কুড়িল-প্রগতি সরণি দিয়ে ‘দুঃস্বপ্নের যাত্রা’, কবে যাবে দুর্ভোগ
রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক প্রগতি সরণির কুড়িল বিশ্বরোড থেকে কালাচাঁদপুর (নদ্দা) পর্যন্ত দুই পাশের রাস্তায় চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। বিশাল এ কর্মযজ্ঞ ঘিরে নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে দেওয়া হয়েছে সিমেন্টের মোটা ব্লক। ফলে রাস্তা অনেকটা সরু হয়ে গেছে। তিন লেনের গাড়ি এসে এক লেনে জড়ো হচ্ছে। ফলস্বরূপ, কুড়িল থেকে প্রগতি সরণি রাস্তায় দিন-রাত যানজট লেগে থাকছে।
যাত্রীদের এ পথ পাড়ি দেওয়া যেন দুঃস্বপ্নের যাত্রায় পরিণত হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে কিংবা ব্যক্তিগত পরিবহনে বসে কাটাতে হচ্ছে। ফলে একদিকে দৈনিক মূল্যবান অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অনেকে।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর এবং কুড়িল থেকে কাঞ্চন সেতু পর্যন্ত এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের কাজ চলমান। চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। প্রাথমিক পর্যায়ে বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, কুড়িল, যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় চলছে ইউটিলিটি স্থানান্তরের কাজ। এটি করার জন্য যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের ফুটওভার ব্রিজের আধুনিক এস্কেলেটর বন্ধ রাখা হয়েছে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর এবং কুড়িল থেকে কাঞ্চন সেতু পর্যন্ত এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের কাজ চলমান। চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। প্রাথমিক পর্যায়ে বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, কুড়িল, যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় চলছে ইউটিলিটি স্থানান্তরের কাজ। এটি করার জন্য যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের ফুটওভার ব্রিজের আধুনিক এস্কেলেটর বন্ধ রাখা হয়েছে
কুড়িল থেকে কালাচাঁদপুর পর্যন্ত রাস্তায় সরেজমিনে দেখা যায়, এ অংশে এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের ইউটিলিটি লাইন স্থানান্তর কার্যক্রম চলছে। কুড়িল থেকে কালাচাঁদপুর পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। মাটি খুঁড়ে ওয়াসার পাইপ, সুয়ারেজ ও গ্যাসের লাইন বসানো হচ্ছে। ফলে রাস্তার দুই পাশে যানবাহন এক লেনে চলছে। তৈরি হচ্ছে ব্যাপক যানজট। কখনও কখনও এ জট পৌঁছাচ্ছে বিমানবন্দর পর্যন্ত। অন্যদিকে, নতুনবাজার হয়ে রামপুরা পর্যন্ত ঠেকছে এটি। সকাল ৮টা থেকে এ যানজট শুরু হয়ে চলে রাত ১২টা পর্যন্ত।
গত কয়েকদিন ধরে সরেজমিনে অত্র এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সকালের অফিস টাইম এবং বিকেলে বাসায় ফেরার সময় প্রচণ্ড যানজট তৈরি হয়। যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনে বসে থাকতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, কুড়িল থেকে নতুন বাজার যেতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। রাস্তার দুই পাশে খোঁড়াখুঁড়ি চলায় মানুষ যানজটের মধ্যে হেঁটেও গন্তব্যে রওনা দিতে পারছেন না। চতুর্মুখী ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে পথচারীসহ স্থানীয়দের।
আরও পড়ুন
বিশেষ করে যমুনা ফিউচার পার্ক ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রবেশ মুখে যানবাহনের জটলা বেশি দেখা যায়। রিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি, গণপরিবহন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এ এলাকার রাস্তার দুই পাশে খোঁড়াখুঁড়িও বেশি। গণপরিবহনগুলো ইচ্ছামতো যাত্রী ওঠা-নামা করায় এ সড়কে গাড়ির চেয়ে হাঁটার গতি বেশি লক্ষ করা যায়। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশও সেখানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না। তারপরও তারা যানজট স্বাভাবিক রাখতে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে, ফুটওভার ব্রিজের এস্কেলেটর বন্ধ থাকায় ব্রিজ ব্যবহারে মানুষের মধ্যে অনীহা তৈরি হয়েছে। যে যার মতো রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে পারাপারের চেষ্টা করছেন। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
এ সড়ক ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ পথে চলতে গেলে কমপক্ষে দুই ঘণ্টার বেশি সময় হাতে নিয়ে বের হতে হয়। সীমাহীন দুর্ভোগ ও যানজটে তারা অতিষ্ঠ। কিন্তু উন্নয়নকাজ চলায় তারা বাধ্য হচ্ছেন ভোগান্তি সহ্য করে নিতে। তাদের দাবি, দ্রুত যেন এ কাজ শেষ করা হয়। কারণ, এটি রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম সড়ক। এখানে যানজট তৈরি হলে তা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
