ভারতে আটক বাংলাদেশি নারীর আর্তনাদ
দেশে ফিরতে চাই, আমাকে বাঁচান
তৃষ্ণা (ছদ্ম নাম)। নড়াইলের বাঁশগ্রামে বাড়ি হলেও বেড়ে ওঠা সাভারে। বাবা-মার বিবাহ বিচ্ছেদের পর মায়ের কাছেই বড় হন তিনি। ভালো ছেলে পাওয়ায় অল্প বয়সে বিয়ে হয় তৃষ্ণার। স্বামীর বাড়ি যশোর সদর উপজেলার দোগাছিয়া গ্রামে। স্বামী ও এক মেয়ে নিয়ে সুন্দর সময় পার করছিলেন তিনি। মেয়ের জন্মের ছয় মাসের মাথায় চাকরির জন্য মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান তৃষ্ণার স্বামী।
স্বামী বিদেশে যাওয়ায় কিছুটা একাকীত্ব বোধ হলেও মেয়েকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে হাসিখুশি সময় পার হচ্ছিল তৃষ্ণার। কিন্তু সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জোছনা নামের এক মানবপাচারকারীর ফাঁদে পড়ে তৃষ্ণার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।
বিজ্ঞাপন
গত দেড় বছর ধরে ভারতের গুজরাটের ‘নারী সুরক্ষা’ নামের একটি অনাথ আশ্রমে বন্দি তৃষ্ণা। দেশে ফেরার আকুতিতে বুক ফাটে সেখানে। কিন্তু সেই আকুতি শোনার কেউ নেই। দেশ থেকে কেউ ফোন দিলেই ফেরার আকুতি জানাতে জানাতে গলা শুকিয়ে যায় তৃষ্ণার। গত দেড় বছর ধরে কেউই তাকে এ নরক যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করতে পারেনি।
তুই যেই রুমে থাকছিস সেখানে অনেক মেয়েকে প্রতি রাতে লোকজনের সঙ্গে শুইতে হইছে। কাল থেকে তকেও একই কাজ করতে হবে
অনাথ আশ্রমে বন্দি তৃষ্ণার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের। জীবনের চরম দুঃখ-দুর্দশার কথা জানান তিনি। দেশ থেকে পাচারকারীরা কীভাবে তাকে ভারতে নিয়ে যায় এবং বর্তমানে কীভাবে তার দিন কাটছে— তা নিয়েও বিস্তারিত কথা বলেন তৃষ্ণা।
যেভাবে নারী পাচারকারী চক্রের খপ্পরে তৃষ্ণা
২০১৬ সালে পারিবারিকভাবে তৃষ্ণার বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পরই মেয়ে সন্তানের জন্ম। তার ছয় মাস পর (২০১৭) স্বামী চাকরির জন্য মালয়েশিয়ায় যান। তখনও মেয়েকে নিয়ে সুখে দিন কাটছিল তার। তবে সেই সুখের মাঝে আঁধার নামিয়ে দিল যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার নাভারণের বাসিন্দা জোছনা (৪০)। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি কোনো এক সময় তৃষ্ণাকে ফোন করেন জোছনা।
তৃষ্ণা বলেন, ওই ফোন কলই আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ফোনে কথা হওয়ার পর জোছনার সঙ্গে আমার পরিচয়, এরপর বন্ধুত্ব। সে প্রায়ই আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলত, বড় বোনের মতো খোঁজ-খবর নিত। ধীরে ধীরে জোছনাকে আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে থাকি। একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি সে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য।
জোছনা ফোনে বলছিল, ‘মাল আচ্ছা হে। এক লাখ রুপিয়াসে কম নাহি হোগি।’ তখন আমি নিশ্চিত হই তারা আমকে গুজরাটে বিক্রি করে চলে যাবে
সম্পর্কের জের ধরে সে মাঝেমধ্যে শ্বশুর বাড়ি এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যেত। বলত, আমাকে ভারতে ঘুরতে নিয়ে যাবে। তখন আমি বুঝতে পারিনি, সে আমাকে কেন বারবার ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলত।
বন্ধু সেজে তৃষ্ণাকে যেভাবে ভারতে পাচার করে জোছনা
