শুধু রাজধানীতেই রয়েছে শতাধিক সিসা বার
সিসা সেবন যেন ভোজের শেষে ‘ডেজার্ট’!
রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন নামিদামি হোটেল-রেস্টুরেন্টে রয়েছে শতাধিক সিসা বার বা লাউঞ্জ। এর মধ্যে শুধু বনানী ও গুলশানে রয়েছে ৪০টির বেশি নিষিদ্ধ সিসা বার। এছাড়া ঢাকার বাইরে রয়েছে অর্ধশতাধিক বার। এসব সিসা বারে রঙিন নেশায় রাত কাটাচ্ছেন উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা।
যদিও এসব অবৈধ সিসা বারের তালিকা নেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) কাছে। সংস্থাটির কাছে মাত্র ২২-২৪টি সিসা বারের তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১৯টি এবং ঢাকার বাইরে রয়েছে ৪-৫টি বার।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, কলাবাগান, মিরপুর, বারিধারা, গুলশান, বনানী ও উত্তরায় শতাধিক অবৈধ সিসা বার রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও অর্ধশতাধিক বার আছে। নামিদামি হোটেল ও রেস্টুরেন্টের নাম ব্যবহার করে কিছু প্রভাবশালী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চালাচ্ছেন এসব বার
একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, রাজধানীর পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, কলাবাগান, মিরপুর, বারিধারা, গুলশান, বনানী ও উত্তরায় শতাধিক অবৈধ সিসা বার রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও অর্ধশতাধিক বার আছে। নামিদামি হোটেল ও রেস্টুরেন্টের নাম ব্যবহার করে কিছু প্রভাবশালী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চালাচ্ছেন এসব বার।
জানা গেছে, উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের জন্মদিন কিংবা যেকোনো উদযাপন উপলক্ষে পার্টিগুলোর রঙিন আকর্ষণ এখন সিসা সেবন। আগে রাজধানীর হাতে গোনা দু-একটি এলাকায় সিসা বারে বুঁদ হয়ে থাকতেন তরুণ-তরুণীরা। রেস্টুরেন্টের আদলে গড়ে ওঠা এসব সিসা বার বা লাউঞ্জে শুরুর দিকে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের যাতায়াত থাকলেও এখন প্রায় সব শ্রেণির তরুণ-তরুণীর আনাগোনা বাড়ছে। এসব রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার পর সিসা সেবন ‘ডেজার্ট’ হিসেবে মনে করছেন তারা।
অন্যদিকে, সিসা বারের মালিকরাও সিসা সেবন ক্ষতিকর বা বেআইনি নয় বলে মনে করছেন। তাদের মতে, সিসা ক্ষতিকারক কোনো মাদক নয়। এটি সেবন খাবারের পর একধরনের ‘ডেজার্ট’ (ভোজের শেষে পরিবেশিত মিষ্টি, ফলমূল, আইসক্রিম ইত্যাদি)! যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের আইন অনুযায়ী, দেশে সিসা বার পরিচালনা ও সেবন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী, সিসাকে মাদকদ্রব্যের ‘খ’ শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ আইনে সিসা বার পরিচালনা ও সেবন সম্পর্কিত অপরাধ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম এক বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া নগদ অর্থদণ্ডেরও বিধান রাখা হয়েছে
সম্প্রতি গুলশানের আর এম সেন্টারে অবস্থিত তারকা দম্পতি ওমর সানি ও মৌসুমির ছেলে ফারদিন এহসান স্বাধীনের মালিকানাধীন ‘মন্টানা লাউঞ্জ’ নামের সিসা বারে অভিযান চালিয়ে ১১ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই ঘটনার পর রাজধানীর অভিজাত এলাকায় নিষিদ্ধ সিসা বারের রমরমা বাণিজ্য নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়। গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১১ জনকে আসামি করে মামলা হলেও বারের মালিক ফারদিন এহসান স্বাধীনের নাম বাদ দেওয়া হয়।
মন্টানা লাউঞ্জে অভিযান পরিচালনার পর নায়ক ওমর সানির অবস্থান ছিল অবাক করার মতো। তিনি ছেলের পক্ষ নিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিসা সেবন মারাত্মক কোনো অপরাধ নয়। দেশের আইন অনুযায়ী সিগারেট সেবন বৈধ, তাহলে সিসা সেবন কেন অবৈধ? সিসায় দশমিক দুই মাত্রার চেয়েও কম নিকোটিন থাকে। মন্টানা লাউঞ্জ ৯০ শতাংশ ফুড আইটেম এবং ১০ শতাংশ সিসা লাউঞ্জ হিসেবে পরিচালিত হতো। খাবারের পর সিসা সেবন ছিল ডেজার্টের মতো।
তিনি দাবি করেন, গুলশান-বনানীতে রেস্টুরেন্টের আদলে ৪০টির মতো সিসা লাউঞ্জ রয়েছে। সেগুলো চলতে পারলে তার ছেলের সিসা লাউঞ্জ পরিচালনায় সমস্যা কোথায়?