কুড়িল ও প্রগতি সরণি দিয়ে যাতায়াতকারী জুয়েল আহমেদ বলেন, প্রতিদিন উত্তরা থেকে এ রাস্তা হয়ে রামপুরায় অফিস করতে হয়। উন্নয়নকাজ চলমান থাকায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। তার মন্তব্য, ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলবে, পাশাপাশি জনগণের ভোগান্তি যাতে কম হয় সেদিকেও কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে। ৩০ মিনিটের রাস্তা যদি দুই ঘণ্টায়ও পার না হওয়া যায়, এ কষ্ট তো কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে উন্নয়নের এ কাজ শেষ করা হোক।’
হাতিরঝিলের মধুবাগ থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে হয় ইফতি মাহমুদকে। তিনি বলেন, মধুবাগ থেকে আগে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগত। এখন দুই ঘণ্টায়ও পৌঁছানো যায় না। রাস্তা কাটার কারণে যানবাহনের মধ্যে মারাত্মক রেষারেষি চলে। এ কারণে অনেক সময় ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় মোটরসাইকেল নিয়ে। আমরা চাই কাজটা দ্রুত শেষ হোক, মানুষও ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাক।
এখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কগুলোর মধ্যে অন্যতম বিমানবন্দর-রামপুরা সড়ক। এ সড়কে স্বাভাবিক সময়ে যানজটের চাপ বেশি থাকে। এর মধ্যে উন্নয়নকাজ চলায় সড়কটি সরু হয়ে গেছে। ফলে যানজটের পরিমাণও বেড়েছে।
এ বিষয়ে কালাচাঁদপুর এলাকায় দায়িত্বপালন করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, দুই পাশের রাস্তায় প্রায় অর্ধেকের মতো জায়গাজুড়ে উন্নয়নকাজ চলছে। ফলে দুই পাশে এক লেন ধরে গাড়ি চলাচল করতে পারছে। তিন লেনের গাড়ি যদি এক লেনে আসে তাহলে চাপ তো বাড়বেই, এটা স্বাভাবিক। এমনও দিন আসে, কালাচাঁদপুর ও যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের রাস্তায় সৃষ্ট যানজট একদিকে চলে যায় বিমানবন্দর পর্যন্ত, অন্যদিকে রামপুরা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তবে, আমরা আমাদের সাধ্যমতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পে যা আছে
এমআরটি লাইন-১ প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে ৩১.২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-১ এর দুটি অংশ থাকবে। বিমানবন্দর ও পূর্বাচল রুট। ১৯.৮৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ বিমানবন্দর রুটে ১২টি স্টেশন এবং ১১.৩৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড পূর্বাচল রুটে একটি ভূগর্ভস্থ স্টেশনসহ নয়টি স্টেশন থাকবে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে ৩১.২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-১ এর দুটি অংশ থাকবে। বিমানবন্দর ও পূর্বাচল রুট। ১৯.৮৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ বিমানবন্দর রুটে ১২টি স্টেশন এবং ১১.৩৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড পূর্বাচল রুটে একটি ভূগর্ভস্থ স্টেশনসহ নয়টি স্টেশন থাকবে। নির্মাণকাজ শেষ হলে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৭০ হাজার লোক যাতায়াত করতে পারবে
বিমানবন্দর-কমলাপুর রুটের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য পূর্বাচল রুটের নয়টি স্টেশনের মধ্যে সাতটি এলিভেটেড এবং দুটি (নদ্দা ও নতুন বাজার) ভূগর্ভস্থ স্টেশন থাকবে।
প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণে আরও বলা হয়েছে, মেট্রোরেল লাইনের নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয়। ২০১৬-২০১৮ সালে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। সম্পূর্ণ এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পটি ১২টি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ৫৩ হাজার ৯৭৭ কোটি। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) প্রকল্প সহায়তা হিসেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি এবং বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ১৪ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা।
সেখানে বলা হয়েছে, প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর মেট্রোরেল বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৭০ হাজার লোক যাতায়াত করতে পারবে। অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ মেট্রোরেল দিয়ে প্রতিদিন ১৩.৬৬ লাখ মানুষ চলাচল করতে পারবে, যা বর্তমানে চলমান এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের তুলনায় প্রায় ২ দশমিক ৮৩ গুণ বেশি।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. আবুল কাসেম ভূঁঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন ইউটিলিটি লাইন স্থানান্তরের কাজ চলছে। কুড়িল থেকে নদ্দা পর্যন্ত আমাদের কাজ চলমান। ধাপে ধাপে এটা কমলাপুর পর্যন্ত যাবে। কুড়িল থেকে নদ্দা পর্যন্ত কাজ ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ হয়ে যাবে। এরপর এ রুটে যানজট হয়তো কিছুটা কমে আসবে। যেহেতু উন্নয়নকাজ চলছে এবং এ কাজের মূল উদ্দেশ্য যানজট নিরসন, সেহেতু নগরবাসীকে সাময়িক কষ্ট মেনে নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
এমএসি/এসএম