তৃষ্ণা বলেন, দীর্ঘদিন পরিচয়ের সুবাদে জোছনা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার বাড়িতে আমাকে নিয়ে যায়। পূর্বপরিচিত হওয়ায় আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন ও স্বামী বাঁধা দেননি। যাওয়ার সময় মেয়েকে শাশুড়ির কাছে রেখে যাই। জোছনার বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে তার আচরণ আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়। সে সারাক্ষণ কার সঙ্গে যেন আমাকে নিয়ে ফোনে কথা বলত। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করতাম আমার বিষয়ে কার সঙ্গে সে এত কথা বলে; তখন সে বলত কিছু না। ‘আমার ভারতের এক বন্ধুকে বলেছি, তুই আমার বাড়ি বেড়াতে এসেছিস’। এর কিছুদিন পরই সে আমাকে ভারতে যেতে চাপ দেয়।
সে (জোছনা) আমাকে বলে, ‘তর স্বামী যেহেতু বিদেশ থাকে তুই দেশে থেকে কী করবি, আমার সঙ্গে ভারতে চল। সেখানে পার্লারের কাজ করে টাকা কামাবি। তর স্বামী দেশে আসলে তুইও দেশে চলে আসবি। আমিও তর সঙ্গে কাজ করব।’ জোছনার এ কথা শুনে আমার সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। আমি তখন তাকে বলি, ‘আমার সংসার আছে, একটা বাচ্চা আছে। আমি কেন চোরাই পথে ভারতে যাব? তুমি আমাকে দ্রুত বাড়ি দিয়ে আস। না হয় আমি একা একাই চলে যাব।’ তখন সে আমাকে বলে, ‘আচ্ছা, রাগ করিস না। আগামীকাল সকালে দিয়ে আসব।’
ঠিক ওইদিন রাতেই কোকের (কোমল পানীয়) সঙ্গে আমাকে কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে যশোর সীমান্তে নিয়ে যায় জোছনা। জ্ঞান ফেরার পর দেখি, আমিনুর নামের একটা ছেলে কাঁধে করে আমাকে সীমান্ত পার করাচ্ছে। সঙ্গে ছিল জোছনা। আমি তখন তাকে (জোছনা) বলি, ‘আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমাকে বাড়ি দিয়ে আস।’ তখন সে বলে, ‘একদম কথা বলবি না। কথা বললে মেরে ফেলব। আমারা ভারতে যাচ্ছি।’ জোছনার ওই কথা শুনে আমি ভয়ে চুপ হয়ে যাই। পরে আমিনুর আমাকে আর জোছনাকে সীমান্ত পার করে দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে।
সীমান্ত থেকে কলকাতায় তৃষ্ণা
সীমান্ত পার হতে হতে সকাল হয়ে যায় তৃষ্ণাদের। সকালে সীমান্তের ভারতীয় অংশ থেকে একটি অটোরিকশায় করে তৃষ্ণাকে নিয়ে কলকাতার বনগাঁও বাস স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হয় জোছনা। সেই অটোরিকশায় তৃষ্ণা আর জোছনা ছাড়া আর কেউ ছিল না। তবে জোছনা ও চালকের কথা শুনে তৃষ্ণা বুঝতে পারে তারা পূর্বপরিচিত। বনগাঁও নেওয়ার সময় জোছনাকে তৃষ্ণা আবারও জিজ্ঞাসা করে, তাকে কোথায় নেওয়া হচ্ছে? তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য জোছনার কাছে আকুতি জানায় তৃষ্ণা। কিন্তু জোছনা বলে, এখন দেশে যাওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য সে পার্লারে চাকরি ঠিক করেছে।
তৃষ্ণা আরও জানায়, সীমান্ত থেকে বনগাঁও বাস স্টেশনে আসতে তাদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। পরে বনগাঁও বাস স্টেশনের পাশে একটি বাসায় তাকে নিয়ে ওঠে জোছনা। বাসাটি দুই কক্ষের ছিল। সঙ্গে ছিল একটি রান্না ঘর, ড্রয়িং ও ডাইনিং। প্রতিটি ঘরের সঙ্গে একটি করে ওয়াশরুম। সেখানে আগে থেকেই আনুমানিক ৩৫ বছরের এক যুবক ছিল। সে জোছনার পূর্বপরিচিত। বাসায় যেতে তাদের রাত হয়ে যায়। বাসায় গিয়ে জোছনা ফোনে একজনকে বলে, ‘বাংলাদেশ থেকে আচ্ছা এক মাল লেকে আইহো’। এ কথা শুনে তৃষ্ণা প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে জোছনা তাকে অসামাজিক কাজ করানোর জন্য ভারতে নিয়ে এসেছে।