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে ‘গুলশান-বনানীতে রেস্টুরেন্টের আদলে ৪০টির মতো সিসা লাউঞ্জ রয়েছে’ বলে ওমর সানি যে দাবি করেছেন তার সত্যতাও পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গুলশান-বনানীতে হোটেল ও রেস্টুরেন্টের নামে আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়েছে অসংখ্য সিসা বার। সেখানে প্রতিনিয়ত চলছে সিসা সেবন। অবৈধ সিসা বারের তালিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে থাকলেও মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় অভিযান চালানো হয় না বললেই চলে। আবার অভিযান চালানো হলেও কিছুদিন পর সেগুলো পুনরায় চালু হয়।
প্রভাবশালী মালিকরা রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে সিসা বারের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন কৌশলে বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ সিসা আমদানি করে বার পরিচালনা করছেন বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সিসা ক্ষতিকারক মাদক কি না— এ বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, যেসব বারে সিসার মধ্যে নিকোটিনের পরিমাণ শূন্য দশমিক দুই এর নিচে সেসব বারে অভিযান চালানো যাবে না। এর চেয়ে বেশি পরিমাণের নিকোটিন থাকলে অভিযান পরিচালনা করা যাবে। পরিমাণগত সমস্যার কারণে সিসা বারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চালানো নিয়ে সংশয় তৈরি হয়।
যদিও আইন অনুযায়ী সিসা বার পরিচালনা বা সিসা সেবন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী, সিসাকে মাদকদ্রব্যের ‘খ’ শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ আইনে সিসা বার পরিচালনা ও সেবন সম্পর্কিত অপরাধ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম এক বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া নগদ অর্থদণ্ডেরও বিধান রাখা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
আইন থাকলেও সিসা বার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিভিন্ন মহলে। অভিযোগ রয়েছে, মালিকরা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে দীর্ঘদিন ধরে সিসা বার পরিচালনা করে আসছেন। ওমর সানির ছেলের সিসার বারে অভিযান পরিচালনার পর তার বিরুদ্ধে মামলা না দেওয়ায় এ অভিযোগ আরও জোরালো হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ আবুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মন্টানা লাউঞ্জে’ প্রাথমিকভাবে যে কয়জনকে পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত চলমান। তদন্তে তারকা দম্পতি ওমর সানি ও মৌসুমির ছেলে ফারদিন এহসান স্বাধীনের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকেও আসামি করা হবে।
এদিকে, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সিসা বারের ওপর তাদের নজরদারি রয়েছে। তারা এ বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করছেন। নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এসব বারে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজধানীর অভিজাত এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ সিসা বার চলছে কি না, বিষয়টি আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা এসব স্থানে অভিযান পরিচালনা করব।
রাজধানীতে শতাধিক এবং গুলশান-বনানীতে ৪০টির ওপরে সিসা বার রয়েছে— এমন অভিযোগ অস্বীকার করে ডিএনসির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারা দেশের মধ্যে ঢাকায় ১৯টি সিসা বার রয়েছে এবং ঢাকার বাইরে ৩-৪টা বার আছে বলে জানি। কিন্তু কেউ গোপনে সিসা বার পরিচালনা করলে সেটা আমার জানা নেই।
তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী সিসা বার অবৈধ। এটিকে কেউ বৈধ বলার চেষ্টা করলে সেটি আইন বিরোধী। তবে যেসব বারের সিসাতে নিকোটিনের পরিমাণ শূন্য দশমিক দুই এর নিচে থাকবে তখন সেটি সিসা হবে না। নিকোটিনের মাত্রা শূন্য দশমিক দুই এর বেশি হলে সিসা বলা যাবে। সিসা সেবন ও বার পরিচালনা আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এসব বার আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। নিকোটিনের মাত্রা বেশি থাকলে বারগুলোতে অবশ্যই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এমএসি/ওএফ/এমএআর/