুন ড্যাপে থাকছে ভূমি পুনর্বিন্যাস, উন্নয়নস্বত্ব, প্রতিস্থাপন পন্থা, ভূমি পুনঃউন্নয়ন, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, উন্নতিসাধন ফি, স্কুল জোনিং ও ডেনসিটি জোনিং। ওয়ার্ডভিত্তিক জনঘনত্বের বিষয়ে দিকনির্দেশনাও থাকবে সংশোধিত ড্যাপে। এছাড়া সড়ক, উন্মুক্ত স্থান এবং পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্যুয়ারেজসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা সরবরাহের সামর্থ্য বিবেচনায় নতুন ভবনের উচ্চতা নির্ধারণে কাজ করছে রাজউক
প্রস্তাবিত ড্যাপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজউকের অন্তর্ভুক্ত এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে মোট ৪৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। পরে জরিপ করে প্রতিটি ব্লকের জনসংখ্যার ধারণক্ষমতা, সড়ক অবকাঠামো, নাগরিক সুবিধা এবং সেখানে উন্নয়নের ধরনের ওপর ভিত্তি করে আবাসিক ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সেখানে ঢাকাসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার দুই হাজার ১৯৮ কিলোমিটার জলাধার সিএস রেকর্ড অনুযায়ী উদ্ধার করে সচলের সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে এসব এলাকাকে বিনোদন স্পটে পরিণত করারও সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
ঢাকার চারপাশের ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথ সচল করা এবং এক হাজার ২৩৩ কিলোমিটার সড়ককে হাঁটার উপযোগী করার কথা বলা হয়েছে। শহরের বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে স্কুলভিত্তিক উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সড়ক, জল ও রেলপথকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত যোগাযোগ মাধ্যম গড়ে তুলতেও সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, দুই একর পর্যন্ত (শূন্য দশমিক ৬৬ থেকে দুই একর) ব্লকের (জমি) ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ জায়গা ছেড়ে দিলে (পার্ক, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থানের জন্য) ১০ তলা উঁচু আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। দুই থেকে পাঁচ একর ব্লকের ৫০ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান হিসেবে ছেড়ে দিলে ১৫ তলা এবং পাঁচ একরের বেশি ব্লকের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত স্থান হিসেবে ছেড়ে দিলে যত খুশি তত উঁচু আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের উচ্চতা সীমার ছাড়পত্রের প্রয়োজন হবে। এখানেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকার চারপাশের ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথ সচল করা এবং এক হাজার ২৩৩ কিলোমিটার সড়ককে হাঁটার উপযোগী করার কথা বলা হয়েছে। শহরের বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে স্কুলভিত্তিক উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সড়ক, জল ও রেলপথকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত যোগাযোগ মাধ্যম গড়ে তুলতেও সুপারিশ করা হয়েছে
এলাকাভেদে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণের বিষয়টি ড্যাপে উল্লেখ থাকায় আবাসন কোম্পানিগুলো ড্যাপের এমন প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে।
প্রস্তাবিত ড্যাপে মিরপুরে ৪-৭ তলা, মোহাম্মদপুর ও লালমাটিয়ায় ৫-৮ তলা, খিলক্ষেত, কুড়িল ও নিকুঞ্জ এলাকায় ৬ তলা, উত্তরায় ৭-৮ তলা, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় ৬-৮ তলা এবং পুরান ঢাকায় ৪-৬ তলা আবাসিক ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি অনুমোদন পেলে আবাসন, রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো বহুতল ভবনের অনুমোদন পাবেন না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোম্পানিগুলো। যে কারণে তারা ড্যাপের অনুমোদন আটকে দিয়ে একটি রিভিউ আবেদন দিয়েছে ড্যাপ সম্পর্কিত কেবিনেট কমিটির কাছে। পাশাপাশি আরও বেশকিছু সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ড্যাপকে আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
কোনো চাপের কারণে সংশোধিত ড্যাপের প্রস্তাবনা আটকে আছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ড্যাপ পরিচালক আশরাফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চাপ নেই। তবে তারা (আবাসন কোম্পানি) দাবি পেশ করেছে মন্ত্রণালয়ে। আবেদন দিয়েছে প্রস্তাবিত ড্যাপে যে হাইট জোনিং বিষয়টি আছে তা রিভিউ করতে। আমরা একটা অ্যানালাইসিস করেছি। কোন ওয়ার্ডে, কোন এলাকায় কত রাস্তাঘাট আছে, তার ওয়ার্কিং পেপার আমরা প্রস্তুত করেছি। এটি ড্যাপ সংক্রান্ত কেবিনেট কমিটিতে দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে আবাসন কোম্পানির পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাব এসেছে সেগুলোও আমারা সেখানে উপস্থাপন করব।
দুই একর পর্যন্ত (শূন্য দশমিক ৬৬ থেকে দুই একর) ব্লকের (জমি) ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ জায়গা ছেড়ে দিলে (পার্ক, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থানের জন্য) ১০ তলা উঁচু আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। দুই থেকে পাঁচ একর ব্লকের ৫০ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান হিসেবে ছেড়ে দিলে ১৫ তলা এবং পাঁচ একরের বেশি ব্লকের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত স্থান হিসেবে ছেড়ে দিলে যত খুশি তত উঁচু আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের উচ্চতা সীমার ছাড়পত্রের প্রয়োজন হবে