কলকাতায় যেভাবে রাত কাটে তৃষ্ণার
তৃষ্ণা বলেন, কলকাতার বাসার ওই যুবক নারী পাচারকারী চক্রের ভারতীয় সদস্য। সেই রাতে তারা আমাকে বলে, বিউটি পার্লারের কাজের জন্য নয়, আমাকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করাবে। আমি রাজি কি না, তারা জানতে চায়। আমি না বলে তাদের হাতে-পায়ে ধরে কান্না করতে থাকি। দেশে যেতে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকি। তখন আমাকে জোছনা বলে, ‘আমার কথা না শুনলে তর রক্ষা নাই। তর মতো অনেক মেয়েকে দেশ থেকে এনেছি এবং কাজে লাগিয়েছি। তকেও লাগাব।’ সে আরও বলে, ‘তুই যেই রুমে থাকছিস সেখানে অনেক মেয়েকে প্রতি রাতে লোকজনের সঙ্গে শুইতে হইছে। কাল থেকে তকেও একই কাজ করতে হবে।’
কিন্তু আমি যখন জোছনাকে বলি, ‘দরকার হলে আত্মহত্যা করব কিন্তু এ কাজ করব না।’ তখন তারা বুঝতে পারে আমাকে দিয়ে এ কাজ করানো যাবে না। এ সময় ওই লোকটিকে জোছনা বলে, ‘একে এখানে রাখা যাবে না। সমস্যা করতে পারে। দূরে কোথাও নিয়ে যেতে হবে।’
কলকাতা থেকে তৃষ্ণাকে নেওয়া হয় গুজরাট
তৃষ্ণা বলেন, কলকাতার বাসায় এক রাত থেকে পরের দিন আমাকে নিয়ে শিয়ালদা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে করে গুজরাটের সুরাট শহরে উদ্দেশে রওনা হয় জোছনা আর ওই যুবক। সুরাট যেতে কত সময় লেগেছে আমি বলতে পারব না। কারণ অধিকাংশ সময় আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আমাকে মনে হয় সেদিনও পানির সঙ্গে কিছু মিশিয়ে খাইয়েছে তারা। সুরাটে পৌঁছানোর পর আমাকে নিয়ে একটি বাসায় ওঠে। সেই রাতে তারা দুজন কারও সঙ্গে ফোনে আমাকে বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলছিল। জোছনা ফোনে বলছিল, ‘মাল আচ্ছা হে। এক লাখ রুপিয়াসে কম নাহি হোগি।’ তখন আমি নিশ্চিত হই তারা আমকে গুজরাটে বিক্রি করে চলে যাবে। তখন আমি আল্লাহকে ডাকতে থাকি, হে আল্লাহ এ বিপদ থেকে তুমি আমাকে রক্ষা কর। ওই রাতে জোছনা আর ওই যুবক এক কক্ষে, আমি বাসার অন্য কক্ষে ছিলাম। সারারাত চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেই, এদের কাছ থেকে বাঁচতে হলে আমাকে যেভাবে হোক পালাতে হবে।
বন্দিদশা থেকে যেভাবে পালান তৃষ্ণা
পরের দিন সকালে আমি জোছনাকে বলি, ‘তোমরা যা বল আমি তাই করব।’ আমার এ কথা শুনে জোছনা খুব খুশি হয়। তখন সে বলে, ‘আমাদের কথা মতো চললে তুই যা চাস তাই পাবি।’ আমি তাকে বলি, ‘এখন তেমন কিছু লাগবে না। আপাতত তুমি কিছু কাপড় কিনে দাও আমাকে।’ তখন সে আমাকে ওইদিন বিকেলে একটা মার্কেটে কাপড় কিনতে নিয়ে যায়। আর সুযোগ বুঝে সেখান থেকে আমি পালিয়ে যাই।
পালানোর পর স্বামীকে প্রথম ফোন দেন তৃষ্ণা
জোছনার কাছ থেকে পালিয়ে আমি সুরাট রেলওয়ে স্টেশনে চলে আসি। আমি নিজেও অল্প অল্প হিন্দি ভাষা জানতাম। আমি তখন স্টেশনে থাকা একটা লোককে আমার সমস্যার কথা জানাই এবং তার ফোন দিয়ে দেশে কথা বলব বলে অনুরোধ করি। তখন সেই লোকটি আমাকে তার ফোন দেয়। বাংলাদেশ থেকে আনা আমার ফোন থেকে স্বামীর নম্বর বের করে মালয়েশিয়ায় ফোন দেই। পরে দেশে থাকা আমার এক খালাকে ফোন দেই। তারা দুজনই আমাকে পরামর্শ দেয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তাদের কথা মতো সুরাট রেলওয়ে স্টেশনের পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে সবকিছু খুলে বলি। তখন তারা আমার জবানবন্দি একটা খাতায় লেখে। পরে আমাকে গুজরাটের কালা মন্দির রোডের পাশে ‘নারী সুরক্ষা’ নামে একটি অনাথ আশ্রমে রেখে আসে। যাওয়ার সময় তারা বলে যায়, দুই মাসের ভেতর আমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। তাদের কথা শুনে আমি আশ্বস্ত হই। কিন্তু মাস পেরিয়ে বছর এলেও আমার দেশে যাওয়া হলো না। দেড় বছর ধরে এ অনাথ আশ্রমে আমি বন্দি।
