নাজিমুদ্দিন রোডে খোঁড়াখুঁড়ির মচ্ছব
‘অপারেশন শেষ হলেও হয় না সেলাই’
রাজধানীর পুরান ঢাকা। নাম শুনলেই কল্পনায় ভেসে আসে ‘সরু অলিগলি আর জালের মতো বিছানো হাঁটাপথ’। যেখানে সড়ক দিয়ে একটি প্রাইভেটকার গেলে আরেকটির দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সেই সরু সড়কে যখন খোঁড়াখুঁড়ি চলে তখন যেন ভোগান্তির শেষ থাকে না স্থানীয় বাসিন্দাদের। সেই সড়ক যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়।
পুরান ঢাকার সব সড়কের মতো একই অবস্থা নাজিমুদ্দিন রোডেরও। ভোগান্তিতে বিরক্ত স্থানীয়রা সড়কটিকে তুলনা করছেন ক্যান্সারের সঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
তারা বলছেন, অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে প্রথমে সার্জারি করা হয়, তারপর সেলাই দেওয়া হয়। সেই কাটাস্থান শুকাতে লেগে যায় মাসের পর মাস। এ সড়কের অবস্থাও তা-ই। প্রথমে সড়কটিতে খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়, পরে সংস্কারের নামে কাজ চলে দীর্ঘদিন। ফলস্বরূপ ভোগান্তি পোহাতে হয় জনসাধারণকে।
নাজিমুদ্দিন রোডের শুরুর অংশে নতুন পিচ ঢালায় দেওয়া হয়েছে। সেখান দিয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়াই মানুষ যাতায়াত করছে। কিন্তু একটু সামনে এগোতেই শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ থেকে শুরু হয় ভোগান্তি। সেখান থেকে শাহী জামে মসজিদ পর্যন্ত ইটের খোয়া আর বালু বিছানো থাকলেও কাজের গতি নেই
স্থানীয়রা জানান, ওয়াসার পানি নিষ্কাশনের জন্য কয়েকদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় সড়কটিতে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। বড় বড় পাইপ স্থাপনের জন্য অপারেশন থিয়েটারের মতো কাটাছেঁড়া করা হয় পুরো সড়ক। দীর্ঘ সময় পর সেখানে সেলাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। তাও ধীরগতিতে চলছে, অভিযোগ স্থানীয়দের।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নাজিমুদ্দিন রোডের শুরুর অংশে নতুন পিচ ঢালায় দেওয়া হয়েছে। সেখান দিয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়াই মানুষ যাতায়াত করছে। কিন্তু একটু সামনে এগোতেই শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ থেকে শুরু হয় ভোগান্তি। সেখান থেকে শাহী জামে মসজিদ পর্যন্ত ইটের খোয়া আর বালু বিছানো থাকলেও কাজের গতি নেই।
এ ছাড়া সড়কজুড়ে পড়ে আছে নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রী। ফলে সড়কটি চলাচলের প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। রিকশা যেতে পারলেও অন্যান্য পরিবহন পার হতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এ কারণে আশপাশের সব দোকানের ক্রেতা কমেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয়রা জানান, নাজিমুদ্দিন রোডে ওয়াসার পানি নিষ্কাশনের জন্য কয়েক বছর আগে সড়কের গভীরে বড় বড় পাইপ স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে পাইপ স্থাপনের জন্য প্রায় এক বছর ধরে সড়কে চলে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। ফলে শুধু যানবাহন নয়, সাধারণ মানুষের পায়ে হাঁটার পথও বন্ধ হয়ে যায়। তবে, পাইপ স্থাপনের পর এলাকার জলাবদ্ধতা দূর হয়। কিছুদিন পর ওই পাইপ তুলে পুনরায় অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য একই কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এম এ আলী এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেই কাজ পায়। তারা ভেকু মেশিন দিয়ে কাজ শুরু করে এবং সড়কের মাটি কেটে দীর্ঘদিন ফেলে রাখে। ফের ভোগান্তিতে পড়তে হয় স্থানীয়দের।
আরও পড়ুন