‘এটি রিসেন্টলি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু করোনাকাল বা লকডাউনের কারণে কিছুটা পিছিয়ে গেছে। অনলাইন বা ভার্চুয়াল সভা করে তো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। মাঝখানে একটি ডেটও নির্ধারণ করা হয়েছিল কিন্তু সেসময় হয়নি। আমাদের টার্গেট আছে এবারের লকডাউন খুললে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ড্যাপ চূড়ান্ত হওয়ার সময়সীমা পার হয়ে গেছে। এখন যে বাধা আছে তা হলো নগর এলাকাতে ভবনের উচ্চতা নিয়ে। বিষয়টি মানতে চাচ্ছে না অনেকে। পরিকল্পনার জায়গাটা এক রকমের, আর আবাসন নির্মাণ কোম্পানির পরিকল্পনা অন্য রকমের। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। এখানে আবাসন কোম্পানি যদি পরিকল্পনায় প্রভাব বিস্তার করে সেটি হবে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ (স্বার্থের দ্বন্দ্ব)।
‘আমাদের দেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ের প্লটগুলো বহুতল ভবন হিসেবে তৈরির একধরনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অবকাঠামোসহ নাগরিক সুবিধার বিপরীতে জনসংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, এবারের ড্যাপে জনঘনত্বের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেখানে হাইট জোনিং (উচ্চতা বিবেচনায় অঞ্চলবিভাজন) বিষয়টি ছিল। কিন্তু আবাসন কোম্পানি, পেশাজীবীদের কাছে এটি খুবই অপছন্দের। ইতোমধ্যে আমাদের যে জনসংখ্যা তা ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি। এ অবস্থায় যদি আমরা আরও বহুতল ভবন করতে চাই বিশেষ করে ছোট ছোট প্লটে, সেক্ষেত্রে নাগরিক সুবিধা বাস্তবায়ন করা যাবে না।
‘এ অবস্থায় এসে আবাসন, রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো নাগরিক সুবিধার কথা না ভেবে বাণিজ্যিক বিষয়ের ওপর বেশি তৎপরতা দেখাচ্ছে। তাদের বুঝতে হবে যে, ঢাকার যেকোনো প্রান্তে যদি শহরটিকে সম্প্রসারিত করে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয় এবং ব্লক বেজড হয় সেখানেও কিন্তু আবাসন কোম্পানির ভালো ব্যবসার সুযোগ থাকে।’
বিশিষ্ট এ নগর পরিকল্পনাবিদের মতে, যেভাবে জনকল্যাণ হবে সেভাবেই ড্যাপকে বাস্তবায়ন করা উচিত। সেক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত হবে না। ড্যাপকে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে যে, কারও দাবির মুখে যেন নাগরিক সুবিধার পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত না হয়।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, আবাসন ব্যবসায়ীরা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে প্রস্তাবিত ড্যাপের বিরোধিতা করছে। যে কারণে ড্যাপ পাস হওয়ার আগেই ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও নকশার অনুমোদনের জন্য প্রচুর আবেদন পড়ছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজউকের আটটি অঞ্চলে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্রের জন্য মোট ছয় হাজার ৭৬০টি নকশা জমা পড়ে। এর মধ্যে চার হাজার ৯৩টি আবেদনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন পড়েছে নয় হাজার ৯২১টি। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ৯২১টির অনুমোদন দিয়েছে রাজউক।
গত মার্চ মাসে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ড্যাপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন (রিহ্যাব) ও বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি সভা করেন। সভায় তিনি জানান, ড্যাপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রিহ্যাব ও বিএলডিএ’র প্রস্তাবিত মতামত ও সুপারিশসমূহ পর্যালোচনার জন্য একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বিভিন্ন সময়ে ঢাকা নগরীতে অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অপরিকল্পিত অবকাঠামো যাতে নির্মাণ না হয় সেজন্য ড্যাপ বাস্তবায়ন জরুরি। যেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের সুযোগ রয়েছে সেখানে তা নির্মাণ হবে। যেখানে সব নাগরিক সেবা দেওয়া সম্ভব নয় সেখানে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না। মানুষ যদি চলাচলের জন্য রাস্তা না পায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ না থাকে, ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলার মাঠসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না থাকে তাহলে সেখানে বড় বড় বিল্ডিং করা ঠিক হবে না। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জানা গেছে, এবারই প্রথম ড্যাপের খসড়া বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাতেই এটি গেজেটভুক্ত হবে। বাংলাতে এর খসড়া প্রকাশ করায় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ সহজে মতামত ব্যক্ত করতে পেরেছেন। সবার মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে খসড়া ড্যাপের বিজ্ঞানভিত্তিক ও যৌক্তিক কিছু সংশোধন আনা হয়েছে।
পাঁচ বছর মেয়াদি ড্যাপের মাস্টার প্ল্যান প্রথম প্রণয়ন হয়েছিল ২০১০ সালে। ২০১৫ সালে প্রথম ড্যাপের মেয়াদকাল শেষ হয়। বর্তমানে সময় বৃদ্ধি করে নগর উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে রাজউক। সংশোধিত নতুন ড্যাপের মেয়াদ হবে ২০ বছর।
এএসএস/এমএআর/