গুজরাটের অনাথ আশ্রমে যেভাবে দিন কাটে তৃষ্ণার
তৃষ্ণা বলেন, এখানে বন্দি হওয়ার পর মা দেশ থেকে আমাকে নিতে এসেছিলেন। কিন্তু আশ্রম কর্তৃপক্ষ মাকে বলে যে, পুলিশের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া তারা আমাকে দিতে পারবে না। পরে মা পুলিশের কাছে গেলে তারা বলে, ভারতে থাকা বাংলাদেশের হাই কমিশন প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা না করলে তারা কোনো ক্লিয়ারেন্স দিতে পারবে না। এরপর মা আমার সঙ্গে দেখা করে দেশে চলে যায়। যাওয়ার সময় মা বলে, দেশে গিয়ে দ্রুত আমাকে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এরপর দেড় বছর পার হয়ে গেল, আমি এখানেই বন্দি।
এটি জেলখানা বললে ভুল হবে না। কতদিন হলো কলিজার টুকরা মেয়েকেও দেখতে পাই না। মাসে শুধু দুবার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই।
তিনি বলেন, ছোট একটি রুমে চারজন মেয়ের সঙ্গে কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে। নিজের ভাষায় কথা বলতে পারি না। খাবারও ঠিক মতো দেয় না। প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি, এই বুঝি দেশ থেকে কাগজ এলো, আমি মুক্ত হয়ে যাব। দিন-রাত, মাস যায় কিন্তু আমাকে নিতে কেউ আসে না। আমার সামনেই কত ভারতীয় ও নেপালি মেয়ে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে গেছে। অথচ, এখানে শুধু আমি আর কক্সবাজার থেকে আমার মতো পাচার হয়ে আসা আরেকটি মেয়ে আছে। আমাদের কেউ নিতে আসে না।
মাঝে-মধ্যে মনে হয় আত্মহত্যা করি। কিন্তু আবার আশায় বুক বাঁধি, স্বামী আর মা হয়তো আমাকে একদিন ঠিকই দেশে নিয়ে যাবে। দেশে গিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরব। তবে সেই আশা আশাই রয়ে গেল। এখান থেকে মুক্তির কোনো পথ মিলছে না।
তৃষ্ণার মা যা বললেন
তৃষ্ণার মার সঙ্গেও কথা হয় ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, আমার একমাত্র মেয়ে। ভারতে পাচার হওয়ার খবর জানার পরপরই আমি ভিসা লাগিয়ে গত মার্চে তাকে আনতে যাই। সেখানে ভারতীয় পুলিশ বলে, বাংলাদেশ সরকার ভারতে প্রত্যাবাসনের কাগজ না পাঠালে তারা মেয়েকে দিতে পারবে না। পরে দেশে এসে গত দেড় বছর ধরে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঘুরছি। কিন্তু তারা কিছুই করছে না। আমি গরিব অসহায়। মেয়কে ফিরে পেতে এখন পর্যন্ত লাখ টাকা খরচ করেছি। এখন সরকার যদি সাহায্য না করে মেয়েকে আর ফিরে পাওয়া হবে না।
মেয়েটা (তৃষ্ণা) ফোন করলেই বলে, ‘আম্মু, তুমি আমাকে নিয়ে যাও। নাহলে কিন্তু আমি একদিন ঠিকই মরে যাব।’ আমার নাতনিটা দেড় বছর ধরে মাকে দেখে না। কী কষ্টে দিন কাটছে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।’
পাচারকারী জোছনার বিরুদ্ধে আইনি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি না— জানতে চাইলে তৃষ্ণার মা বলেন, জোছনা স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ভারতে নারীপাচার করে। তার বিরুদ্ধে আমার মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন মামলা করতে ভয় পায়। স্থানীয় থানায় জিডি করেছে আমার মেয়ের শাশুড়ি। মেয়েকে দেশে আনতে পারলে আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করব। কিন্তু এখন যদি মামলা করি জোছনা আমার মেয়েকে আর দেশে আসতে দেবে না। ভারতেও তার অনেক লোক আছে।