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সড়কটিতে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। ফলে আমাদের চলাফেরায় কষ্ট হচ্ছে। সবাই এটিকে পুরাতন জেল রোড নামে চিনে। এ সড়ক দিয়ে জেল গেটে যাওয়া যায়। তারা (ঠিকাদার) ছয় মাসের ওপরে একটি সড়ক কীভাবে এমন দুরবস্থায় ফেলে রাখে? আমি একাধিকবার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি। মনে হয় সড়কটি এখন দোজখে পরিণত হয়েছে।
নাজিমুদ্দিন রোড ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৩ এর অধীন। এ অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, স্থানীয় কাউন্সিলর লাপাত্তা
‘এক সরকার গেছে, আরেক সরকার এসেছে। তারপরও সড়কটির সংস্কারকাজে গতি নেই। আজ দেখেন শ্রমিকরা ইট-বালু বিছানোর কাজ করছে। এক দিন কাজ চললে তিন দিন বন্ধ থাকে। কাজের প্রতি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কোনো আগ্রহ নেই। মনে হচ্ছে জোর করে কাজ করানো হচ্ছে।’
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, নাজিমুদ্দিন রোডে প্রায় অর্ধশতাধিক ফার্নিচারের দোকান রয়েছে। সড়কটি খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে দোকানগুলো।
ব্যবসায়ীরা জানান, পাইপ বসানোর নামে সড়কটি যাচ্ছেতাইভাবে কাটা হয়েছে। মানুষ চলাচল করতে পারছে না। দীর্ঘদিন সড়কটি বন্ধ ছিল। এখনও কাজ চলছে, তবে খুব ধীরগতিতে। ৪২টি ফার্নিচারের দোকানে কোনো বেচাকেনা নেই। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মহাবিপদে আছেন তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল জানান, নাজিমুদ্দিন রোডের পুরো অংশই মাটি খুঁড়ে রাখা হয়েছিল। অর্ধেক অংশজুড়ে রাখা হয়েছিল পাইপ। এখন ফেলে রাখা হয়েছে বালু ও ইটের খোয়া। কাজ চলছে খুবই ধীরগতিতে। রিকশা চলাচল করলেও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে অনেক সময় রিকশাও উল্টে যায়।
কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে— জানতে বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের সামনের অংশে কর্মরত কয়েকজন শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করা হয়। তারা বলেন, ‘ঠিকাদার ভালো বলতে পারবেন। তাদের জিগান (জিজ্ঞাসা করেন)।’ এই বলে ইটের খোয়া ও বালু মেশানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা
স্থানীয় রিকশাচালক মমতাজ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক দিন এই সড়ক বন্ধ ছিল। এখন ইট ফেলার কাজ চলছে। যাত্রী নিয়ে যেতে কষ্ট হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ভিন্ন সড়কে ঘুরে গন্তব্যে যেতে হতো।
নাজিমুদ্দিন রোড ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৩ এর অধীন। এ অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, স্থানীয় কাউন্সিলর লাপাত্তা।
কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে— জানতে বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের সামনের অংশে কর্মরত কয়েকজন শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করা হয়। তারা বলেন, ‘ঠিকাদার ভালো বলতে পারবেন। তাদের জিগান (জিজ্ঞাসা করেন)।’ এই বলে ইটের খোয়া ও বালু মেশানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা।
ড্রেন বানানো শেষ হলেও ঠিক করা হয়নি সড়ক
বেশ কিছুদিন আগে পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনের সড়কটির একপাশের ড্রেন কাটা হয়। তার জন্য ভাঙা হয় সড়কের একটি অংশ। কিন্তু ড্রেনটি পাকা করা হলেও সড়কটি আর ঠিক করা হয়নি। ফলে স্থানীয়দের চলাচলে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম এ আলী এন্টারপ্রাইজের দেওয়া অফিসের ঠিকানায় গিয়ে একটি খাবারের দোকান দেখা যায়। আশপাশে কথা বললেও এ অফিস সংক্রান্ত কোনো তথ্য কেউ দিতে পারেননি। যার ফলে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন যেসব সড়কে সংস্কার, নির্মাণের কাজ চলছে সেগুলোর কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। জনদুর্ভোগ যেন না হয়, সে কারণে দ্রুত শেষ করতে আমাদের কাজ চলছে।
এমএসআই/এমজে