বড় ভূমিকম্পেও ভাঙবে না বাঁধ, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন
বর্তমান বিশ্বে বড় আতঙ্কের নাম ভূমিকম্প। বাংলাদেশও এ আতঙ্কের বাইরে নয়। ভূতাত্ত্বিক ও ভূমির গঠন অনুসারে বাংলাদেশ ভূকম্পনপ্রবণ অঞ্চল। বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে আটটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৬৯ সালে সিলেট অঞ্চলে রিখটার স্কেলে সর্বোচ্চ ৭.৬ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়। একই স্থানে গত ৩০ মে সকাল থেকে অন্তত পাঁচবার কম্পন হয়। ৭ জুন সন্ধ্যা ৬টা ২৯ ও ৬টা ৩০ মিনিটে আবারও দুই দফা ভূকম্পন হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত বড় কোনো ভূমিকম্পের আগে বা পরে এমন দফায় দফায় মৃদু কম্পন হতে পারে।
বাংলাদেশে যদি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়ক-মহাসড়কগুলো। যদিও আধুনিক যুগে সুউচ্চ ভবন কিংবা স্থাপত্য নির্মাণে ভূমিকম্প সহনশীল প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু দেশের সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের বিষয়টি এখনও অবহেলিত।
বিজ্ঞাপন
এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প সহনশীল সড়ক বা মহাসড়ক নির্মাণে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারি এবং তার ছাত্র প্রকৌশলী রিপন হোড়ের সমন্বয়ে গঠিত গবেষক দল। ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছরের গবেষণায় উদ্ভাবিত ‘র্যাপ ফেস ইমব্যাংকমেন্ট (wrape face embankment)’ নামের নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে বাঁধ, সড়ক-মহাসড়ক কিংবা রেললাইন বড় মাত্রার ভূমিকম্পেও অক্ষত থাকবে। পাশাপাশি চলমান পদ্ধতিতে নির্মাণের তুলনায় আর্থিক ব্যয় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে আসবে। সবচেয়ে আশার কথা হলো, এ প্রযুক্তি অনেক কৃষিজমি বাঁচিয়ে দেবে। মূলত, আমাদের দেশে নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে দুই পাশের ব্যাপক কৃষিজমি নষ্ট হয়। ‘র্যাপ ফেস ইমব্যাংকমেন্ট’ প্রযুক্তি ব্যবহারে উঁচু বাঁধ বা রাস্তা নির্মাণে দুই পাশের জমির ব্যবহার অনেক কমে যাবে।
ইতোমধ্যে জাপান ও আমেরিকার শক্ত মাটিতে এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহারে সফলতা মিলেছে। তবে বাংলাদেশের মতো নরম মাটির দেশে এ প্রযুক্তি কার্যকর কি না, তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তবে রিপন-আনসারি উদ্ভাবিত প্রযুক্তি নরম মাটিতেও বেশ কার্যকর। ইতোমধ্যে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় তা প্রমাণিত হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, তাদের গবেষণার ফলাফলকে তিনটি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নালও স্বীকৃতি দিয়েছে। সেখানে তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। জার্নালগুলো হলো- জিওটেকনিক্যাল অ্যান্ড জিওলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব জিওসিন্থেটিকস অ্যান্ড গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও ট্রান্সপোর্টেশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার জিওটেকনোলজি।
র্যাপ ফেস ইমব্যাংকমেন্ট (Wrap face embankment) কী
র্যাপ ফেস ইমব্যাংকমেন্ট বা মোড়ানো বাঁধ হলো জিও টেক্সটাইল দিয়ে মোড়ানো খাড়া বাঁধ। মোড়ানো বাঁধটি বিভিন্ন জিও টেক্সটাইল দিয়ে প্যাঁচানো থাকে এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বালু দ্বারা পূর্ণ থাকে। বাঁধটি খাড়া হবার কারণে প্রচলিত বাঁধের তুলনায় দুপাশের কৃষিজমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন হয় না। বাঁধটি বানানোর সময় দুই ধরনের যথা ওভেন অথবা ননওভেন জিওটেক্সটাইল ব্যবহার করা হয়। মোড়ানো বাঁধটি মাটির গুণাবলির পারস্পারিক অবস্থা ও ইজিএল’র ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন লেয়ারের হয়ে থাকে।
সার্বিক বিষয়ে কথা হয় গবেষক দলের প্রধান ও বুয়েট অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারির সঙ্গে । ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, যদিও আমাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল অধিক মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল বাঁধ বা সড়ক নির্মাণ করা। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় আশার কথা হচ্ছে, এ প্রযুক্তি ব্যবহারে ব্যাপক হারে কৃষিজমি রক্ষা পাবে। সরকারকেও ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হবে না। যেমন- ১০ মিটার উঁচু ও ১০ মিটার প্রশস্ত একটি বাঁধ নির্মাণে দুই পাশে দিগুণ ঢাল তৈরি করতে হয়। একপাশে ২০ মিটার ও অন্যপাশে ২০ মিটার জমির প্রয়োজন হয়। সবমিলিয়ে ৫০ মিটার। অর্থাৎ সড়ক কিংবা বাঁধ নির্মাণে পাঁচগুণ জায়গা নষ্ট হয়। কিন্তু এ প্রযুক্তিতে কোনো ঢাল নির্মাণ করতে হয় না। সরাসরি উঁচু সড়ক হয়, তাই দুই পাশের জমি বেঁচে যায়।