সম্প্রতি ভারতে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত এমন কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দেশ থেকে হাজারের বেশি নারী ও উঠতি বয়সী কিশোরী-তরুণীকে ভারতে পাচার করা হয়েছে— এমন তথ্যও এসেছে গোয়েন্দাদের হাতে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অভিযান অব্যাহত আছে।
যেভাবে ভারতে আটক নাগরিকদের দেশে আনা হয়
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তি হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের জেলে আটক নাগরিকদের স্ব স্ব দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশি কোনো নাগরিক ভারতে জেলে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আটক থাকলে এ চুক্তির আওতায় তাকে দেশে আনা যাবে। এজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে আটক ব্যক্তির পক্ষ থেকে।
ভারতীয় জেলে আটক কোনো বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমে আবেদন করতে হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি আসবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে বিষয়টি পাঠানো হবে। সেখান থেকে বাংলাদেশের দূতাবাস ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবে নির্দিষ্ট নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। পরবর্তীতে ওই দেশের (ভারতীয়) সরকারের অনুমোদন-সাপেক্ষে জেলে আটক বাংলাদেশি নাগরিককে তারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে
ওই দুই মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করবে। পরে চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী ভারতীয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শেষ করে সেই দেশের সরকারের অনুমোদন-সাপেক্ষে আটক অথবা সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশ আনা যাবে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারতীয় জেলে আটক কোনো বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমে আবেদন করতে হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি আসবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে বিষয়টি পাঠানো হবে। সেখান থেকে বাংলাদেশের দূতাবাস ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবে নির্দিষ্ট নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। পরবর্তীতে ওই দেশের (ভারতীয়) সরকারের অনুমোদন-সাপেক্ষে জেলে আটক বাংলাদেশি নাগরিককে তারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে। এভাবে ভারতের জেলে আটক অনেক বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তবে সবাইকে যে ফিরিয়ে আনা হবে, বিষয়টি তেমন নয়। আবেদন-সাপেক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে। বিচার-বিশ্লেষণের পর যাদের জন্য সুপারিশ করা হবে, কেবল তারাই দেশে ফিরে আসতে পারবেন। তবে, করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমানে এ প্রক্রিয়াগুলো বিলম্বিত হচ্ছে। দুই দেশের (ভারত ও বাংলাদেশ) করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে এ প্রক্রিয়া ফের শুরু হবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
এমএসি/এমএইচএস/এমএআর/