বুয়েট অধ্যাপক আরও বলেন, বন্যায় সাধারণ বাঁধ ভেঙে যায় বা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এ প্রযুক্তিতে তৈরি করা বাঁধ নির্মাণে জিও টেক্সটাইল ও বালুর সমন্বয়ে বেশ মজবুত কাঠামো ব্যবহার করা হয়। তাই বন্যায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এছাড়া বর্তমানে জিও টেক্সটাইল বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। তাই এটি সহজলভ্য বলা যায়।
জিও টেক্সটাইল কী
জিও টেক্সটাইল প্রোডাক্ট মূলত পলিস্টার, পলিপ্রপিলিন, পলিঅ্যামাইড দিয়ে তৈরি হয়। জিও টেক’র সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সিভিল/কনস্ট্রাকশন কাজে। এতে মাটির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে দুর্বল ও অকার্যকর জায়গায় ভবন নির্মাণের উপযোগী করে তোলা হয়। আধুনিক সিভিল/কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে এ জিও টেক্সটাইল। জিও টেক্সটাইল সাধারণত মাটির বৈশিষ্ট্য উন্নয়নে যেমন- কোনো রাস্তা, বাঁধ, পাইপলাইন এবং মাটিতে বৃহৎ কোনো কাঠামো তৈরিতে ব্যবহার হয়।
বড় ধরনের ভূমিকম্পে আপনাদের এ প্রযুক্তি কতখানি কার্যকর— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভূমিকম্পের ফলে যে ঝাঁকুনি হয় তাকে আমরা তীব্রতা বা ইনটেনসিটি বলি। এ প্রযুক্তিতে নির্মাণ করা বাঁধ বা সড়ক ৭ থেকে ৮ তীব্রতার (ইনটেনসিটি) ভূমিকম্পেও অক্ষত থাকবে। সাধারণত যেকোনো মাত্রার ভূমিকম্পে সর্বোচ্চ তীব্রতা ধরা হয় ১২। সেখানে আমাদের গবেষণায় নির্মিত বাঁধ সর্বোচ্চ ৮ তীব্রতার ঝাঁকুনি নিতে সক্ষম। আমাদের ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম ঝাঁকুনি দিয়ে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অধ্যাপক আনসারি আরও বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায় নরম মাটির আধিক্য রয়েছে। আমাদের গবেষণায়ও নরম মাটি ব্যবহার করেছি। সেখানে আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে, নরম মাটিতে র্যাপ ফেস ইমব্যাংকমেন্ট প্রযুক্তি বেশ কার্যকর। ফলে নরম মাটির ওপর বাঁধ কিংবা রেললাইন নির্মাণে শক্ত ভিত তৈরিতে সরকারকে যে ব্যয় করতে হয়, ওটার আর প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ নরম মাটিতেও এ প্রযুক্তি বেশ কার্যকর বলতে পারি। যেমন- বর্তমানে পদ্মা সেতু প্রকল্পে রেললাইন স্থাপনে অধিকাংশ জায়গায় নরম মাটির কারণে প্রচুর টাকা খরচ করতে হচ্ছে সরকারকে। কারণ, নরম মাটিতে ভিত মজবুত করে তারপর স্থাপনা নির্মাণ করতে হয়। পায়রা বন্দরেও স্থাপনা নির্মাণে আমরা একই অবস্থা দেখেছি। এ প্রযুক্তি আমাদের বড় অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় করবে।
ব্যয়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলে অপর গবেষক প্রকৌশলী রিপন হোড় ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের দেশে অর্ধ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে চার কোটি তিন লাখ টাকার মতো অর্থ খরচ হয়। সেখানে র্যাপ ফেস ইমব্যাংকমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করলে খরচ হবে এক কোটি ৮৬ লাখ টাকার মতো। অর্থাৎ খরচ ৭০ শতাংশ কমে যাচ্ছে।’
রিপন হোড় বর্তমানে এলজিইডি’র প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ২০২০ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
রিপন আরও বলেন, “আমার গবেষণার মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশের নরম মাটিতে ‘র্যাপ ফেস ইমব্যাংকমেন্ট’ ভূমিকম্পে কেমন আচরণ করবে, তার বিশ্লেষণ করা। আমার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারি। ভূমিকম্পের সময় অবকাঠামোর নিচের মাটি কীভাবে আচরণ করবে যা নির্ণয় খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। এটা আমার গবেষণার বড় প্রাপ্তি। ভূমিকম্পের সময় অবকাঠামোর নিচের মাটির আচরণ আমার গবেষণায় উঠে এসেছে। এটা করার জন্য সেক টেবিল টেস্ট মেশিন ও সংখ্যাগত বিষয় যাচাই করতে প্লাসিক্স থ্রিডি অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তি যদি ব্যবহার করা যায় তাহলে তিনটা উদ্দেশ্য অর্জিত হবে। প্রথমত, সাধারণ নিয়মে রাস্তা নির্মাণে বড় পরিসরে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সরকারের আর্থিক ব্যয় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, সারাদেশে রাস্তা নির্মাণের জন্য ব্যাপক কৃষি জমি নষ্ট হয়। এটা থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে এবং সর্বশেষ, বাঁধটি ভূমিকম্প সহনশীল হবে। বাংলাদেশ সরকারের তিনটি সংস্থা- এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে।
আরএম/এমএআর/